৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, শনিবার, ১১:৫৯

ব্রুনাইয়ের শ্রমবাজার

'দালাল' ধরতে গিয়ে চাপে হাইকমিশন

দালাল হিসেবে চিহ্নিত করে যাদের ফেরত পাঠানো হয়েছিল, দেশে ফিরে তারা অভিযোগ তুলেছেন- ব্রুনাইয়ের বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তারাই দুর্নীতিতে জড়িত। প্রবাসী কর্মীদের তারা নির্যাতন করছে। অভিযোগ তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চিঠি দিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়।

তবে হাইকমিশনের বক্তব্য, অভিযোগকারীরা মানব পাচারে জড়িত। তারা মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে হাইকমিশনকে চাপে ফেলে ব্রুনাইয়ে ফিরে ভিসা কেনাবেচার অবৈধ ব্যবসা চালুর পাঁয়তারা করছে। ভিসা কেনাবেচা চললে বন্ধ হবে ব্রুনাইয়ের শ্রমবাজার।

দূতাবাসের তথ্যানুযায়ী, গত দুই বছরে নিয়োগকারীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রুনাইয়ের বাংলাদেশ হাইকমিশন মাত্র আট হাজার ৪২৭ জন কর্মীর ভিসা সত্যায়িত করেছে। এ সময় ব্রুনাইয়ে গেছেন প্রায় ৩৪ হাজার বাংলাদেশি কর্মী। এ হিসাবে প্রায় ২৬ হাজার কর্মীকে ভুয়া নিয়োগপত্রে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ব্রুনাই নেওয়া হয়েছে। তারা কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিদেশ যাওয়ার খরচ তুলতে ব্রুনাইয়ে ভিক্ষাবৃত্তি, মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। এতে দেশটির শ্রমবাজার বাংলাদেশিদের জন্য বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

হাইকমিশনের তথ্য, সত্যায়ন ছাড়াই ভুয়া নিয়োগপত্রে যাদের ব্রুনাই নেওয়া হয়েছে, তাদের কাছ থেকে দালালরা কর্মীপ্রতি সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। এ হিসাবে বিমান ভাড়া ও অন্যান্য খরচ বাদে দালালরা কর্মীদের কাছ থেকে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই দালালদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিয়েছিল হাইকমিশন। তারাই এখন হাইকমিশনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে। বিদেশে থাকায় এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ সচিব সেলিম রেজার বক্তব্য জানা যায়নি।

গত ৩ জানুয়ারি পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে দেওয়া চিঠিতে ব্রুনাইয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মাহবুব হোসেন জানান, বাংলাদেশি নাগরিক মেহেদি হাসান বিজন 'ভিসা ব্যবসায়ী ও মানব পাচার চক্রের হোতা'- এ অভিযোগে গ্রেপ্তার হলে ব্রুনাই সরকার তাকে দেশে ফেরত পাঠায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মেহেদি হাসান বিজন ও চার সহযোগীর পাসপোর্ট বাতিল করেছে। দেশে ফিরে তারা হাইকমিশনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে চলেছেন। গত ১৫ জানুয়ারি আরেকটি চিঠিতেও একই অভিযোগ করা হয়।

তবে মেহেদি হাসানের দাবি, হাইকমিশনের কর্মকর্তারাই দুর্নীতিবাজ। প্রতিটি ভিসা সত্যায়নের জন্য ৫০০ ব্রুনাইয়াইন ডলার (৩০ হাজার টাকা) ঘুষ নেন। ঘুষ না পেলে কর্মীদের নির্যাতন করেন। তিনি সমকালকে বলেছেন, ২০১৮ সালে ৬৪টি ভিসা সত্যায়নের জন্য আবেদন করলে তার কাছে ঘুষ চাওয়া হয়। ঘুষ না দেওয়ায় পাসপোর্ট প্রত্যাহার করে গত বছরের অক্টোবরে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। পাসপোর্ট ফেরত পেতে তিনি আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

তবে হাইকমিশন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ করার বিষয়টির সঙ্গে তার সংশ্নিষ্টতা নেই বলে দাবি করেছেন মেহেদি হাসান বিজন। অবশ্য সমকালকে একটি সূত্র জানিয়েছে, বিজন এবং জনৈক সাংবাদিক দুদকে বেনামে হাইকমিশন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।

