৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, মঙ্গলবার, ৯:৫৯

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির চার বছর

উত্তর মেলেনি অনেক প্রশ্নের : উদ্ধার হয়নি সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির চার বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। এই ৪৮ মাসে এখনো উদ্ধার হয়নি চুরি হয়ে যাওয়া ৮০০ কোটি টাকার মধ্যে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা। আবার এ রিজার্ভ চুরি নিয়ে উত্তর মেলেনি অনেক প্রশ্নের। এক বছর আগে (১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু ওই মামলার ভাগ্যও অনেকটা ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা চলবে কী চলবে না সেই রায় এখন অপেক্ষমাণ। এ দিকে দীর্ঘ এ সময়ে চুরি হয়ে যাওয়া অর্থের বেশির ভাগই উদ্ধার না হলেও উদ্ধার ও তদন্তের নামে ব্যয় হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। ঘণ্টায় প্রায় ৪০০ ডলার ব্যয়ে এক হাজার ৪০০ ঘণ্টা তদন্ত করে ফায়ার আই নামক একটি সফটওয়্যার কোম্পানি। রাকেশ আস্তান নামক একজন ভারতীয় নাগরিক এ তদন্তের নেতৃত্ব দেন। কিন্তু এ ব্যয় বহুল তদন্তের ফলাফল কি তা আজো জানে না দেশের জনগণ। আবার ফিলিপাইন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের কর্মকর্তারা দফায় দফায় ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু ৩৬ মাসেও চুরি যাওয়া অর্থের বেশির ভাগ অংশই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান (বিএফআইইউ) আবু হেনা মুহা: রাজি হাসান এ বিষয়ে গত
কাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, অর্থ উদ্ধারের মামলার কার্যক্রম চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যে মামলাটি করা হয়েছিল সেটি যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে চলবে কি চলবে না তা নিয়ে ইতোমধ্যে দুই দফা শুনানি হয়েছে। এটির রায় পক্ষে আসলে মামলা যুক্তরাষ্ট্রের আদালতেই পরিচালিত হবে। অপর দিকে ফিলিপাইন সরকারও বাংলাদেশের পক্ষে সে দেশের আদালতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ১২টি মামলা করেছিল। সেই মামলাগুলোর কয়েকটির রায় হয়েছে। বাকিগুলো এখনো চলছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে সে বছর মার্চের শুরুতে। চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় প্রবেশ করা দুই কোটি ডলার আগেই ফেরত পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ফিলিপাইনে যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে থেকে এখন পর্যন্ত ফেরত পাওয়া গেছে মাত্র দেড় কোটি ডলার। বাকি ছয় কোটি ৬০ লাখ ডলার আজো ফেরত আসেনি। রিজার্ভ থেকে চুরি চাওয়া অর্থ ফেরত পেতে দীর্ঘ তিন বছর পর গত বছর ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই মামলায় ১৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি, সাতটি প্রতিষ্ঠান ও ২৫ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে বিবাদি করা হয়। মামলার পর গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, মামলাটি নিষ্পত্তি হতে তিন বছর সময় লাগতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো মামলাটি যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে চলবে কি চলবে না তা নিয়ে এখন শুনানির পর্যায়ে রয়েছে।

জানা গেছে, রিজার্ভ চুরির ঘটনা প্রকাশের পরপর ‘ফায়ার আইন’ নামক একটি কোম্পানিকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। এটির নেতৃত্ব দেন ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তান। প্রথমে ৭০০ ঘণ্টা, পরে তা বাড়িয়ে আরও ৭০০ ঘণ্টা তদন্ত করা হয়। প্রতি ঘণ্টা তদন্ত করতে ব্যয় হয় প্রায় ৪০০ ডলার। এই এক হাজার ৪০০ ঘণ্টার ব্যয়বহুল তদন্তের ফলাফল কী তা আদৌ প্রকাশ করা হয়নি। এ ব্যয়বহুল তদন্ত সম্পর্কের ফলাফল সম্পর্কে এখনো জানেনা দেশের জনগণ।

