১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, বুধবার, ১২:১২

সেন্টমার্টিনে ট্রলারডুবিতে ১৭ রোহিঙ্গার মৃত্যু

কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালালচক্র

সেন্টমার্টিন দ্বীপের ছেরাদিয়ার কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরে রোহিঙ্গাদের বহনকারী একটি ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সর্বশেষ গতকাল বিকেল পর্যন্ত ১৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৬২ জনকে। নিখোঁজ রয়েছে এখনো অর্ধশতাধিক। উদ্ধার অভিযানে চালিয়েছে দু’টি হেলিকপ্টার, নৌবাহিনীর ডুবুরি দল, কোস্ট গার্ডের উদ্ধারকারী টিম, বিজিবি, পুলিশসহ উদ্ধারকর্মীরা।

স্থানীয় চেয়ারম্যান নুর আহমদ জানান, ২৫টি স্পিড বোট, ৫টি যাত্রীবাহী ট্রলার, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও কয়েশ’ স্থানীয় লোকজন উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে ৯০ জন মহিলা ও বিভিন্ন বয়সের ৮ জন শিশু রয়েছে। জানা গেছে এসব রোহিঙ্গাদের মালয়শিয়ায় পাচারের সাথে জড়িত একটি দালাল চক্র হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।

কোস্টগার্ড কন্টিনজেন্ট কমান্ডার শফিকুল ইসলাম জানান, বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। বিকেল ৪টার পরে উদ্ধারকৃতদের সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফে নিয়ে আসা হয়। জীবিতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।

উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা জানান, তাদেরকে টেকনাফ বাহারছড়া নোয়াখালী এলাকা থেকে দালালরা মালয়েশিয়া নেয়ার কথা বলে ট্রলারে তুলে। তাদের সাথে ওই ট্রলারে ১২৫ জন ছিল। রাত সাড়ে তিনটার দিকে ছেরা দ্বীপের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে ট্রলার ডুবির ঘটনাটি ঘটে।

সেন্টমার্টিনের জেলে বাট্টু মিয়া জানান, রাত সাড়ে তিনটার দিকে ছেরাদিয়া প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে গাইট্টাবনিয়ায় পাথরের সাথে ধাক্কা লাগে একটি ট্রলার ডুবির ঘটনা করলে তিনি সেখানে গিয়ে প্রথমে উদ্ধার অভিযান চালান। পরে খবর দিলে স্থানীয় চেয়ারম্যান, কোস্টগার্ড এবং নৌ বাহিনী সেখানে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন।

গতকাল দুপুরে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন সেন্টমার্টিনের অদূরে ট্রলার ডুবির খবর জানিয়ে সেখানে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী এবং দুটি হেলিকপ্টারসহ স্থানীয় লোকজন উদ্ধার তৎপরতার খবর জানান।

আইনের কঠোরতা ও প্রশাসনের কড়াকড়ির মাঝেও থেমে নেই মানবপাচার। কৌশল ও ঘাট পাল্টিয়ে পাচার কাজ অব্যাহত রেখেছে দালালচক্র। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের স্বপ্ন দেখিয়ে সাগর পথে পাঠিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন দেশে। দীর্ঘদিন ঘাপটি মেরে থাকা পাচারকারীরা আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সেন্টমার্টিনের ৬ জনের একটি দালালচক্রের সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। প্রাথমিকভাবে ২ জনের নাম ধরে বিস্তারিত তথ্যের অনুসন্ধান করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়া পাচারের কাজে জড়িত রয়েছে কিছু রোহিঙ্গা মাঝি। স্থানীয় চিহ্নিত দালালচক্রের মাধ্যমে ক্যাম্প থেকে বের করে তারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে যায় নির্ধারিত জায়গায়। বিশেষ করে, রোহিঙ্গা যুবতীদের বিয়ে দেয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে।

টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ট্রলারে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাচ্ছিলেন ইছমত আরা নামের এক মহিলা। কিন্তু সেন্টমার্টিনের ছেঁড়াদ্বীপের কাছে পৌঁছালে তাদের ট্রলারটি ডুবে যায়। এতে ১৭ জনের প্রাণহানি হলেও সে বেঁচে যান। জীবিত ৬২ জনকে উদ্ধার করে নৌ-বাহিনী ও কোস্টগার্ড সদস্যরা সেন্টমার্টিন জেটিতে নিয়ে আসেন।
উদ্ধারপ্রাপ্তদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এস এম জাহিদুল ইসলাম জানান, ট্রলারটিতে থাকা অধিকাংশ মানুষই টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গা। এরা সবাই দালালদের মাধ্যমে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাচ্ছিল, বলে তিনি জানান। তিনি আরো জানান, নিমজ্জিত ট্রলারটির ভেতরে আরো মানুষ থেকে থাকতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।

লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জাহিদুল ইসলাম বলছেন, জীবিত উদ্ধারপ্রাপ্তদের সাথে কথা বলে দুজন দালালের তথ্যও পেয়েছেন তারা। তাদেরকে খোঁজা হচ্ছে। উদ্ধার অভিযানের পাশাপাশি এ নিয়েও তদন্ত চলছে। এদিকে জীবিত উদ্ধার পাওয়া কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, তাদের আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে দালাল চক্র প্রতিজন মালয়েশিয়া পৌঁছানোর জন্য এক লাখ টাকা করে চুক্তি করে। নগদ ৫০ হাজার বা ৩০ হাজার টাকা নিয়ে তাদেরকে ট্রলারে তুলে। এ হিসেবে ডুবে যাওয়া ওই ট্রলারের ১২৫ জন যাত্রী থেকে দলদল চক্র হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। এছাড়াও অভিযোগ উঠেছে ওই ট্রলারটির সাগর পারি দেবার মত ফিটনস ছিল না।

কিছু স্বার্থপর দালাল চক্র দেশের মান সম্মান ডুবিয়ে রোহিঙ্গা পাচারে জড়িত রয়েছে। এরা একদিকে যেমন বাংলাদেশের মানসম্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের দাস বানিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করছে অথবা সাগরে ডুবিয়ে মারছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনা নির্যাতনে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় নাফ নদী অতবা বঙ্গোপসাগরে ডুবে মারা পড়েছিল হাজার হাজার রোহিঙ্গা। এখন নানা মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে রোহিঙ্গারা কি এভাবেই হারিয়ে যাবে কালের আবর্তে?

https://www.dailyinqilab.com/article/267602/