১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১:২৫

মানবপাচারকারীদের তৎপরতা থেমে নেই রোহিঙ্গাবাহী ট্রলারডুবির ঘটনায় ১৯ দালালের বিরুদ্ধে মামলা

বঙ্গোপসাগরে মালয়েশিয়াগামী ট্রলারডুবির ঘটনায় ১৯ জন মানবপাচারকারী দালালের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকাল বুধবার সকালে কোস্টগার্ড কর্মকর্তা এস এম ইসলাম বাদি হয়ে টেকনাফ থানায় এ মামলা দায়ের করেন। মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত আটক চারজনসহ আট দালালকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আটক দালালরা হচ্ছেÑ টেকনাফের নোয়াখালীপাড়ার হাসান আলীর ছেলে সৈয়দ আলম (২৮), আব্দুছ ছালামের ছেলে মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ (৩০), রশিদ আহমদের ছেলে মোহাম্মদ করিম (৪৯), উলা মিয়ার ছেলে ফয়েজ আহমদ (৫০), জুম্মাপাড়ার মোহাম্মদ আজমের ছেলে সাদ্দাম হোসেন (২০), মমতাজ মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ রফিক (২৬), রাজারপাড়ার মোস্তাক আহমদের ছেলে হুমায়ুন কবির (২০) এবং উখিয়ার বালুখালী ১০ নম্বর ক্যাম্পের কবির হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ ওসমান। সেন্টমার্টিন থেকে আরও এক রোহিঙ্গাকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেছেন নৌবাহিনীর সদস্যরা। উদ্ধার হওয়া ৪৬ রোহিঙ্গা নারীদের বেশির ভাগই বলছেন দালালের সহযোগিতায় বিয়ের উদ্দেশ্যে তারা মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন।

ট্রলারডুবিতে ১৫ মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনায় সেন্টমার্টিন থেকে আব্দুল্লাহ নামে আরও এক রোহিঙ্গাকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল সকাল ৭টায় সেন্টমার্টিন থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া ১৫ মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। আর জীবিত উদ্ধার ৭৩ জনের মধ্যে ৬৯ জন রোহিঙ্গাকে টেকনাফ থানা হেফাজতে রাখা হয়েছে। তার মধ্যে ৪৬ জন নারী। তাদের বেশির ভাগই তরুণী। তাদের অনেকের বিয়ে ঠিক হয়েছে মালয়েশিয়াতে অবস্থানরত রোহিঙ্গা যুবকদের সাথে।

দুর্ঘটনার শিকার ট্রলার থেকে জীবিত উদ্ধার হওয়া কুতুপালংক রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রাজুমা আকতার (১৭) জানান, মালয়েশিয়াতে অবস্থানরত এক রোহিঙ্গা যুবকের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। পাসপোর্ট করার কোনো সুযোগ না থাকায় স্বামী তাকে সাগর পথে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য প্রথম দফায় দালালদের ৩০ হাজার টাকা দেয়া হয়।

টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের সাফিয়া বেগম জানান, তার বিয়ে হয়েছে ১০ বছর আগে, কিন্তু গত সাত বছর ধরে স্বামী মালয়েশিয়াতে থাকেন। আট বছরের এক মেয়েকে নিয়ে মালয়েশিয়া নিয়ে যাচ্ছিল স্বামী। ট্রলার দুর্ঘটনায় নিজে প্রাণে বাঁচলেও আমার মেয়েটি বাঁচাতে পারিনি। এক ননদও হারিয়েছি আমি। জানতামনা, ছোট একটি ট্রলারে গাদাগাদি করে এত লোক ওঠানো হবে সেটা।

উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের নুর কাজল বলেন, দুই বছর আগে বিয়ে করে স্বামী মালয়েশিয়াতে চলে যায়। এখন আমাকেও সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য দালালদের মাধ্যমে সব কিছু ঠিক করে আমাকে জানায়। স্বামীর কথায় আমি বাধ্য হয়ে ট্রলারে উঠেছি মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য।

বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সেন্টমার্টিন স্টেশন কমান্ডার লে. এস এম জাহিদুল ইসলাম জানান, অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলারডুবির ঘটনায় দ্বিতীয় দিনের মতো উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড সদস্যরা। সেন্টমার্টিনের স্থলভাগ থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় আরও এক রোহিঙ্গা যুবককে উদ্ধার করা হয়েছে। তাকে সেন্টমার্টিন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ জানান, উদ্ধার হওয়া ১৫ মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে ১৯ দালালের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে এ পর্যন্ত আট দালালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশ পেলে উদ্ধার হওয়া ৭২ জন রোহিঙ্গাকে যাচাই-বাছাই শেষে সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হবে।

রোহিঙ্গাদের দুর্দশার বর্ণনা : ট্রলারডুবির ঘটনায় জীবিত উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা দুর্ঘটনার লোমহর্ষক কাহিনী বর্ণনা করেছেন। উখিয়া উপজেলার কুতুপালংক রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নারী মজুমা (২২) জানান, স্থানীয় দালাল ও ক্যাম্পের রোহিঙ্গা দালালরা মিলে মানবপাচারে সক্রিয় রয়েছে। আমার স্বামী মালয়েশিয়াতে বসবাস করে। সে আমাকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছিল। স্থানীয় যে দালালের মাধ্যমে আমাদের সাগর পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা হয়েছে, দালাল চক্রের সদস্যরা পাঁচদিন আগেই আমাদেরকে ক্যাম্প থেকে বের করে তাদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে যায়। বাহারছড়া এলাকায় পাহাড়ের কাছে একটি বাড়িতে আমাদের জমায়েত করা হয়। পরে সোমবার নোয়াখালীপাড়া এলাকা থেকে আমাদের ট্রলারে উঠানো হয়।

মাজুমা আরও জানান, ছোট একটি ট্রলারে আমাদের উঠানো হয়। ট্রলারে আমাদের মাছ রাখার কোল্ডস্টোরে ঢুকিয়ে ওপর থেকে ছিদ্র করা ঢাকনা চেপে দিয়ে ঢাকনার ওপর আরও যাত্রী বসানো হয়। আমরা একজনের গায়ের ওপর আরেকজন এভাবে বসেছিলাম। শুরু থেকে আমরা এ অবস্থা দেখে কান্নাকাটি করলে ট্রলারের মাঝি আমাদের বারবার চুপ থাকতে বলেন।

উদ্ধার হওয়া বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা যুবতী কুলসুমা আকতার (১৭) জানান, মালয়েশিয়াতে আমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা মিলে আমাকে জোর করে ট্রলারে মালয়েশিয়া যেতে বাধ্য করেছেন। দালালরা গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ক্যাম্পে সিএনজি পাঠিয়ে আমাকেসহ আরও কয়েকজন নিয়ে যায়। তারপর আমাদের নোয়াখালীপাড়া এলাকার একটি বাড়িতে রাখা হয়। সেখানে তারা সকাল সন্ধ্যায় মাত্র একবেলা খাবার দিত। পরে গত সোমবার রাতে একটি বোটে তুলে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে।