এ দিকে রিজার্ভ চুরির দীর্ঘ চার বছরেও কিছু প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। জানা গেছে, সুরক্ষিত সুইফট সিস্টেমের সাথে আরটিজিএস (রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট) নামক একটি সফটওয়্যার সংযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতর থেকে কেউ কেউ অতিউৎসাহী ছিলেন। আরটিজিএস সংযোগের পরেই রিজার্ভ চুরি হয়। কারা অতিউৎসাহী ছিলেন নতুন এ সফটওয়্যার সুইফটের সাথে সংযোগ দিতে তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। আবার ওই বছরে ফিলিপাইনের দৈনিক পত্রিকা ইনকোয়েরার’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি হয়। চুরি হওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকিং করপোরেশনের জুপিটার শাখায় ছিল ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সেখান থেকে অর্থের বড় অংশ চলে যায় দেশটির ক্যাসিনোতে (জুয়ার আসরে)। আবার ক্যাসিনোতেও সেই অর্থ ছিল ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থাৎ আরো ২০ দিন। প্রশ্ন উঠেছে, সরকারকে আগ থেকে অবহিত করলে চুরি হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব ছিল কি না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে এ অর্থের বেশির ভাগই ফেরত আনা সম্ভব ছিল। কিন্তু কেন সরকারকে জানানো হলো না, কারা বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরকে ঘটনাটি না জানাতে পরামর্শ দিয়েছিল তা জানা যায়নি।

এ ছাড়া রিজার্ভ চুরির ঘটনা জানার পরপরই তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলকে ফিলিপাইনে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ওই প্রতিনিধি দল কোনো প্রকার সরকারি আদেশ (জিও) ছাড়া কিভাবে বিদেশ ভ্রমণ করে ও সেখান থেকে আসার পর এ সংক্রান্ত কোনো অগ্রগতি প্রতিবেদন কেন দেয়নি এ প্রশ্নের উত্তর আজো পায়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এমনকি এ প্রশ্নের সন্তোষজনক কোনো উত্তর পায়নি রিজার্ভ চুরির উপর তদন্তে নিয়োজিত সিআইডি কর্মকর্তারাও। সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, সিআইডি কর্মকর্তারা এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে প্রশ্ন করেছিলেন। তবে সাবেক গভর্নরও এর সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি বলে এক সূত্র জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সূত্র জানিয়েছে, রিজার্ভ চুরির বিষয়টি সাথে সাথে সরকারকে অবহিত করলে হয়তো টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হতো। ওই সূত্র জানিয়েছে, চুরি হওয়া অর্থ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক অবহিত হয় ৮ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ অর্থ চুরির অবহিত হওয়ার পরও অর্থ ফিলিপাইনের ব্যাংকিং সিস্টেমে ছিল দুই দিন ( ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি)। এরপর এক টানা ২০ দিন ফিলিপাইনের জোয়ার আসরে অর্থ ঘোরাফেরা করে। সরকারকে জানালে অর্থ উদ্ধার কিভাবে সম্ভব হতো? এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যখন চুরি যাওয়া অর্থ ব্যাংকে ছিল তখন সরকারকে জানালে এবং সাথে সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ বা টাকা উত্তোলন বন্ধ করা যেত। এরপর জুয়ার আসরে যাওয়ার পরও সরকারকে অবহিত করলে টাকা উদ্ধার করা সম্ভব ছিল। যেমন, সরকার টু সরকারপর্যায়ে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করা যেত। প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবে টাকা উদ্ধারের জন্য ইন্টারপোলের সহযোগিতা নেয়া যেত।

কিন্তু এতগুলো সম্ভাবনা থাকার পরেও কেন বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে আগেভাগে জনগণের অর্থ উদ্ধারে অবহিত করল না। এ দায়ে সরকারের চাপে গভর্নর আতিউর রহমানকে পদত্যাগ করতে হয়। আরও দুই ডেপুটি গভর্নর আবুল কাসেম ও নাজনীন সুলতানাকে অপসারণ করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া পদত্যাগপত্রে ড. আতিউর রহমান নিজেই লিখেছিলেন, ‘চুরি হওয়ার ঘটনা-পরবর্তী কার্য দিবসেই বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে বিষয়টি অবহিত করি এবং অর্থ পুনরুদ্ধার, জড়িত পক্ষগুলো শনাক্ত করার এবং অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলোর দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করার বিষয়গুলোর দিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিই।’ সাবেক গভর্নরের পদত্যাগপত্রের ভাষা দেখে বোঝা যায়, তিনি বিষয়টি অবহিত হওয়ার পরপরই বিএফআইইউকে অবহিত করেছিলেন। কিন্তু বিএফআইইউ কেন সরকারকে অবহিত করল না এটিই এখন বড় রহস্যের বিষয়।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/477668/