৫ মার্চ ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৬

পিরোজপুরের সাবেক এমপির জামিন

দায়রা জজ প্রত্যাহারের ঘটনায় তোলপাড়

প্রত্যাহারের আদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না -জানতে চেয়ে হাইকোর্টের রুল * পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জজকে স্ট্যান্ড রিলিজ, আউয়ালকে জামিন : আইনমন্ত্রী * আইনমন্ত্রী ও দুদক চেয়্যারম্যানের পদত্যাগ দাবি বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের

পিরোজপুরের সাবেক এমপি একেএমএ আউয়াল ও তার স্ত্রীর জামিন খারিজের পর জেলা ও দায়রা জজ আবদুল মান্নানকে প্রত্যাহারের ঘটনায় সর্বত্র তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।

জজ প্রত্যাহারের আদেশের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। এই আদেশ কেন বেআইনি ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত (অবৈধ) ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও উপসচিবকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে নিয়ে বুধবার বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রুল জারির আদেশ দেন।

এদিকে সাবেক এমপি একেএমএ আউয়াল ও তার স্ত্রীর জামিন খারিজের পর জেলা ও দায়রা জজকে তাৎক্ষণিক বদলির ঘটনায় বুধবার দিনভর সুপ্রিমকোর্টসহ অন্যান্য আদালত অঙ্গনে বিচার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তাৎক্ষণিকভাবে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন বেশ কয়েকজন আইনজীবী। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে এ ঘটনার তীব্র সমালোচনা।

বিকালে সচিবালয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সাবেক এমপি একেএমএ আউয়ালের জামিনের সময় জেলা ও দায়রা জজ মো. আবদুল মান্নান অত্যন্ত অশালীন ও রূঢ় ব্যবহার করেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ওই বিচারককে স্ট্যান্ড রিলিজ এবং পরে আউয়ালকে স্ত্রীসহ জামিন দেওয়া হয়েছে।

এ ঘটনার জন্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের পদত্যাগ দাবি করেছেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক এএম মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। এছাড়া এদিন সকালে বিচারক প্রত্যাহারের ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন কায়েকজন আইনজীবী হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চে নজরে আনেন। আদালত তাদের বিষয়টি প্রধান বিচারপতির নজরে আনার পরামর্শ দেন।

প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার সকালে পিরোজপুরের সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএমএ আউয়াল তিনটি মামলায় এবং তার স্ত্রী লায়লা পারভীন একটি মামলায় পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন। দুপুরে শুনানি শেষে বিচারক মো. আবদুল মান্নান জামিন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

কারাগারে পাঠানো আদেশের পর আউয়াল ও লায়লা পারভীনের আইনজীবী আদালতে তাদের অসুস্থতার চিকিৎসা প্রতিবেদনসহ হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা ও ডিভিশন দেয়ার আবেদন করেন। ওইদিন বেলা পৌনে ৩টার দিকে বিচারক ডিভিশনসহ হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। এর কিছুক্ষণ পর জেলা ও দায়রা জজ মো. আবদুল মান্নানকে বদলির চিঠি পাঠানো হয়। এরপর তিনি যুগ্ম ও জেলা জজ নাহিদ নাসরিনের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে আউয়াল ও লায়লা পারভীনের আইনজীবীরা ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ নাহিদ নাসরিনের কাছে পুনরায় জামিনের আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিকাল ৪টার দিকে বিচারক তাদের দুই মাসের জামিন দেন।

হাইকোর্টের রুল : বুধবার দুপুরের পর হাইকোর্টে এ বিষয়ে প্রকাশিত তিনটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন নজরে আনেন ব্যারিস্টার আবদুল কাইয়ুম ও ইউনুছ আলী আকন্দ। এ সময় আদালতে উপস্থিত থাকা সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এএফ হাসান আরিফের মতামত নেন হাইকোর্ট। এরপর আদালত রুল জারির আদেশ দেন। আদালতের আদেশ নিশ্চিত করেছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশ গুপ্ত, ব্যারিস্টার আবদুল কাইয়ুম ও ইউনুছ আলী আকন্দ।

অমিত দাশ গুপ্ত যুগান্তরকে বলেন, পিরোজপুরের সাবেক এমপি একেএমএ আউয়াল ও তার স্ত্রীর জামিন খারিজের পর জেলা ও দায়রা জজ আবদুল মান্নানকে তাৎক্ষণিক বদলির আদেশ প্রশ্নে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। রুলে জেলা ও দায়রা জজ আবদুল মান্নানকে তাৎক্ষণিক বদলির আদেশ কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও উপসচিবকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

আইনমন্ত্রী যা বললেন : পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য একেএমএ আউয়ালের জামিনের সময় জেলা ও দায়রা জজ মো. আবদুল মান্নান অত্যন্ত অশালীন ও রূঢ় ব্যবহার করেছেন বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। একই সঙ্গে এ ঘটনায় লোকজন রাস্তায় নামে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ওই বিচারককে স্ট্যান্ড রিলিজ এবং পরে আউয়ালকে স্ত্রীসহ জামিন দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি। বুধবার বিকালের পর সচিবালয়ে নিজ দফতরে তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী এ কথা বলেন।

