২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, শনিবার, ১:০৭

চীনা পণ্যের দাম নিয়ে খামখেয়ালি

দেশের শিল্প-কারখানার কাঁচামাল, মেশিনারিজ পণ্য, ইলেক্ট্রনিক্স, খেলনা ও কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্যের বড় উৎস চীন। করোনা ভাইরাসের কারণে ইতিমধ্যেই চীনের সঙ্গে দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিও। এ অবস্থায় করোনার অজুহাতে দেশের বাজারে চীন থেকে আমদানিকৃত সব পণ্যের দাম ইচ্ছেমতো নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আমদানি বন্ধ থাকার কথা বলে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্য নিচ্ছেন তারা। সেই প্রভাব পড়েছে সাধারণ ক্রেতাদের ওপর। করোনা ভাইরাস দেখা দেয়ার পর থেকে চীন থেকে আমদানি করা সব পণ্যের দাম অন্তত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। বেশি বাড়ানো হয়েছে কাপড়ের দাম।

এছাড়া শিশুদের খেলনা সামগ্রী, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, মেশিনারিজ পণ্যসহ অন্যান্য পণ্যগুলোর দামও বাড়ানো হয়েছে। এতে মার্কেটগুলোতে ক্রেতা সংকট দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থা আর কিছুদিন থাকলে পণ্যের দাম আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। কাপড় ব্যবসায়ীরা যদিও সবধরনের ফেব্রিক্সের প্রতি গজে মানভেদে ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বাড়ার কথা বলছেন। কিন্তু ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো দাম হাঁকাচ্ছেন। একজন ক্রেতা জানান, এর আগে তিনি যে কাপড়টি ৭০ টাকা গজে কিনেছেন সেটা এখন ১৫০ টাকা দাম চাচ্ছেন বিক্রেতারা। এ অবস্থায় দোকানে ক্রেতা অনেকটা কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কিছু ক্রেতা মার্কেটে আসলেও দাম শুনে চলে যাচ্ছেন। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে কিছুদিনের মধ্যে দাম আরো বেড়ে যাবে। তখন ক্রেতারা মার্কেট থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এতে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে পারেন ব্যবসায়ীরা।

সরজমিনে রাজধানীর ইসলামপুরের চায়না মার্কেট, নবাবপুর এবং চকবাজারের মার্কেটগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতা না থাকায় দোকানিরা অবসর সময় পার করছেন। চায়না মার্কেট খ্যাত ইসলামপুরের আহসান মঞ্জিল সুপার মার্কেটে চায়না থেকে বিপুল পরিমাণ কাপড় আসে। মার্কেটটির গ্রাউন্ড ফ্লোরে পাইকারি দোকানগুলোতে রয়েছে কাপড়ের বিশাল সমাহার। উপরের তলাগুলোতে এবং মার্কেটের সামনে রয়েছে খুচরা দোকান। এখান থেকে অনেকটা সস্তা দরে কাপড় কেনা যায়। অনেক দূর থেকে যে কারণেই ক্রেতারা এই মার্কেটে অসেন। কিন্তু দাম বাড়ায় মার্কেটটিতে অনেকটা ক্রেতা শূন্য দেখা যায়।

চায়না মার্কেটে মিম ফেব্রিক্স এর স্বত্ত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর আলম জানান, আমদানিকারকরা বলছেন, চীন থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ আছে। সেই অজুহাতে তারা সিন্ডিকেট করে কাপড়ের দাম বাড়িয়েছেন। তারা বলছেন, আমদানি বন্ধ, কিন্তু আমদানি বন্ধ থাকলে পণ্যের দাম বাড়ার কোন যুক্তি খুঁজে পাই না। কারণ যে পণ্যগুলো তারা এখন আমাদেরকে দিচ্ছেন সেগুলো করোনা ভাইরাস আসার আগে আমদানি করা। এমন নয় যে, সেগুলো আমদানি খরচ বাড়ার কারণে দাম বেড়েছে। তারা শুধু মাত্র করোনার অজুহাতে আগের আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন। অতিরিক্ত লাভের আশায় তারা গুদামে পণ্য মজুত করে রেখেছেন। চাহিদা অনুযায়ী সেগুলোর দাম বাড়াবে এটা তাদের পূর্ব পরিকল্পনা। কিন্তু দাম বাড়ানোর কারণে আমরা অল্প করে কাপড় নিচ্ছি। এ কারণে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী কাপড় দিতে পারছি না। ফলে ক্রেতারা দোকানে আর আসছে না। এমনিতেই ব্যবসার মন্দা অবস্থা। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ব্যবসা ছেড়ে পথে বসতে হবে। তিনি বলেন, যে কাপড় আগে ৭৫ টাকা গজে কিনেছি সেগুলো এখন কিনতে হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়। যা খুচরা বিক্রি করতে হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। অথচ আগে ক্রেতারা এই কাপড়গুলো ১০০ টাকায় ক্রয় করতে পারতো।

