১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, বুধবার, ১১:৫৯

যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ: ব্যয় বাড়ছে ৭ হাজার কোটি টাকা

তিন বছরে অগ্রগতি আর্থিক ২.২৫ ও বাস্তব ৮.৯৫ শতাংশ * বিভিন্ন খাতের খরচ নিয়ে প্রশ্ন পরিকল্পনা কমিশনের * বাস্তবায়ন দেরি হলে অর্থের অপচয়, দুর্নীতি ও অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়- ড. সালেহ উদ্দিন

যমুনা নদীর ওপর ‘বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ’ প্রকল্পে তিন বছরে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ২ দশমিক ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে খরচ হয়েছে ২১৯ কোটি ১২ লাখ টাকা।

একই সময়ে বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এ অবস্থায় প্রকল্প ব্যয় বাড়ছে ৭ হাজার ৭২ কোটি টাকা। ফলে ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা থেকে মোট প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৬ হাজার ৮০৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। শুধু প্রকল্প ব্যয় নয়, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দুই বছর বেড়ে যাচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদও।

প্রকল্পের আওতায় জাদুঘর নির্মাণ, পরামর্শক ব্যয় অতিরিক্ত ধরাসহ বিভিন্ন খাতের ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তুলে ব্যাখ্যা চাইবে পরিকল্পনা কমিশন। আগামী রোববার অনুষ্ঠেয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভায় এ ব্যাখ্যা চাওয়া হবে বলে জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হলে একদিকে সরকারি অর্থের অপচয় হয়, অন্যদিকে প্রকল্প থেকে সঠিক সময়ে সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় জাতি। সেই সঙ্গে অনিয়ম-দুর্নীতিরও সুযোগ তৈরি হয়।

তবে এটিকে ব্যয় বৃদ্ধি বলতে নারাজ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, প্রথম পর্যায়ে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হলেও এখন দরপত্রের মূল্য অনুযায়ী প্রকৃত ব্যয় ধরা হচ্ছে। এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

প্রকল্পটি যেখানে বাস্তবায়নই শুরু হয়নি সেখানে ব্যয় বৃদ্ধির প্রশ্ন আসে না। তিন আরও বলেন, প্রকল্পটির বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে সেটি যারা প্রস্তাবটি তৈরি করেছে তারা নিশ্চয়ই হিসাব করে করেছে। তারপরও পরিকল্পনা কমিশন যেসব সুপারিশ দেবে সেসব প্রতিপালন করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা জাদুঘর নয়, যেকোনো বড় প্রকল্পে আর্কাইভ করা হয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু সেতুতে রয়েছে।

সুতরাং রেল সেতুর মতো বড় প্রকল্পে আর্কাইভস থাকাটা স্বাভাবিক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সোমবার যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামো সংক্রান্ত প্রকল্পগুলো এত বেশি সংকট ও কালক্ষেপণ করা হয় যে, এর মেয়াদ বাড়ে এবং ব্যয়ও বেড়ে যায়। এর পেছনে দুর্বল বাস্তবায়ন ব্যবস্থাপনাসহ অনেক কিছুই কাজ করে।

এক্ষেত্রে অনেক অর্থ অপচয় হয়, যার ফলে দুর্নীতি ও অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়। এ প্রকল্পের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনে যেসব প্রশ্ন তুলবে সেগুলোর যদি উত্তর না মেলে তাহলে অনুমোদন দেয়া ঠিক হবে না। পরিকল্পনা কমিশনকে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। তিন বছর আগের প্রকল্পে যদি এখনও কাজই শুরু না হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্ব। এর বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। তা না হলে জনগণের ওপর দিন দিন ঋণের আর্থিক বোঝা চাপতে থাকবে।

রোববার অনুষ্ঠেয় পিইসি সভার জন্য তৈরি করা কার্যপত্র অনুযায়ী, প্রকল্পটি সংশোধনের কারণ হিসেবে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য হচ্ছে- প্রকল্পের আওতাভুক্ত নির্মাণ কাজের দরপত্রের প্যাকেজ-১ ও প্যাকেজ-২ এর মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া বেড়েছে সিডি ভ্যাটের হার ও পরিমাণ। নতুন অঙ্গ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণ, ভূমি ও অন্যান্য ফ্যাসিলিটি ভাড়ার সংস্থান।

এছাড়া ব্যয় বেড়েছে জাপান-বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নিদর্শন হিসেবে ব্রিজ এলাকায় জাদুঘর নির্মাণ, প্রাইস ও ফিজিক্যাল কন্টিনজেন্সির। আর মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন ইউনিটে জনবল ও অন্যান্য খাতে ব্যয় বেড়ে যাবে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার, সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন ওয়ার্কস (প্যাকেজ-৩) এবং ব্যাংক চার্জ বাবদ ব্যয়ও বাড়বে।

কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়, বাস্তবতার নিরিখে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা পরামর্শক খাতে ব্যয় হ্রাস এবং বিশদ নকশা ও সুপারভিশন পরামর্শক খাতে ব্যয় কমে যাওয়ায় প্রকল্পটির প্রথম সংশোধন করা হচ্ছে। কমিশন বলেছে, সংশোধিত প্রকল্পে ডিজাইন ও সুপারভিশন পরামর্শক খাতে সরকারি তহবিল হতে ২১২ কোটি টাকাসহ মোট ৮১৭ কোটি ৮১ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। আবার সরকারি অর্থে ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট পরামর্শক বাবদ ৫২ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট পরামর্শকের কাজ কি? এছাড়া দেশি-বিদেশি ডিজাইন ও সুপারভিশন পরামর্শক থাকার পরও ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট পরামর্শকের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা- তা সভাকে ব্যাখ্যা করতে হবে।

কার্যপত্রে বলা হয়েছে, সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবে জমি অধিগ্রহণ, জমি ব্যবহার ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বাবদ মোট ৩৪৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি অনুমোদিত মূল প্রকল্প প্রস্তাবে ছিল না। এ জমি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের, যা সরকারি সংস্থা। এই ব্যয়ের বিষয়ে কোনো অব্যাহতি পাওয়া যাবে কিনা তা সভায় আলোচনা করা যেতে পারে।

প্রকল্পের কাজের বেশিরভাগ আইটেমের বিশদ নকশা প্রণীত হয়েছে। এ অবস্থায় প্রাইস ও ফিজিক্যাল কন্টিনজেন্সি বাবদ ১২২ কোটি টাকা অতিরিক্ত সংস্থানের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা তা পুনঃপর্যালোচনা করা যেতে পারে। প্রকল্প প্রস্তাবে প্যাকেজভিত্তিক ব্যয় ও প্রাইস এস্কেলেশন ও ফিজিক্যাল কন্টিনজেন্সির সংস্থান রাখা হয়েছে। আবার মোটের ওপর প্রাইস ও ফিজিক্যাল কন্টিনজেন্সির সংস্থান আছে।

এ বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রয়োজন। একই ধরনের কাজের জন্য দুই জায়গায় বরাদ্দের প্রয়োজন নেই। আদার ইমপুট অব পিআইইউ খাতে বিভিন্ন অঙ্গের পরিমাণ বৃদ্ধি যৌক্তিকতা বোধগম্য নয়। এ খাতে ১২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অনুমোদিত প্রস্তাবে ছিল না। এর ব্যাখ্যা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে এ খাতের আওতায় বিশেষ ব্যয় ৪ কোটি টাকা বিষয়েও ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

সার্বিকভাবে পরামর্শক খাতে ২৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে, এর কারণ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এছাড়া অনারিয়াম অব ইমপ্লয়ারসের জন্য ১ কোটি টাকা এবং অনারিয়াম ফর আদারস খাতে ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রকল্পটি তিন বছরে কেন বাস্তবায়নে যেতে পারেনি সেই কারণটি আগে খতিয়ে দেখা উচিত। এক্ষেত্রে যাদের অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

তা না হলে দেখা যাবে আবারও সংশোধনের পর মেয়াদ ও ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। বিভিন্ন খাতের ব্যয় নিয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা না পেলে অনুমোদন বন্ধ করতে হবে। কেননা এই টাকা জনগণের কথাটা সবাইকে মনে রাখতে হবে। শেষ পর্যন্ত এই অর্থের বোঝা জনগণকে টানতে হবে।

বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ প্রকল্প যথাসময়ে শেষ হয় না। এটা কমিয়ে আনতে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। সময়মতো প্রকল্প শেষ না হলে সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বেড়ে যায়। পাশাপাশি প্রকল্প থেকে কাক্সিক্ষত সুফল আসে না। এটা ঠিক নয়।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিক কারণ ছাড়া প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোটা ঠিক নয়। এ প্রকল্পে জাদুঘর নির্মাণ, বিশেষ খাতে ব্যয় এসব বিষয় পরিষ্কার নয়।

প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরালে ডুয়েলগেজ একক রেল সেতু নির্মাণের জন্য এডিবির অর্থায়নে একটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়।

পরবর্তীতে জাপান কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় আরও একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। পরে জাপান-বাংলাদেশ কম্প্রিহেনসিভ পার্টনারশিপের আওতায় যৌথ ঘোষণায় ৫টি প্রকল্পের মধ্যে যমুনা রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১৪ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফরের এ প্রকল্পে অর্থায়নের আলোচনা হয়।

জাপানের সমীক্ষায় ট্রাস্ট ব্রিজ বা হেবি লোডেড ব্রিজ নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। এক্ষেত্রে স্টিল পাইপ সিট পাইল ফাউন্ডেশন এবং স্টিলের গার্ডার ব্যবহার করে ব্রিজটি নির্মাণের পরিকল্পনা হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে মোট ব্যয় ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ধরে ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ২ হাজার ৯ কোটি ৭৪ লাখ এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে ৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা ব্যয় করার কথা ছিল।

এ সময় মেয়াদ ধরা হয় ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এখন মেয়াদ বাড়িয়ে করা হচ্ছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।

আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রায় ৩০০ মিটার উজানে যমুনা নদীর ওপর দিয়ে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইনসহ ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার একটি রেল সেতু নির্মাণের জন্য দুটি প্যাকেজের দরপত্র গত ৯ জানুয়ারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন দিয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/277321/