এ দিকে উন্নত জীবনযাপনের লোভে পড়ে প্রলুব্ধ হয়ে পাচার ও প্রতারণার শিকারে পরিণত হয়েছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষে জানানো হয়েছে, মানব পাচার রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সজাগ রয়েছে। অপর দিকে প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় রয়েছে এসব দালাল চক্রের সদস্যরা। তারা অসহায় রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে ট্রলারে চেপে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমাতে আগ্রহী করে তুলছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা-ঢল শুরু হলে ওই বছরের শেষ দিকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা সমুদ্রপথে ভিনদেশে পাড়ি দিতে প্রস্তুতি নেয়। পথে দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে ট্রলার বা নৌকাডুবিতে প্রাণ গেছে অনেকের। এরপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে অবৈধ পথে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার জন্য দালালরা এখন টার্গেট করছে উখিয়া ও টেকনাফে বসতি স্থাপন করা রোহিঙ্গাদের। বর্তমানে শীত মওসুমে সাগর শান্ত থাকায় ‘টেকনাফ টু মালয়েশিয়া’য় পাচার হচ্ছে সাগরপথে। সমুদ্রপথে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী নাগরিকরা কোনো কোনো সময় পৌঁছেও যাচ্ছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশে। আবার প্রতারণার শিকার হয়ে পাচার
কারীদের হাতে জীবনও দিতে হচ্ছে এসব নিরীহ মানুষকে। বিদেশে পৌঁছে দেয়ার নামে সঙ্ঘবদ্ধ দালালরা টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে ট্রলারে করে সাগরের মাঝপথে দু-এক রাত ঘুরিয়ে নামিয়ে দিচ্ছে দেশের ভেতরের কোনো দ্বীপে। আবার দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ইতঃপূর্বে অনেকের হয়েছে সলিলসমাধি। এরপরও থামছে না সমুদ্রপথে বিদেশে পাড়ি দেয়ার নামে মানব পাচার।

এই শীত মওসুমে সাগরপথে ট্রলারে চেপে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় এ পর্যন্ত প্রায় সাত শতাধিক মালয়েশিয়াগামীকে উদ্ধার করেছে টেকনাফে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা সবাই বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো থেকে খবর নিয়ে জানা যায়, অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দেয়া বেশির ভাগ যাত্রী হচ্ছেন নারী। কারণ দালালরা টার্গেট করছে রোহিঙ্গা সুন্দরী যুবতীদের। এই যুবতীরা মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রোহিঙ্গা যুবকদের সাথে বিয়ে করার জন্য দালাল চক্রের সহযোগিতা নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া অনেক বিবাহিত নারীও তাদের শিশু সন্তানসহ সেখানে স্বামীর কাছে যাওয়ার জন্য দালালদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন।

নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা কবির হোসেন বলেন, যারা দালালদের মাধ্যমে বাংলাদেশী পাসপোর্ট করাতে পেরেছেন তারা বাংলাদেশী সেজে আকাশপথে মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছেন। কিন্তু সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করা নিয়ে সরকারের কঠোর নজরদারি থাকায় অবৈধভাবে সাগরপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দালাল চক্রের সদস্যরা পুনরায় চালিয়ে যাচ্ছে মানব পাচার। এ চক্রের সদস্যরা প্রথমে কম টাকায় মালয়েশিয়া পৌঁছে দেয়ার কথা বললেও পরে সেখানে গিয়ে স্বজনদের হাতে পৌঁছিয়ে দেয়ার আগে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। টাকা দিতে ব্যর্থ হলে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের পথ বেছে নেয়। টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা ছালামত উল্লাহ জানান, সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচারকারী দালাল চক্রের সদস্যদের সাথে এ দেশের স্থানীয় কিছু লোকের যোগসাজশ রয়েছে।

টেকনাফ র্যা ব-১৫ সিপিসি-১ এর কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মির্জা শাহেদ মাহতাব বলেন, মানবপাচারকারী দালালরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অসহায় নাগরিকদের টার্গেট করে নতুন করে সাগরপথে মানবপাচারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের সেই অপচেষ্টা প্রতিরোধ করার জন্য অভিযান অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও বলেন, টেকনাফ উপকূল ব্যবহার করে যারা আবারো মানব পাচারের ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেই সব দালালকে নির্মূল করার জন্য র্যা ব সদস্যরা সদা প্রস্তুত রয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে টেকনাফের বাহারছড়ার নোয়াখালীপাড়া সাগর উপকূল হয়ে ১৩৮ জন যাত্রী নিয়ে অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় সেন্টমার্টিনের তিন নটিক্যাল মাইল দূরে পাথরের সাথে ধাক্কা লেগে পানিতে ডুবে যায় বহনকারী ট্রলারটি। খবর পেয়ে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার অভিযান শুরু করে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/480083/