গত ৩ জানুয়ারি পাঠানো হাইকমিশনের চিঠিতে বলা হয়, মেহেদি হাসান শ্রমিক হিসেবে ব্রুনাইয়ে গেলেও পরে নামে-বেনামে ১০ থেকে ১৫টি কাগুজে প্রতিষ্ঠান খুলে বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার কর্মী নিয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ না থাকলেও 'কর্মসংস্থান ভিসা' তৈরি করে দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিক্রি করেছেন। তিনি ব্রুনাই থেকে কখনও দেশে টাকা না পাঠালেও গাজীপুরে একটি সিরামিক কোম্পানির ৩০ শতাংশ শেয়ারের মালিক হয়েছেন। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মেহেদি হাসান।

চিঠিতে মেহেদি হাসান বিজনের 'অপকর্মের' তালিকা দিয়ে বলা হয়, ২০১৮ সালে তিনি ১৩৫টি ভিসা সত্যায়নের জন্য আবেদন করেছিলেন। হাইকমিশন সরেজমিনে দেখে তার প্রতিষ্ঠানগুলো কাগুজে। সেখানে কোনো কাজ নেই। তাই সত্যায়ন করা হয়নি। তারপরও মেহেদি হাসান বিজন ব্রুনাইয়ে কর্মী নিয়ে যান। যারা কাজ না পেয়ে পরে হাইকমিশনে অভিযোগ করেন। হাইকমিশনের চিঠিতে এমন ২০ জন কর্মীর অভিযোগপত্র এবং মেহেদি হাসানের স্বীকারোক্তি সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

হাইকমিশনের চিঠিতে বলা হয়েছে, মেহেদি হাসান বিজন নিজেকে ব্রুনাই আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দাবি করেন। সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে দাবি করে হাইকমিশনের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে তিনি মালয়েশিয়ান নারী সারা বিন্তে ওয়াকিলকে দিয়ে হাইকমিশনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করান। পরে ওই নারী মামলা প্রত্যাহার করে দুঃখ প্রকাশ করেন। এর আগে শ্রম উইংয়ের অনুবাদক আবু নঈমের বাসায় হামলা করান মেহেদি হাসান। হাইকমিশনের প্রথম সচিব (শ্রম উইং) জিলাল হোসেনকে হুমকি দেন। তাদের বিরুদ্ধে দুদকে দুর্নীতি ও শ্রমিক নির্যাতনের অভিযোগ করা হয়। এতে বলা হয়, এ দু'জন প্রবাসী শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দেননি। তাদের অসহযোগিতার প্রতিবাদ করায় অনেক শ্রমিককে মানব পাচার ও চুরির মামলার আসামি হয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে। জিলাল হোসেন সমকালকে বলেছেন, তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ মিথ্যা। মানব পাচারে জড়িত থাকায় যাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে, তারাই দুদকে তার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করেছে।

তবে মেহেদি হাসানের পাল্টা অভিযোগ, আবু নঈম ভিসা সত্যায়নের জন্য ঘুষ দাবি করেছিলেন। এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আবু নঈম।

কর্মীদের কাজের নিশ্চয়তা, বেতন-ভাতাদি ও বীমা সুবিধা যাচাইয়ে ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে ব্রুনাইয়ে সত্যায়ন পদ্ধতি চালু হয়। এ পদ্ধতিতে ব্রুনাইয়ের কোনো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ দিতে চাইলে হাইকমিশন প্রতিষ্ঠানের অবস্থান সরেজমিনে যাচাই করে। আদৌ কর্মী নিয়োগ দেওয়ার সক্ষমতা, কাজ ও অন্যান্য সুবিধা রয়েছে কিনা খতিয়ে দেখে নিয়োগের আবেদন সত্যায়ন করে। সেই সত্যায়নের বিপরীতে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমআইটি) নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীকে ছাড়পত্র (স্মার্টকার্ড) দেয়। রিক্রুটিং এজেন্সি ছাড়পত্র পাওয়া কর্মীকে ব্রুনাই পাঠায়।