এ হাকিম ট্রেডার্সের মালিক জাবেদ হাকিম বলেন, মানভেদে সব ধরনের পণ্যের দাম অন্তত ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে গেছে। বাজারে কাস্টমার আসছেন। কিন্তু তাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দিতে পারছি না। সমস্যা হলো, আমদানিকারকরা এখন আগের মতো করে পণ্য আনতে পারছেন না। তবে শুনেছি আগামী ৪-৫ দিনের মধ্যে এ অবস্থা আর থাকবে না। এমবি ট্রেডিংয়ের বিক্রেতা মিন্টু বলেন, ব্যবসার অবস্থা এমনিতেই ভালো না। আবার করোনার কারণে সামনে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। ব্যবসায়ীরা হতাশার মধ্যে রয়েছে।

এদিকে, চায়না থেকে দেশে আমদানি করা হয় প্রচুর পরিমাণ মেশিনারিজ পণ্য ও পার্টস। নবাবপুর এলাকার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে এসব মেশিনারিজ পণ্যের দোকান। এখানে পাওয়া যায় শিল্প-কারখানার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। তবে এখানকার কয়েকজন ব্যবসায়ী দাবি করছেন, মেশিনারিজ পণ্যে করোনার কোন প্রভাব পড়েনি। মক্কা টিউরস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর মালিক আবদুল আওয়াল বলেন, কেউ কেউ এই অজুহাতে দাম হয়তো কিছুটা বাড়াতে পারে। এটা স্বাভাবিক কারণ, সব জায়গাতে কিছু অতি মুনাফালোভী লোকজন থাকে। তারা সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু টাকা বেশি লাভ করে। তবে সার্বিকভাবে মেশিনারিজ পণ্যে দাম বাড়ানো হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, পণ্যেরও কোন সংকট নেই। পর্যাপ্ত পণ্য আগে আমদানি করা হয়েছে। চীনের কথা বাদ দিলেও অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি অব্যাহত রয়েছে। তবে নবাবপুরে ঢুকতেই আবদুল আলিম নামের একজন ক্রেতা অভিযোগ করেন, তার কাছ থেকে ইলেক্ট্রিক সেলাই মেশিনের ৩৫০ টাকা মূল্যের একটি পার্টসের দাম নেয়া হয়েছে ৪৫০ টাকা। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তাকে করোনা ভাইরাসের অজুহাত দেখানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

এছাড়া করোনার অজুহাতে ইলেক্ট্রনিক্স বা বৈদ্যুতিক পণ্যেও দাম বাড়ানো হয়েছে। ইলেক্ট্রনিক্স এর অধিকাংশ পণ্য আমদানি করা হয় চীন থেকে। বৈদ্যুতিক বাল্ব, সকেট, হোল্ডার ও তারসহ সব পণ্যের দাম বেড়েছে। নবাবপুর ও চকবাজারের বেশ কয়েকটি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা ভাইরাসের অজুহাতে ইলেকট্রনিক্স এর সব পণ্যের দাম প্রায় ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। চকবাজারে রয়েছে কসমেটিক্স ও শিশুদের খেলনা জাতীয় পণ্যের বিশাল সমাহার। যা আমদানি হয় চায়না থেকে। চকবাজারের মদিনা আশিক টাওয়ার, মরিয়ম প্লাজা, আফতাব প্লাজাসহ বেশ কয়েকটি মার্কেটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খেলনা জাতীয় পণ্যে দাম বেড়েছে অন্তত ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। তাবাসসুম ইউনিভার্সাল এর স্বত্বাধীকারী মনির হোসনে বলেন, করোনা ভাইরাসের বিষয়টি সামনে আসার পর থেকে সব পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। তিনি বলেন, ২৫০ টাকার খেলনা এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়। কয়েকজন ক্রেতা জানান, করোনার অজুহাতে বিক্রেতারা ইচ্ছেমতো দাম চাচ্ছেন। ২০০ টাকার খেলনার দাম চাচ্ছেন ৫০০ টাকা। তারা দামও কমাতে চান না। দুলাল নামের একজন ব্যবসায়ী পাইকারি ক্রয়ের জন্য নরসিংদী থেকে চকবাজারে এসেছেন। তিনি বলেন, আগের তুলনায় অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। বেশি দামে কিনে বেশি দামেই বিক্রি করতে হবে। কারণ আমাদের তো লাভ করতে হবে। তবে অনেকে বেশি দাম শুনে কিনতে চান না। এতে আমাদের ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=214129