৫ মার্চ ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৫

বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে মানুষের কর্মসংস্থানে ভাটা

বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ব্যাংকগুলোর উপর মানুষের আস্থা কমেছে। এতে করে প্রত্যাশা অনুযায়ী আমানত আসছে না। ফলে ব্যাংকগুলোতে অর্থ সংকট রয়েছে। আবার সরকারের ব্যয়ের তুলনায় আয় কম। তাই বাজেট ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে সরকার অতিমাত্রায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। ফলে প্রভাব পড়ছে বেসরকারি ঋণে। ধারাবাহিকভাবে কমছে এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২০ শতাংশে। এ হার ২০১০ সালের পর সর্বনিম্নে। বেসরকারি খাতে কম ঋণ মানে হলো কম বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাওয়া। এর ফলে কর্মসংস্থান ও সাধারণ মানুষের আয়ে ভাটা পড়েছে। এদিকে বিদেশী বিনিয়োগও কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখতে পারছে না। প্রতিবছর বিদেশী বিনিয়োগ বাড়লেও কমছে কর্মসংস্থান। গত ১০ বছরের তথ্যে দেখা যায় বিদেশী বিনিয়োগে কর্মসংস্থান তিনভাগের প্রায় দুইভাগই কমে গেছে।

বর্তমান সরকারের বর্ষপূর্তিতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমান সরকারের প্রধান লক্ষ্য তরুণ সমাজের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা। চলতি মেয়াদে দেড় কোটি নতুন কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেন। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলেছে যুক্তি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে ১৫টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের জন্য আসছেন। সারাদেশে দুই ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে সারাদেশে ভকেশনাল এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় সরকারের উদ্যেশ্য বাস্তবায়ন কঠিন হবে। কেননা বেসরকারি খাতে কম ঋণ মানে হলো কম বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যও কমে যাওয়া। এর ফলে কর্মসংস্থান ও সাধারণ মানুষের আয়েও ভাটা পড়বে।

জানা গেছে, বর্তমানে যারা বাড়তি ঋণ নিতে চান, তাঁদের অনেককে ব্যাংক টাকা দিতে আগ্রহী নয়। আর ব্যাংক যাদের ঋণ দিতে আগ্রহী, তাঁদের অনেকেরই আপাতত টাকার দরকার নেই। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় গতিহীন ব্যবসা-বাণিজ্যে মানুষের কর্মসংস্থানে ভাটা পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২০ শতাংশে। এ হার ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ওই সময় ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ০৯ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকগুলোতে লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এ কারণে ব্যাংকগুলোকে বাড়তি নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশণ) রাখতে হচ্ছে। আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। ফলে তারল্য সংকটে রয়েছে অনেক ব্যাংক। অন্যদিকে বাজেটের ব্যয় ঠিক রাখতে সরকার অতিমাত্রায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। যা বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমাতে চাপ সৃষ্টি করছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে কাঙ্খিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব নয়।

চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মুদ্রানীতিতে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। অন্যদিকে চলতি অর্থ বছরের (জুলাই-জুন) পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ ধরলেও শেষ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ১১ দশমিক ২৯ শতাংশে।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ঋণের প্রবৃদ্ধি কমার মূল কারণ বেসরকারি খাতে বিনিযোগ হচ্ছে না। ফলে ঋণের চাহিদা কমে গেছে। এছাড়া ব্যাংকগুলোরও সমস্যা আছে। বেশকিছু ব্যাংকের তারল্য সংকট আছে। উদ্যোক্তাদের ঋণের চাহিদা কমে গেছে। বিগত দিনগুলোতে মূলধনীয় যন্ত্রপাতি আমদানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। শিল্প-কারখানার কাঁচামাল আমদানিও কমেছে। এসব কিছু দেখে বোঝা যাচ্ছে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করছে না। অথবা বিনিয়োগের যতটুকু সক্ষমতা রয়েছে তা কাজে লাগাচ্ছে না। যার কারণে ঋণের চাহিদা কম।

সাবেক এ অর্থ উপদেষ্টা বলেন, একদিকে কিছু ব্যাংকের তারল্য সংকট চলছে। অন্যদিকে সরকার অতিমাত্রায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। অর্থবছরের বাজেটের যে লক্ষ্য ছিল ৭ মাসেই তার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে। এটিও বেসরকারি খাতের ঋণ কমাতে মূল ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া ৯ শতাংশ ঋণ বাস্তবায়ন করতে হলে ৬ শতাংশে আমানত সংগ্রহ করবে। আমাদের মূল্যস্ফীতি এখন প্রায় ৬ শতাংশ তাই কেউ এ রেটে টাকা রাখতে চাইবে না। ফলে আগামীতে আমানত প্রবৃদ্ধিও কমবে। আর আমানত না পেলে ব্যাংক ঋণ দিতে পারবে না। তারমানে ঋণের চাহিদা থাকা সত্তেও ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারবে না।

এদিকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে অস্বাভাবিক হারে ঋণ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়েছে ৫২ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে ৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা; আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়েছে ৪৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে নেওয়া সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণের স্থিতি বা পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে এক লাখ ৪৫ লাখ ৩৮০ কোটি টাকা। আর ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা নেওয়ার কথা। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম সাড়ে ৭ মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ১১০ শতাংশে পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে তুলনায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আগের মাস নভেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ, অক্টোবরে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয় ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ। এর আগের মাস সেপ্টেম্বরে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর আগের মাস জুলাই শেষে ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ। জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, হলমার্কের ঘটনার পর সোনালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক সংকোচ ও ভীতি রয়েছে। এটি একেবারে থাকা উচিত নয়। এ ভয় দূর করে ঋণ দেয়ার পরামর্শ দিয়ে গভর্নর বলেন, আপনারা (কর্মকর্তারা) যদি সব ধরনের নিয়ম পরিপালন করে ঋণ প্রদান করে থাকেন, তাহলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বিতরণকৃত ঋণ কখনো সন্দেহজনক, কখনো মন্দ মানের হবেই। তাই বলে ঋণ দেয়ার বন্ধ করবেন নাকি? দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে ঋণ দিতে হবে। আর ভয়ভীতি কাটিয়ে সব ধরনের নিয়ম মেনে ঋণ প্রদান করবেন, তাহলে কোনো সমস্যা হবে না। আর ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে আপনারা যেন কোনো সমস্যায় না পড়েন, এ জন্য অর্থমন্ত্রণালয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময় আপনাদের পাশে থাকবে।

এদিকে ব্যাংকগুলোর আমানত ও ঋণের প্রবৃদ্ধি চিত্র যেন বছরে বছরে পাল্টে যাচ্ছে। ২০১৭ ব্যাংকে তারল্য অনেক বেড়ে গিয়ে ঋণের সুদের হার কমে যায়। ২০১৮ সালের শেষ দিকে ব্যাংকঋণ দেওয়ার মতো টাকার অভাব দেখা যায়। কারণ, আমানত কমে গিয়েছিল। তখন ব্যাংকগুলোর চাপে ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) সমন্বয়ের সীমা দফায় দফায় বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৮ সালের নভেম্বরে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ, তবে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয় ১৪ শতাংশের বেশি। ঠিক এক বছর পর গত নভেম্বর আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। তবে ওই মাসে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে হয় ১০ শতাংশ। ঋণের চাহিদা কমে গেছে। ফলে ভালো গ্রাহকেরা ঋণ নিচ্ছেন কম। আর মন্দরা পাচ্ছেন কম। বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিতে ব্যাংকের ঋণ বাড়তেই থাকে। ২০০৯-১০ অর্থবছর শেষে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ২৪ শতাংশের বেশি। বছরওয়ারি হিসেবে, এরপর তা সব সময়ই ১০ শতাংশের বেশি ছিল। এমনকি ২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত ডিসেম্বরের হিসাবে তা দুই অঙ্কের নিচে নামে।

ব্যাংকের ভালো গ্রাহক হিসেবে পরিচিত ব্যবসায়ীরা বাড়তি ঋণ না নেওয়ার কারণ তিনটি। তাহলো- সুদের হার বেশি, স্থানীয় বাজারে পণ্যের চাহিদা কম এবং রফতানি খাতে ভাটার টান। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস শেষে রফতানি আয় প্রায় ৬ শতাংশ কমেছে। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমদানি কমেছে প্রায় ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতিও বাড়তি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ চাপে রয়েছে। বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী পণ্যের চাহিদা ততটা তেজি না থাকার কথা বলছে। সিমেন্ট, ইস্পাত, বস্ত্র, সিরামিক, ওষুধ, কাগজ, পাট ইত্যাদি খাতে এত দিন যে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে, তা মোটামুটি সাধারণ প্রযুক্তির। এসব খাত এখন চাহিদার তুলনায় বাড়তি উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে ভারাক্রান্ত। উদ্যোক্তাদের মুনাফা কমে গেছে। বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো বিপুল বিনিয়োগ করে এখন ধীরে চলো নীতিতে চলছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এখন দরকার নতুন পণ্যে বিনিয়োগ এবং নতুন প্রযুক্তি। দরকার নতুন উদ্যোক্তা গোষ্ঠী। এ জন্য সমাধান হতে পারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত এবং বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানো। সমস্যা হলো নতুন উদ্যোক্তাদের ব্যাংক ঋণ দেয় না। বিদেশী বিনিয়োগও ততটা বাড়ছে না।

