৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, শনিবার, ১২:১১

জিবি সদস্য ও শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাটের চক্র

আর্থিক দিকে নজর বেশি, উপেক্ষিত শিক্ষার্থী স্বার্থ * পদ দখলে মারামারি-হানাহানি * অসহায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় * এসএমসি ও জিবির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন

দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও লুটপাটের চক্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একশ্রেণির শিক্ষক ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্য গড়ে তুলেছেন ওই চক্র। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রমের চেয়ে আর্থিক দিকে বেশি নজর তাদের। কোথাও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের আড়ালে আবার কোথাও অনিয়মের মাধ্যমে লুট হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা বোর্ড ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রণীত বেসরকারি স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি (এসএমসি) ও গভর্নিং বডি (জিবি) পরিচালনা বিধিমালায় সভাপতিসহ পর্ষদকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি কর্মকাণ্ডের দায়ভার থেকে তাদের দেয়া হয়েছে মুক্তি। যে কারণে বৈধ-অবৈধ সব ধরনের নির্দেশ মানতে হয় প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে। কমিটির হাতেই চাকরির ভাগ্য রাখায় সবই শুনতে হয় প্রধান শিক্ষক, সুপার ও অধ্যক্ষকে।

অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানপ্রধান স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা হওয়ায় সভাপতি বা পর্ষদের অবৈধ ও অন্যায় নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আইনগতভাবে ফেঁসে যাচ্ছেন। আর কোনো কারণে প্রতিবাদ করলে চাকরিচ্যুত হওয়ার পাশাপাশি অপমান-অপদস্থ হতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে উভয় সংকটে আছেন তারা। অবশ্য কমিটির লোকজনকে ব্যবহার করে একশ্রেণির প্রতিষ্ঠানপ্রধানের বিরুদ্ধেও নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল পরিচালনা কমিটির কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে সরব। গত বছরের ২৫ এপ্রিল বাংলা একাডেমিতে শিক্ষকদের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণে ব্যবস্থাপনা কমিটির অশিক্ষিতরা শিক্ষকদের ওপর বেশি কর্তৃত্ব ফলান। শিক্ষকদের সম্মান দেয়ার মতো শিক্ষিত লোক ব্যবস্থাপনা কমিটিতে নিযুক্ত করার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার।

তিনি আরও বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, আমরা যারা দায়িত্বে আছি তাদের কেউ কেউ স্কুল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অপরাধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরিচালনা কমিটির দুর্নীতিবাজ সভাপতি ও সদস্যরা নানা রকম উন্নয়ন, কেনাকাটা ও শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের কাজকে প্রাধান্য দেন। বিপরীতে শিক্ষার মান কিংবা শিক্ষার্থীদের সমস্যার প্রতি তাদের নজর দিতে দেখা যায় খুব কম। বরং শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বাবদ আদায় করা অর্থ অযথা বৈঠক করে সম্মানী গ্রহণসহ নানাভাবে লুটপাটের অভিযোগ উঠছে প্রায়ই।

ভর্তি বাণিজ্য ও একাডেমিক ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগও কম। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানে দলাদলি করে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট, শিক্ষক-কর্মচারী-অভিভাবকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই।

আরও আছে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের অভিযোগ। বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, অনিয়মকারী সভাপতি ও সদস্যদের কমিটি থেকে বাদ দেয়াই এখন পর্যন্ত বড় শাস্তি। এজন্য ফৌজদারি বিচারের মুখোমুখি করার দৃষ্টান্ত আছে কমই। কমিটির প্রবিধানমালায়ও তাদের ধরার সুযোগ নেই বললেই চলে।

বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিবাজরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। যেমন- রাজধানীর উইলস লিটল স্কুলের সভাপতির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠায় তদন্ত হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। তবু ওই প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকেই ফের সভাপতি করেছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড।

সম্প্রতি রাজধানীর মতিঝিল মডেল স্কুল ও কলেজের সভাপতির নানা অন্যায়-অনিয়ম ও লুটপাটের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন শিক্ষকরা। আন্দোলনের মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শেষ পর্যন্ত ওই সভাপতিকে সরিয়ে দেয়। শিক্ষকদের অভিযোগ, ৩ বছরে স্কুলের অন্তত ৩৫ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের সাবেক একাধিক কমিটির কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে ভর্তি বাণিজ্য ও সরকারের বিধিবিধান লঙ্ঘন করে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে তা প্রমাণিতও হয়েছে। শুধু এই দুই প্রতিষ্ঠানই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির বিরুদ্ধে এভাবে অহরহ অভিযোগ উঠছে।

প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাটের মজা পেয়ে অনেককেই কমিটিতে জায়গা করার ক্ষেত্রে রীতিমতো মারামারি-হানাহানি আর রক্তারক্তি করতেও দেখা যাচ্ছে।

যুগান্তরের আর্কাইভ ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ২১ অক্টোবর ঝালকাঠির নথুল্লাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন নিয়ে সংঘর্ষে ৪ জন আহত হন। ২৫ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার জয়াগ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র হামলা-সংঘর্ষে চারজন আহত হয়েছেন।

২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলায় চরচান্দা উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে পুলিশসহ অন্তত ১৩ জন আহত হন। ২০১৩ সালের ২৩ অক্টোবর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার রানীরবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন ঘিরে সংঘর্ষে একজন নিহত ও ৭ জন আহত হন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কমিটির প্রত্যেক লুটপাটে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিবাজরা জড়িত থাকে। উল্লিখিত মতিঝিল মডেল স্কুল ও কলেজের ক্ষেত্রেও সিনিয়র কয়েক শিক্ষকের বিরুদ্ধে আছে অভিযোগের তীর।

