২২ জানুয়ারি ২০২০, বুধবার, ১২:২৪

হজযাত্রীর বুকে বিমানের ছুরি

জ্বালানির দাম কমলেও স্বাভাবিক ভাড়ার তিনগুণ নির্ধারণ * হজযাত্রায় জনপ্রতি খরচ বাড়বে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত * প্রস্তাব সমর্থনযোগ্য নয় -ধর্ম প্রতিমন্ত্রী

অন্য সব ক্ষেত্রে নিজেদের লোকসান পুষিয়ে নিতে হজ বাণিজ্যে নেমেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।

সাধারণ যাত্রীরা যেখানে ঢাকা-জেদ্দা রুটে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকায় আসা-যাওয়া করতে পারেন, সেখানে এবার হজযাত্রীদের ক্ষেত্রে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এটি স্বাভাবিক ভাড়ার প্রায় তিনগুণ।

হজযাত্রী ও সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে বিমান ভাড়ার ফারাক প্রায় এক লাখ টাকা। এতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বাড়তি বাণিজ্য হবে ৬০০ কোটি টাকার বেশি। একই সুবিধা পাবে সৌদি এলারলাইন্সও।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় রোববার এ ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। এর প্রতিবাদে ওই সভা ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আবদুল্লাহ ও বেসরকারি এজেন্সি মালিকদের সংগঠন হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) প্রতিনিধিরা।

ধর্ম মন্ত্রণালয় ও হাব বলছে, সৌদি সরকার এ বছর কোনো সার্ভিস চার্জ বাড়ায়নি। আর বিশ্ববাজারে বর্তমানে জ্বালানি তেলের মূল্য গেল বছরের চেয়ে অনেক কম। তাহলে বিমান ভাড়া কেন বাড়ানো হবে? ভাড়া বাড়িয়ে কার স্বার্থে সৌদি এয়ারলাইন্সের হাতে হজযাত্রীদের ৬০০ কোটি টাকা তুলে দেয়ার পাঁয়তারা হচ্ছে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন সূত্র জানায়, গেল বছর হজের সময়ে (আগস্ট ২০১৯) আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জন্য প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের মূল্য ছিল শূন্য দশমিক ৭১ ডলার। বর্তমানে তা শূন্য দশমিক ৫৮ ডলার। অর্থাৎ গেল বছরের চেয়ে জেট ফুয়েলের মূল্য কমেছে শূন্য দশমিক ১৩ ডলার, বাংলাদেশি টাকায় প্রতি লিটারে প্রায় ১১ টাকা কম।

এদিকে বিমানের ওই ভাড়া ধরে নিয়েই হজ প্যাকেজের খসড়া তৈরি করছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী, প্যাকেজ-১ এর সম্ভাব্য ব্যয় দাঁড়াবে ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৭৮৬ টাকা, যা গতবারের চেয়ে ২৫ হাজার ২৪৬ টাকা বেশি।

একইভাবে প্যাকেজ-২ এর ব্যয় ধরা হতে পারে ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৫২৫ টাকা, যা গতবারের চেয়ে ২৪ হাজার ১৪৫ টাকা বেশি। এছাড়া স্বল্পমূল্যের নতুন একটি প্যাকেজ ঘোষণা করতে চাইছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। ‘আজিজিয়া হজ প্যাকেজ’ নামে ওই প্যাকেজের মূল্য ধরা হতে পারে ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৪৮ টাকা।

সূত্র জানায়, রোববার বিমান মন্ত্রণালয়ে বিমানের ভাড়া নির্ধারণী সভায় বিমানের পক্ষ থেকে হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া এক লাখ ৫৪ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়। গত বছর এ ভাড়া ছিল ১ লাখ ২৮ হাজার। ২০১৮ সালে ছিল ১ লাখ ২৪ হাজার ৭২৩ টাকা। এ ভাড়া নিয়ে বিমানের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন ধর্ম মন্ত্রণালয় ও হাব নেতারা। একপর্যায়ে তারা সভা ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। পরে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে বিমান মন্ত্রণালয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মঙ্গলবার নিজ দফতরে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা কোনোভাবেই বিমানের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত নই। সৌদি সরকারের কোনো নতুন চার্জ নেই বা কোনো সার্ভিস চার্জ বৃদ্ধি করেনি। জ্বালানির দাম গতবারের চেয়ে আরও কমেছে। এরপরও কেন তারা বিমান ভাড়া জনপ্রতি ১২ হাজার টাকা বৃদ্ধি করেছে তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। ভাড়া কমানোর চেষ্টা করছি।’