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) প্রাথমিক প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে। এ সময়ে মোট বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে ৩৪০ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৬ শতাংশের মতো কম। আবার বিদেশী বিনিয়োগও কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখতে পারছে না। প্রতিবছর বিদেশী বিনিয়োগ বাড়লেও কমছে কর্মসংস্থান। গত ১০ বছরের তথ্যে দেখা যায় বিদেশী বিনিয়োগে কর্মসংস্থান তিনভাগের প্রায় দুইভাগই কমে গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সমীক্ষাতে এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশে এখন প্রচুর পরিমাণ কর্মসংস্থান প্রয়োজন। এ জন্য বিদেশী বিনিয়োগ প্রয়োজন। এ বিনিয়োগ হতে হবে উৎপাদনমুখী ও শ্রমঘন শিল্পে। বিনিয়োগ বাড়ল অথচ কর্মসংস্থান কমে গেল- এমন হলে আগামীতে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।

তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরের মধ্যে বিদেশী বিনিয়োগে সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান ছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৩ হাজার ৬৬২ জন। এরপরের অর্থবছর ২০১১-১২ এ কর্মসংস্থান ছিল ৪ লাখ ৫১ হাজার ১১৫ জন। এরপরের বছরগুলোতে কর্মসংস্থান কমতে কমতে এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে এর ধারেকাছে নেই। তথ্যে উল্লেখ করা হয়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩ লাখ ৯ হাজার ৭০৯ জন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২ লাখ ২৪ হাজার ৯৪৩ জন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২ লাখ ২৬ হাজার ৪১১ জন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে কর্মসংস্থান দাঁড়ায় ২ লাখ ৬৬ হাজার ৪৯২ জন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কর্মসংস্থান নেমে দাঁড়ায় ১ লাখ ৯১ হাজার ৯০৯ জনে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৭ হাজার ৫৪৬ জন। সর্বশেষ বিদায়ী অর্থবছরে কর্মসংস্থান কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৯০ হাজারের নিচে। তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১০ বছর আগের যেখানে কর্মসংস্থান ছিল ৫ লাখ ৩ হাজার ৬৬২ জন, ১০ বছর পরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজারের নিচে। কর্মসংস্থান হ্রাসের হার প্রায় ৬৩ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশ।

এ ব্যাপারে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সদস্য নাভাস চন্দ্র বলেন, বিনিয়োগ বড় হলে বেশি কর্মসংস্থান হয়। বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষের লিপিবদ্ধ হওয়া তথ্যে বিনিয়োগ পরিস্থিতির বড় চিত্র প্রতিফলিত হয় না। এ কারণে বেশি কর্মসংস্থান চোখে পড়ে না। অন্যদিকে বস্ত্রখাতের শ্রমঘন শিল্পে এখানে বিনিয়োগ হলেও বিনিয়োগচিত্রে তা প্রদর্শিত হয় না। আপাতদৃষ্টে তাই মনে হয়, বিনিয়োগ বাড়লেও কর্মসংস্থান সেভাবে হচ্ছে না।

দেশের মোট কর্মশক্তির প্রায় ৬০ শতাংশ ১৫-৬৪ বছরের। দেশে যুব কর্মশক্তির হার সারা বিশ্বের প্রথম ১০ দেশের অন্যতম। অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা মনে করছেন, এই বিপুল কর্মক্ষম জনশক্তির কর্মসংস্থান প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন বিদেশি বিনিয়োগ। বিশেষ করে শ্রমঘন শিল্পে এ বিনিয়োগ আসতে হবে। বর্তমান সরকারের রূপকল্প-২০৪১ অনুযায়ী, ২০২১ অনুযায়ী দেশকে মধ্যম আয় এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ আকাক্সক্ষার বাস্তবায়নে বিদেশী বিনিয়োগকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দেশে উন্নয়ন কাজ পরিচালনা করার জন্য যে বিদেশী ঋণ নেওয়া হচ্ছে তার পরিশোধও নির্ভর করছে বিদেশী বিনিয়োগের ওপর। বিনিয়োগ বাড়লে রফতানি বাড়বে, রফতানি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়বে। বর্তমানে বৈদেশিক বিনিয়োগ আশানুরূপ নয়। আবার যা আসছে তাও অনেকটা টেকনোলজিনির্ভর, শ্রমঘন নয়। ফলে কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথে বৈদেশিক বিনিয়োগ আশা জাগাতে পারছে না বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।

http://dailysangram.info/post/408885