৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, মঙ্গলবার, ১০:২৪

লেমিনেটেড পোস্টারে রাজধানীতে পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর প্রার্থীদের টানানো লেমিনেটেড পোস্টার বর্জ্যে রাজধানীতে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন পোস্টার, লিফলেট এবং কর্মীদের পরিচয়পত্রে রাজধানীতে প্রায় ২৫ শ’ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে। এগুলো এখন শহরের ড্রেন, নালা ও নর্দমায় পড়ে বর্জ্য নিষ্কাশনে বাধা হয়ে পরিবেশ বিপর্যয় ও বায়ুদূষণ এবং পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ পোস্টারগুলো প্লাস্টিকে মোড়ানো থাকায় তা প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্ভব নয়। এগুলো মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশবিষয়ক বেসরকারি সংস্থার এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন বা এসডোর গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, যাদের হাতে পরিচ্ছন্ন ও বাসযোগ্য নগরী গড়ার দায়িত্ব যাবে, তারাই যদি নগরীর পরিবেশের ক্ষতিকর কার্যক্রমে জড়িয়ে যান, তা হলে এ নগরী রক্ষা করবে কে? জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচন এলেই প্রচারণা পোস্টারে ছেয়ে যায় নগরী। কয়েক বছর আগে যেখানে এমন প্রচারণায় পোস্টার থাকলেও তা লেমিনেটেড ছিল না। এতে নির্বাচনের পর তা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া সহজ ছিল। ফলে পরিবেশের জন্য হুমকি ছিল না। কিন্তু বর্তমান সময়ে পলিথিনের মোড়ক দেয়া পোস্টার পরিবেশ এবং শহরের স্বাভাবিক অবস্থাকে মারাত্মক হুমকির দিকে ঠেলে দিয়েছে। কারণ সাধারণ কাগজ সহজে ধ্বংস হয়ে গেলেও পলিথিনের তৈরি পোস্টার পুড়িয়ে ফেলা ছাড়া তা ধ্বংস করা কঠিন। কিন্তু পোড়াতে গেলেও ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীতে তা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই নির্বাচন ঘোষণার সাথে সাথে প্লাস্টিক লেমিনেটেড পোস্টারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে নির্দেশনা দেয়া হলেও তা মানা হয়নি। কিন্তু এখন যা অবস্থা তাতে নির্বাচনী পোস্টারের বর্জ্য যদি সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ধ্বংস করা না যায় তবে বাতাস ও শব্দ দূষণে রাজধানী অচল হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, এই পোস্টার বর্জ্যরে ক্ষতিকর প্রভাবে মানুষের শরীরে ক্যান্সারসহ মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, এগুলো যেহেতু পলিথিনে মোড়ানো তাই তুলে নিয়ে পুড়ালে তা থেকে যে পরিবেশ দূষণ হবে তাতে মানুষের ক্যান্সারের আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া মাটিতে পুঁতে ফেলা হলেও মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার বৃষ্টিতে তা নগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা অচল করে দিয়ে নগরীকে পানিতে ডুবাবে। এ ছাড়া পানিতে ভেসে গিয়ে যদি তা নদীতে পড়ে তবে সেখানে নদীর পানি দূষিত হয়ে মাছের ক্ষতি করবে।

এসডো সূত্র জানায়, ঢাকা শহরের সম্ভাব্য লেমিনেটেড প্লাস্টিক বর্জ্যরে প্রধান ছয়টি উৎস ধরে নিয়ে তার ওপর তারা গবেষণা চালায়। যার মধ্যে রয়েছেÑ ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচন, খবরের কাগজের সাথে দেয়া প্রচারপত্র, ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা, অমর একুশে বইমেলা, অন্যান্য বড় পরিসরের মেলা বা প্রদর্শনী, রেস্তোরাঁ, বিউটি পার্লার এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনে বিতরণ করা লিফলেট।

এ বছর নির্বাচনে প্রার্থীরা প্রচারণার উদ্দেশ্যে আনুমানিক ৩০৪ মিলিয়ন প্লাস্টিক লেমিনেটেড পোস্টার ছেপেছেন। এ ছাড়া প্রচারণায় ব্যবহৃত স্টিকার, সাধারণ কার্ড, স্বেচ্ছাসেবকের পরিচয়পত্র তৈরিতেও লেমিনেটেড প্লাস্টিকের ব্যবহার হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর প্রায় ১২ দিনের মধ্যেই ২৪৭২ টন লেমিনেটেড প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে।

এসডোর মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, প্রাথমিক ব্যবহারের পরে ফেলে দেয়া বিপুল পরিমাণ এ প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণের অংশীদার হবে। এসব বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পক্ষে কঠিন। ফলে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে, এ ছাড়া বায়ু ও পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

বিরাজমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ মুদ্রণ ও শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিপণন সমিতির বর্তমান সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, নির্বাচনে সাদাকালো পোস্টারে লেমিনেটিং করার প্রধান কারণ কুয়াশা কিংবা বৃষ্টিতে পোস্টার ছিঁড়ে পড়া। এ ছাড়া সাদাকালো পোস্টার দৃষ্টিনন্দন না হওয়ায় বেশি টানাতে হয়। এতে যেমন শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হয়, তেমনি পোস্টার ছাপতে হয় বেশি; যার কারণে পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এমন পিরিস্থিতিতে রঙিন পোস্টারেই তিনি সমাধান দেখছেন।

মুদ্রণ সমিতির এই নেতার মতে, রঙিন পোস্টার যেমন দৃষ্টিনন্দন হয়, তেমনি সাদাকালো পোস্টারের চেয়ে টেকসইও বেশি। সে জন্য তাতে লেমিনেট করতে হয় না। এ জন্য প্রচারণায় পোস্টারও কম প্রয়োজন হয়। ফলে লেমিনেটেড সাদাকালো পোস্টারের চেয়ে খরচও কম। সব মিলিয়ে রঙিন পোস্টার সাশ্রয়ী এবং পরিবেশের জন্যও তেমন ক্ষতিকর নয়।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/477709/