৩০ জানুয়ারি ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৭:৫৫

রাজউক-দুর্নীতি সমার্থক

সেবা নিতে লাগে ২ হাজার থেকে ২ কোটি টাকা : টিআইবি

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে বিনা ঘুষে কোনও সেবা পাওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, রাজউক থেকে বিনা ঘুষে সাধারণ মানুষ সেবা পেয়েছেন, এমন ঘটনা বিরল। রাজউক ও দুর্নীতি সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে। রাজউক আর দুর্নীতি একাকার হয়ে গেছে।

গতকাল ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন। ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন টিআইবির ফাতেমা আফরোজ ও ফারহানা রহমান।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ঘুষ ছাড়া কোনো সাধারণ নাগরিকের রাজউকের সেবা পাওয়া বিরল ঘটনা। যেমন ইমারতের নকশা অনুমোদনে ৫০ হাজার থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। তবে রাজউকের সব কর্মকর্তা দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। কিছু কর্মকর্তা, দালাল ও সেবাগ্রহীতাদের একাংশের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে চুক্তি করে সুনির্দিষ্ট হারে ঘুষ নেওয়া হয়। রাজউক ও দুর্নীতি একাকার এবং সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, রাজউকে দুর্নীতি ও অপব্যবস্থা রয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। পরিকল্পনা প্রণয়ন, উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার প্রতিষ্ঠানকে আবার নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে গোড়া থেকে স্বার্থের দ্ব›দ্ব ছিল। সেটিই অনিয়ন্ত্রণ, অব্যবস্থাপনা, নিয়ম-নীতির লঙ্ঘন ও রক্ষককে ভক্ষকের ভূমিকায় রূপান্তরিত করার জায়গাটি তৈরি করেছে। রাজউক একটি মুনাফা অর্জনকারী ও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে, জনবান্ধব হতে পারেনি।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১৮ সালের নবেম্বর থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট খাতে এ গবেষণা চালায় টিআইবি। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যক্তি পর্যায়ে নকশা অনুমোদনে ৫০ হাজার থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা, রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে ২ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা টাকা পর্যন্ত রাজউক কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়। আবার ১০ তলার বেশি ইমারতের নকশা অনুমোদনে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে ফি-র অতিরিক্ত ১৫ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা এবং বিশেষ প্রকল্পের ক্ষেত্রে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে ১৫ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়।

প্রতিবেদনে টিআইবি আরও জানায়, ব্যক্তি পর্যায়ে রাস্তা প্রশস্ত দেখাতে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা, ছাড়পত্র অনুমোদনে ১৫ থেকে ৮০ হাজার টাকা ও রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত রাজউক কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়। এছাড়া নকশা অনুমোদনে সময়ক্ষেপণ, সেবায় প্রতারণা ও হয়রানি, পরিদর্শনে অনিয়ম ও দুর্নীতি, নকশা বাস্তবায়নে আইন ও বিধির লঙ্ঘন, প্লট বরাদ্দ, প্লট হস্তান্তর, ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তরসহ একাধিক সেবায় ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না।

এতে বলা হয়, নথি রক্ষকের কাছ থেকে মালিক নিজে বা দালাল কর্তৃক প্লটের ফাইল দেখানোর ক্ষেত্রে কোনো ফি না থাকলেও ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা, প্রকল্পের আবাসিক ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তরে ফি না থাকলেও ২ থেকে ৫ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয় সেবাগ্রহীতাকে। লিজ দলিলে ৩১ হাজার থেকে ৬০ হাজার পর্যন্ত নির্ধারিত ফি থাকলেও ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়।

নামজারি প্লট প্রতি নির্ধারিত ফি এর চেয়ে ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা, হেবা ফ্ল্যাট প্রতি ৫০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা, বিক্রয় অনুমোদন ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা ঘুষ আদান-প্রদান করা হয়। বিল উত্তোলনে ফি না থাকলেও কার্যাদেশ মূল্যের ২ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়। এছাড়াও নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারসহ ব্যাপক ঘুষ আদায় করা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে টিআইবি।

গবেষণা পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণমূলক কাজকে গুরুত্ব না দিয়ে উন্নয়নমূলক কাজে অধিক গুরুত্বারোপ এবং আবাসন ও রিয়েল স্টেট ব্যবসার মাধ্যমে মুনাফাকে প্রাধান্য দেয় রাজউক। অন্যদিকে পরিকল্পনা প্রণয়ন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলেও তা বারবার উপেক্ষিত থাকে।

টিআইবির পক্ষ থেকে উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের পৃথক একটি সংস্থা গড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কারণ সংস্থাটির মতে রাজউক যেহেতু মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তাই তাকে এ কাজ থেকে ফিরিয়ে আনা কঠিন।

https://www.dailyinqilab.com/article/264508/