৫ মার্চ ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৮

ইতালিতে এক বাংলাদেশি আক্রান্ত চার দেশের অন-অ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ

বাংলাদেশ করোনার উচ্চ ঝুঁকিতে

বিশ্বব্যাপী করোনা ছড়িয়ে পড়ায় আশঙ্কা বাড়ছে। উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে দেশ। যুক্তরাষ্ট্র যে ঝুঁকিপূর্ণ ২৫ দেশের তালিকা করেছে এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। ইতালিতে বাংলাদেশি এক নাগরিক করোনা ভাইরাসে (কভিড-১৯) আক্রান্ত হয়েছেন
বলে জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। করোনার কারণে চীন, ইতালি, ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকদের ‘অন অ্যারাইভাল’ ভিসা আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। স্কুল-কলেজেও কোয়ারেন্টিন কেন্দ্র করার চিন্তা করছে প্রতিষ্ঠানটি। গতকাল করোনা নিয়ে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, তিন দেশে মোট সাত জন বাংলাদেশির এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেল, যাদের মধ্যে দুইজন ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। ডা. ফ্লোরা বলেন, এটা আমাদের জন্য একটি দুঃসংবাদ যে, ইতালিতে একজন বাংলাদেশি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
তিনি বাসাতেই আছেন, বাসায় রেখেই তার চিকিৎসা করা হচ্ছে।

আইইডিসিআরের পরিচালক জানান, করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে বাংলাদেশের বিমানবন্দরে চীন, ইরান, ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকদের ‘অন অ্যারাইভাল’ ভিসা সুবিধা আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। ফলে কেউ আসতে চাইলে তাদের আগেই নিয়ম মাফিক ভিসার আবেদন করতে হবে। আমাদের দূতাবাস থেকে তাদের ভিসা নিয়ে আসতে হবে। ভিসা নেয়ার সময় তাদের যে করোনা ভাইরাস নেই বা কোয়ারেন্টিন পার করেছেন-এমন সার্টিফিকেট দাখিল করতে হবে। চলাফেরায় ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপের মাধ্যমে চীনের ভেতরে ভাইরাসের বিস্তার কমিয়ে আনা গেলেও চীনের বাইরে সংক্রমণ বাড়ছে দ্রুত গতিতে। ইতিমধ্যে ৭৩ দেশে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে জানিয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক বলেন, প্রতিদিনই উদ্বেগ আস্তে আস্তে বাড়ছে। ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান ও জাপানকে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

তিনি বলেন, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে করোনা ভাইরাস বাইরে বেরিয়ে গেলে দুই থেকে সাত ঘণ্টা বেঁচে থাকে। সেদিক থেকে সীমান্ত দিয়ে আসা পণ্যের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই। তবে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে এমন কোনো দেশে আপাতত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া না যেতে এবং সেসব দেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশে না আসার আহ্বান জানান অধ্যাপক ডা. সেব্রিনা ফ্লোরা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে কোনো তথ্য সরকার গোপন করছে না। রোগী বা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে জানানো হবে। সূত্র জানিয়েছে, করোনা সন্দেহে বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ৩ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। তারা ভালো আছেন। হাসপাতলটিতে ২৪ ঘণ্টায় করোনা সন্দেহে একজন ভর্তি হয়েছেন। আইইডিসিআর বলছে, এই পর্যন্ত ১০৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হলেও কারো শরীরে করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়নি। বিমান, নৌ ও স্থলবন্দর এবং একটি ট্রেসের মোট ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৯২ জন যাত্রীদের স্ক্রিনিং করা হয়েছে।

করোনা প্রতিরোধে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের নির্দেশ: আইইডিসিআর জানায়, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কভিড-১৯ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রলালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। জাতীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রীর নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সমূহের মন্ত্রীবর্গ ও সচিববৃন্দের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠিত হয়েছে। জেলা সমন্বয় কমিটিতে থাকবেন জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন, পুলিশ সুপার, মেডিক্যাল কলেজ/সদর হাসপাতালের পরিচালক/তত্ত্বাবধায়ক, জেলার সকল উপজেলা চেয়ারপারসন, সদর পৌরসভার মেয়র, সরকারী বিভাগসমূহের জেলা পর্যায়ের নির্বাহী কর্মকর্তাবৃন্দ প্রমুখ। উপজেলা সমন্বয় কমিটিতে থাকবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউএফপিও, থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট পৌর মেয়র, সরকারি বিভাগসমূহের উপজেলা পর্যায়ের নির্বাহী কর্মকর্তাবৃন্দ প্রমুখ। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা চেয়ারম্যান যথাক্রমে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটির উপদেষ্টা থাকবেন।