তবে ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যকে নাকচ করে দিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মহিবুল হক। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বিমান ভাড়া নিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। তাদের সম্মতিতেই ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বৈঠক থেকে ওয়াকআউট করেননি বলেও দাবি করেন মহিবুল হক।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা-জেদ্দা-ঢাকা রুটে সারা বছরই প্রবাসী শ্রমিক ও অন্যান্য যাত্রী ৪০ হাজার টাকায় আসা-যাওয়া করছেন। ওমরা হজে বিমান ভাড়া সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা। অথচ হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া গুনতে হচ্ছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। একই বিমানে পাশের আসনে বসা সাধারণ যাত্রীর তুলনায় একজন হজযাত্রীকে প্রায় এক লাখ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে।

হজের সময় হজ ফ্লাইট ছাড়াও নিয়মিত ফ্লাইটে হজযাত্রী পরিবহন করা হয়। হজ চুক্তি অনুযায়ী, এ বছর ১ লাখ ৩৭ হাজার বাংলাদেশি পবিত্র হজব্রত পালনে সৌদি আরব যেতে পারবেন। বিমান বাংলাদেশ এবং সৌদি এয়ারলাইন্স হজযাত্রী পরিবহন করবে। এসব হজযাত্রীকে সাধারণ যাত্রীদের তুলনায় ১২০০ কোটি টাকা বেশি ভাড়া গুনতে হবে।

হাব নেতারা বলছেন, দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া দিয়েও হজযাত্রীরা বাড়তি কোনো সুবিধা পান না। বরং কখনও ফ্লাইট বাতিল, কখনও দীর্ঘ ট্রানজিটে দুর্ভোগে পড়েন। আবার ফ্লাইট বিলম্বের কারণে হজযাত্রীদের দিনের পর দিন হজক্যাম্পে ইহরাম বেঁধে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়।

বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, হজযাত্রী পরিবহন ছাড়া বিমান বাংলাদেশের সব খাতেই বিপুল পরিমাণ লোকসান গুনতে হয়। অনিয়ম ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন খাতের দুর্নীতি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনও অনুন্ধান করে এর সত্যতা পেয়েছে। সেই লোকসান পুষিয়ে নিতেই হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া প্রতি বছরই বাড়ানো হচ্ছে।

এদিকে কাল সকাল ১০টায় সংবাদ সম্মেলন করে বিমান ভাড়া কমানোর দাবি করবে হাব। এ প্রসঙ্গে সংগঠনটির সভাপতি এম শাহাদত হোসাইন তসলিম যুগান্তরকে বলেন, বছরের যে কোনো সময় বিমান ভাড়া সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা। অথচ হজযাত্রীদের ক্ষেত্রে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা স্বাভাবিক ভাড়ার চেয়ে তিনগুণের বেশি। হজের সময় বিমানের কোনো আসন খালি যায় না। অন্য সময় আসন খালি যায়। তাই পুরো আসন বিক্রি হলে স্বাভাবিক নিয়মে ভাড়া কমার কথা।

তসলিম আরও বলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয় ও হাবকে উপেক্ষা করে বিমান নিজেরাই নিজেদের ভাড়া ঠিক করেছে। এখানে গণশুনানি বা হজযাত্রীদের কোনো মতামত নেয়া হয়নি। বিমান ভাড়া সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা করার দাবি জানান তিনি। তাতেও না পোষালে সর্বোচ্চ ১ লাখ ১০ হাজার টাকা করা যেতে পারে।

হাব সভাপতি আরও বলেন, বিমান ভাড়া বাড়লে প্যাকেজের মূল্য বাড়বে। এতে বিপাকে পড়বেন হজযাত্রীরা। সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে। আর হজযাত্রী মানেই সবাই বিত্তশালী এমনটি মনে করার কারণ নেই। প্রায় অর্ধেক হজযাত্রীই ধর্মীয় আবেগ থেকে এবং সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে হজে যান। তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ নেয়া জুলুম।

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে হজ হতে পারে। বিমান ভাড়ার ওপর ভিত্তি করে ধর্ম মন্ত্রণালয় হজ প্যাকেজ ঘোষণা করবে। সরকারের বেঁধে দেয়া মূল্যের ওপর ভিত্তি করে বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলো তাদের নিজস্ব হজ প্যাকেজ ঘোষণা করবে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও সৌদিয়া এয়ারলাইন্স সমান সংখ্যক যাত্রী পরিবহন করবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/269766/