আনিসুল হক বলেন, পিরোজপুর জেলা জজের কাছে পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তার স্ত্রী দুর্নীতির মামলার জন্য জামিন চাইতে গিয়েছিলেন। জামিন চাওয়ার সময় তার আইনজীবী এমনকি অন্য সব আইনজীবীর সঙ্গে অত্যন্ত অশালীন এবং রূঢ় ব্যবহার করেন জেলা ও দায়রা জজ। আমরা গতকাল থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছি।

আইনমন্ত্রী বলেন, সেই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এমন একটা অবস্থা দাঁড়ায়, যেখানে বারের সবাই আদালত বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এমনকি রাস্তায় গণ্ডগোল চলছিল। রাস্তায় লোকজন বেরিয়ে গিয়েছিল। সেটাকে কন্ট্রোল করার জন্য তাকে সেখান থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে আদেশ দেয়া হয় আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে।

বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সংবাদ সম্মেলন : পিরোজপুরে সাবেক এমপি একেএমএ আউয়াল ও তার স্ত্রীর প্রথমে জামিন নামঞ্জুর এবং পরে জামিন দেয়ার ঘটনায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের পদত্যাগ দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন সুপ্রিমকোর্ট বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার খোকন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আদালত জামিন বাতিলের আদেশের সঙ্গে সঙ্গেই আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সাক্ষরিত এক আদেশে তাকে (মো. আবদুল মান্নান) পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজের পদ থেকে প্রত্যাহার করে (স্ট্যান্ড রিলিজ) আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়।

পরে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ নাহিদ নাসরিনকে ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজের দায়িত্ব দেয়া হয়। দায়িত্ব দেয়ার পর তিনি জামিন দেন। তিনি বলেন, এ ঘটনা স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপের শামিল। আইনমন্ত্রী অযাচিতভাবে সাবেক এমপির জামিন নিশ্চিত করার জন্য পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজকে বদলি করেন।

ওই জামিন কেলেঙ্কারি দেশের সাধারণ জনগণের বিচার বিভাগের ওপর আস্থা নষ্ট করেছে এবং বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আইন সচিব, যুগ্ম সচিব ও জামিন দেয়া বিচারককে দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়েরের দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

প্রধান বিচারপতির নজরে আনার পরামর্শ : বিচারক প্রত্যাহারের ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বুধবার সকালে হাইকোর্টের নজরে আনেন কয়েকজন আইনজীবী। নজরে আনার পর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেছেন, ‘এটা প্রধান বিচারপতির নজরে আনেন। কী হয়েছে, আমরা জানি না। প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের অভিভাবক। তিনি নিু আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিএ) কমিটির প্রধান। প্রধান বিচারপতি পিরোজপুরের জেলা জজের অপসারণের বিষয়টি নিয়ে তিনি বলতে পারবেন। আমরা এই বেঞ্চে বসে এই বিষয়ে কিছু বলতে পারব না, কারণ ওই প্রত্যহারের সঙ্গে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশনের বিষয় জড়িত। বিষয়টি আলাদাভাবে হাইকোর্টের নজরে আনেন আইনজীবী মুহাম্মদ শিশির মনির ও ব্যারিস্টার আবদুল কাইয়ুম লিটন।

এছাড়া ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বিষয়টি বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, চার ঘণ্টার মধ্যে জেলা জজকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। রিলিজ করে তার অধীনস্থ একজন যুগ্ম জেলা জজকে দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু সারা দেশে যারা জেলা জজ আছেন, তারা মানসিকভাবে কী চিন্তা করছেন? এটা নজের এনেছি। আমি বলেছি, প্রধানমন্ত্রী চেষ্টা করে যাচ্ছেন যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য যতটুকু পারা যায়, চেষ্টাটার মধ্যে এটা কি একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না?

এটা সরকারকে কি এটা বিব্রত করছে না? আমি বলেছি, এটা আপনারা (হাইকোর্ট) ইন্টারফেয়ার (হস্তক্ষেপ) করলে করতে পারেন। তখন তিনি (আদালত) আমাকে রিটে যেতে বললেন।

গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের বরিশাল সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আলী আকবর বাদী হয়ে আউয়ালের বিরুদ্ধে খাসজমিতে ভবন নির্মাণ, অর্পিত সম্পত্তি ও পুকুর দখলের অভিযোগে তিনটি মামলা করেন। একটি মামলায় আউয়ালের সঙ্গে তার স্ত্রী পিরোজপুর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী লায়লা পারভীনকেও আসামি করা হয়েছে। ৭ জানুয়ারি আউয়াল ও লায়লা পারভীন হাইকোর্ট থেকে আট সপ্তাহের অন্তর্বর্তী জামিন নেন। মঙ্গলবার ওই জামিনের মেয়াদ শেষ হলে তারা পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/285366/