জেলা-উপজেলা সমন্বয় কমিটিগুলোর এ মুহূর্তে করণীয়-জেলা-উপজেলা পর্যায়ে মাল্টি সেক্টোরাল কমিটিগুলো সক্রিয় করা। পরিস্থিতির চরম পর্যায়ে যেতে পারে এটা বিবেচনায় রেখে সম্ভাব্য সকল প্রস্তুতি নিয়ে রাখা। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আইসোলেশন হাসপাতাল/ইউনিট নির্ধারণ করে পূর্ণ প্রস্তুতি নিশ্চিত করা। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সকল গঠিত রেসপন্স টিমের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। এলাকায় অবস্থিত বিমান বন্দর, সমুদ্র বন্দর ও স্থল বন্দরে পরিচালিত স্ক্রিনিং কাজের তদারকি করা। জনসচেতনতার উদ্দেশ্যে প্রচার/ প্রচারণা করা, গুজব, বিভ্রান্তি দূর করতে সক্রিয় থাকতে হবে। এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যের জন্য আইইডিসিআর ওয়েবসাইট দেখুন। সরকারের অন্যান্য বিভাগের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করা বিশেষ করে নিরাপত্তা, কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিতে অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া। কমিটি এখন থেকেই স্থানীয় স্কুল-কলেজ-অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন হলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন কেন্দ্র করা যায় কিনা তার সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করবেন। কোনো গ্রাম/পাড়া/মহল্লায় করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটলে সেখানে সামাজিক (কমিউনিটি) কোয়ারেন্টিন করার প্রস্তুতি এখন থেকেই গ্রহণ করা। বিদেশ থেকে আগত সকল যাত্রীকে স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টিন মেনে চলতে সহায়তা করা।

কভিড-১৯ সংক্রান্ত যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণে পর্যায় অনুযায়ী আইইডিসিআর-এ কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, সিভিল সার্জন বা ইউএইচএফপিও-এর সিদ্ধান্ত অবহিত হওয়া। বিদেশ থেকে আগত সকলকে আবশ্যিকভাবে নিকটস্থ সিভিল সার্জন/ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কাছে রিপোর্ট করতে হবে। রিপোর্টকালীন সময়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের তারিখ; সর্বশেষ ভ্রমণকৃত দেশ; দেশের সংখ্যা একাধিক হলে বিগত ১৪ দিনে যে সকল দেশ ভ্রমণ করেছেন সে সকল দেশের নাম; ভ্রমণের সময়কাল; দেশে অবস্থানকালীন ঠিকানা, ফোন নম্বর, মোবাইল ফোন নম্বর; দেশে প্রত্যাবর্তনের পরে দেশে অন্য কোন স্থানে/ জেলায় ভ্রমণ করে থাকলে সে স্থানের নাম/ঠিকানা লিখতে হবে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা উপজেলা চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের নিয়ে সভা করে এ বিষয়ে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবেন ও এ সংক্রান্ত তথ্য স্থানীয় কেবল টিভি অপারেটরদের মাধ্যমে কেবল টিভিতে প্রচার ও স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কাউকে করোনা আক্রান্ত বলে সন্দেহ হলে পরিচালক/ সিভিলসার্জন/ তত্ত্বাবধায়ক/ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তাৎক্ষনিকভাবে রোগতত্ত্ব রোগ নিয়স্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) কে অবহিত করবেন।

দুই মাস আগে চীনের উহান থেকে ছড়াতে শুরু করা করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা ৩ হাজার ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছেছে প্রায় ৯৩ হাজারে। এর আগে সিঙ্গাপুরে পাঁচ প্রবাসী বাংলাদেশি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে একজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। তাদের মধ্যে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নেয়া দুজন সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে গেছেন বলে গত শনিবার আইইডিসিআর থেকে জানানো হয়। তবে চীনে থাকা বাংলাদেশি বা বাংলাদেশে কারও মধ্যে এ পর্যন্ত নতুন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়নি।

এদিকে, বাংলাদেশ করোনা ভাইরাসের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ মোট ২৫ দেশ কভিড-১৯ এর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া বাকি ২৪টি দেশ হলো: আফগানিস্তান, অ্যাঙ্গোলা, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, কাজাখস্তান, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তাজিকিস্তান, ফিলিপাইন, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ইথিওপিয়া, কিরঘিজ প্রজাতন্ত্র, লাও, মঙ্গোলিয়া, নেপাল, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যে ২৫টি দেশ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বা উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের জন্য ৩ কাটি ৭০ লাখ ডলারের জরুরি তহবিল দেয়ার অঙ্গীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), অন্যান্য বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান এবং ইউএসএআইডির কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী অংশীদারদের পরিচালিত প্রকল্পের জন্য এ তহবিল দেয়া হচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিশ্রুত ১০ কোটি ডলারের প্রথম কিস্তি বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কারো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়নি।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=215969