পুরান ঢাকার আরেকটি মাস্টার্স পর্যায়ের কলেজে জমি কেনার নামে জাল দলিল, বিভিন্ন কেনাকাটায় ভুয়া ভাউচার, মিটিংয়ের সম্মানীসহ নানা নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক সংস্থা তদন্ত করছে। ওই ঘটনায়ও অভ্যন্তরীণ ৪-৫ জনের একটি চক্র জিবির চেয়ারম্যান এবং দুর্নীতিবাজ সদস্যের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন।

আবার কোথাও কমিটির সঙ্গে দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষকদের লুটপাটে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ আছে। রাজধানীর দনিয়া কলেজে বিভিন্ন সময়ে ৪১ কোটি ৪০ লাখ ৯৪ হাজার টাকার অনিয়ম পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংস্থা পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ)।

ডিআইএর আরেক তদন্তে উঠে এসেছে যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ, রাজশাহী মসজিদ মিশন স্কুলে দুর্নীতি চিত্র। তদন্ত চলছে উইলস লিটল স্কুল ও কলেজের অনিয়মের অভিযোগ। এভাবে বছরে গড়ে দেড় হাজার প্রতিষ্ঠান তদন্তে যায় ডিআইএ।

আবার কোথাও শিক্ষকরাই কমিটির সদস্যদের নানান অনৈতিক সুবিধা দিয়ে বুঁদ করে রাখেন। তখন শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যসহ অন্যান্য অন্যায় ও লুটপাটের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকে কমিটি। উপেক্ষিত হয় শিক্ষার্থী স্বার্থ।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় জিবির ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ওই ঘটনায় অধ্যক্ষের সরাসরি পক্ষ নিয়েছিলেন জিবির সহসভাপতি রুহুল আমিন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিচালনা কমিটির দৌরাত্ম্যের কাছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও পর্যন্ত রীতিমতো অসহায়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দিয়েও তা বাস্তবায়ন করাতে পারছে না। রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজে সালাম খান নামে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে জাল সনদে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ বাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) তদন্তে প্রমাণিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই শিক্ষকের এমপিও বন্ধের পদক্ষেপ নেয়। অথচ এমন শিক্ষককে নিজস্ব তহবিল থেকে পুষছে প্রতিষ্ঠানটি।

দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহকারী প্রকৌশলীর পদ নেই। কিন্তু সালাম খানের এক ভাইকে প্রতিষ্ঠানে ওই পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ করা হয়েছে। স্বল্প বেতনের ওই কর্মচারী রাজধানী ও নিজ এলাকায় বহু কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন বলে জানা গেছে। ওই অর্থের উৎস নিয়ে আছে প্রশ্ন।

স্বাধীনতার পর থেকে ব্যক্তি উদ্যোগেই চলত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯৮০ সাল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। তখন মূল বেতনের ৫০ শতাংশ দিত সরকার। বর্তমানে শতভাগ বেতনই দিচ্ছে সরকার। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ১৯৭৭ সালে প্রথম প্রবিধানমালা করা হয়। ২০০৯ সালে সর্বশেষ এটি সংশোধন করা হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশে বর্তমানে এটি আরেক দফা সংশোধনের কাজ চলছে বলে জানান ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়াউল হক। বিদ্যমান বিধিতে বেতন-ভাতা প্রদান, শিক্ষক নিয়োগসহ এসএমসি ও জিবির ১৬টি দায়িত্ব পালনের বাধ্যবাধকতা আছে। তবে সরকার যেহেতু প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, নিয়োগ, বেতন প্রদানসহ সবই দিচ্ছে, তাই এখন কমিটির সেই ভূমিকা নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

শিক্ষক নেতা আসাদুল হক বলেন, প্রতিষ্ঠানে যে অপ্রীতিকর অবস্থা দেখা যাচ্ছে তা ইদানীংকালের সংস্কৃতি। আগে এ রকম ছিল না। সংসদ সদস্যরা সভাপতির দায়িত্বে থাকলে প্রতিষ্ঠান ভালো থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এ সংকট উত্তরণে ইউনেস্কোর ২০১৬ সালের প্রস্তাব সরকার বিবেচনা করতে পারে। এতে বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে থাকবেন প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ। অন্যরা হবেন উপদেষ্টা।

২০১৭ সালের জুন মাসে হাইকোর্ট এক রায়ে এসএমসি ও জিবিতে সংসদ সদস্যদের ইচ্ছামতো সভাপতি হওয়ার বিধান বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করেন। ফলে বর্তমানে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে রাজনীতিকরাই এসএমসি ও জিবির সভাপতির দায়িত্বে আছেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, নিয়মতান্ত্রিক পরিচালনার জন্য একটি পর্ষদের দরকার। কিন্তু পরিচালনা কমিটির বিরুদ্ধে যেভাবে দিনে দিনে অভিযোগ আসছে তাতে শিক্ষক-অভিভাবকরা জিম্মি হচ্ছেন বলেই মনে হচ্ছে। তারা সরকারের নির্দেশনা থোড়াই কেয়ার করছেন। কাঠামোতে সমস্যা নেই। সমস্যা ব্যক্তি পর্যায়ে। আত্মসাৎ থেকে শুরু করে নানা অন্যায় করছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেখার জন্য যেমন ইউজিসি আছে, তেমনি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য একটি তদারকি প্রতিষ্ঠান থাকা জরুরি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/275841