গত ১৫ জানুয়ারি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে চিঠিতে ব্রুনাইয়ের বাংলাদেশ হাইকমিশন জানায়, সেখানে কর্মী পাঠানোর নিয়ম মানা হচ্ছে না। ২০১৮ সালে ৪ হাজার ৫৫৮ কর্মীর নিয়োগপত্র সত্যায়িত করা হয়। কিন্তু ব্রুনাই ইমিগ্রেশনের তথ্য অনুযায়ী ওই বছর দেশটিতে ১৮ হাজার বাংলাদেশি কর্মীর ভিসা ইস্যু হয়েছে। ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৮৬৯টি নিয়োগপত্র সত্যায়িত করেছে হাইকমিশন। বিপরীতে কর্মী গিয়েছে ১৬ হাজার।

বিএমইটির মহাপরিচালক শামসুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, যে সময়ে ছাড়পত্র দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সে সময়ে তিনি দায়িত্বে ছিলেন না। তবে বিএমইটি হাইকমিশনের সত্যায়ন ছাড়া ছাড়পত্র দেয় না।

সত্যায়ন ছাড়া ছাড়পত্র না দেওয়ার দাবি করা হলেও হাইকমিশনের চিঠির সূত্রে জানা গেছে, মতিউর রহমান এসডিএন বিএইডি এবং ওমর এসডিএন বিএইডি নামের দুটি প্রতিষ্ঠান ২৪ ও ১৭ জন কর্মীর নিয়োগপত্রে সত্যায়ন চেয়ে আবেদন করে। কিন্তু সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠান দুটির নিয়োগের সক্ষমতা নেই। তাই আবেদন নামঞ্জুর করা হয়। কিন্তু পরে দেখা যায় দুই প্রতিষ্ঠান বিএমইটির কথিত ছাড়পত্র নিয়ে ব্রুনাইয়ে কর্মী নেয়। কর্মীরা চাকরি না পেয়ে মারধরের শিকার হয়ে হাইকমিশনে অভিযোগ করেন।

হাইকমিশনের তথ্য, মতিউর রহমান এসডিএন বিএইডির মালিক মেহেদি আনাম সাদ্দাম 'ভিসা ব্যবসায়ী ও মানব পাচার চক্রের হোতা' মেহেদি হাসান বিজনের ভাই। বিজনের অনুপস্থিতিতে সাদ্দাম ভিসা কেনাবেচা চালিয়ে যাচ্ছেন।

একই চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪৫০ জন কর্মীর কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছে হাইকমিশন। যাদের অধিকাংশের ভিসা, নিয়োগপত্র হাইকমিশনে সত্যায়ন করা হয়নি। সত্যায়িত নিয়োগপত্র ছাড়া 'বডি কন্টাক্ট'-এ কথিত স্মার্টকার্ড নিয়ে ব্রুনাই গিয়েছিলেন।

গত ৬ সেপ্টেম্বর হাইকমিশনে মেহেদি হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন নরসিংদীর রায়পুরার মাসুদ মিয়া (পাসপোর্ট নম্বর :বিএম ০৮৯৫৯৩৮)। তার অভিযোগ, ভালো বেতনে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে ব্রুনাই নেন মেহেদি হাসান। তার কাছ থেকে চার লাখ টাকা নেওয়া হয়। কিন্তু তাকে কম বেতনে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ দেওয়া হয়। তিনি কাজ করতে গিয়ে একটি আঙুল হারান ও দুটি আঙুল ভেঙে যায়। কিন্তু বীমার টাকা না দিয়ে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।

হাইকমিশনের চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি দালালদের দৌরাত্ম্য এবং অবৈধ কর্মীদের কারণে ভিসা দেওয়া কিছু দিন বন্ধ রাখে ব্রুনাই। হাইকমিশনের প্রতিশ্রুতিতে ভিসা দেওয়া শুরু করে। কিন্তু মানব পাচার বন্ধ না হলে দেশটির শ্রমবাজার বন্ধ হতে পারে। হাইকমিশনার মাহবুব হোসেন সমকালকে বলেছেন, দালালদের অপতৎপরতার কথা সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে জানিয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। দালালদের কারণে কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শ্রমবাজার বন্ধের আশঙ্কাও রয়েছে।

https://www.samakal.com/todays-print-edition/tp-first-page/article/200224961/