চালের বাজার অস্থির। ছবি: সংগৃহীত
২১ জানুয়ারি ২০২০, মঙ্গলবার, ৯:৫৭

মিলারদের কারসাজিতে ফের অস্থির চালের বাজার

সপ্তাহের ব্যবধানে ৫০ কেজির বস্তায় বেড়েছে ১০০-২০০ টাকা * মিলাররা বলছেন, ধানের দাম বৃদ্ধির প্রভাব চালে

মিলারদের কারসাজিতে ফের অস্থির চালের বাজার। গত বছর নভেম্বরেও চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছিল। পরে খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মিল মালিকদের দফায় দফায় বৈঠকের পর দাম কমে আসে। কিছুদিন নিশ্চুপ থাকার পর চলতি বছরের শুরুতে মিলাররা ফের তৎপর হয়ে ওঠায় বাড়তে শুরু করেছে চালের দাম।

সম্প্রতি ধানের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে গত ৫ দিনের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) দাম বাড়ানো হয়েছে ১০০-২০০ টাকা। ফলে রাজধানীসহ সারা দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে বাড়ছে চালের দাম। এর ফলে খেটে খাওয়া ও নিু আয়ের মানুষ পড়েছে বিপাকে।

সোমবার ঢাকার বেশ কয়েকটি পাইকারি ও খুচরা বাজার এবং দিনাজপুর, কুষ্টিয়া ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মোকামে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিল পর্যায়েই মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৬ টাকা কেজিদরে।

সেই চাল পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকায়। আর খুচরায় ৫০ টাকা। অথচ ৫ দিন আগে মিনিকেট চাল মিল পর্যায়ে ছিল ৪২ টাকা। ৫ দিন আগে খুচরা বাজারে মিনিকেট চাল বিক্রি হয় ৪৫-৪৬ টাকা।

জানতে চাইলে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, হঠাৎ করে চালের দাম বাড়া অযৌক্তিক। কারণ দেশে চালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। ধানেরও বাম্পার ফলন হয়েছে। তাই সরকার ও সংশ্লিষ্টদের এর কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। দাম যেন আর না বাড়ে সেই ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

এজন্য বিশেষভাবে বাজার মনিটরিং করতে হবে। কথা হয় কুষ্টিয়ায় চালের মিল মালিক আবদুর রহিমের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বাজারে ধানের দাম অনেক বেশি। এরপরও ধান পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি দামে ধান কেনায় চালের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই চালের দাম বাড়ছে।

এছাড়া বাজারে সবচেয়ে বেশি চালের চাহিদা রয়েছে বিআর-২৮ ও মিনিকেট জাতের চালে। আর এ জাতের ধানের উৎপাদন হয় এপ্রিলের দিকে। এ সময় এই জাতের ধান না পাওয়ায় চালের দাম বেড়েছে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, মিল মালিকরা বলছে তাদের কাছে চাল নেই। চাহিদামতো অর্ডার করলে চাল দেয়া যাবে না। তবে পরক্ষণেই তারা একটি রেট (দাম) জানিয়ে দেয়। বলে এই দামেই নিতে হবে। কারণ ধানের দাম বেশি।

তিনি বলেন, এসব তাদের মনগড়া কথা। কারণ দেশে চালের কোনো ঘাটতি নেই। এবার চালের বাম্পার ফলন হয়েছে। মিলাররাই বাড়তি মুনাফার আশায় পাইকারি থেকে খুচরা বিক্রেতা ও ভোক্তাকে জিম্মি করে বেশি টাকা আদায় করছে। দেশে যে পরিমাণ চাল আছে তাতে চালের দাম বাড়ার কথা নয়।

তিনি বলেন, ৫ দিনের ব্যবধানে ৫০ কেজির বস্তায় সর্বোচ্চ ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। যে মিনিকেট চাল মিল মালিকদের কাছ থেকে ৫ দিন আগে প্রতি বস্তা ২১০০ টাকা করে আনতাম। তা এখন ২৩০০ টাকায় আনতে হচ্ছে। সব শেষে ভোক্তারাই বেশি দাম দিয়ে চাল কিনছে।

এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সবশেষ তথ্য বলছে, গত ১৬ জানুয়ারি সরকারি গুদামে মজুদ খাদ্যশস্যের পরিমাণ ১৫ লাখ ৬ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাল ১১ লাখ ৮৩ হাজার মে. টন এবং গম ৩ লাখ ২৩ হাজার মে. টন। মন্ত্রণালয় বলছে- খাদ্যশস্যের এ মজুদ সন্তোষজনক। এছাড়া এ মুহূর্তে খাদ্যশস্যের কোনো ঘাটতি নেই বা ঘাটতির শঙ্কাও নেই।

সোমবার মিলাররা প্রতি কেজি বিআর-২৮ চাল ৩৩-৩৪ টাকা বিক্রি করে। ৫ দিন আগে ছিল ২৯-৩০ টাকা। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি বিআর-২৮ বিক্রি হয় ৩৪-৩৫ টাকায়। পাঁচ দিন আগে ছিল ৩১-৩২ টাকা। এদিন খুচরা পর্যায়ে একই চাল বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা কেজিদরে। ৫ দিন আগে ছিল ৩৪-৩৫ টাকা।

এছাড়া মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা মিল পর্যায়ে সোমবার বিক্রি হয় ২৭ টাকা কেজি। ৫ দিন আগে ছিল ২৪ টাকা। পাইকারি বাজারে একই চাল সোমবার বিক্রি হয় ২৯ টাকা। পাঁচ দিন আগে ছিল ২৪ টাকা। এছাড়া সোমবার খুচরা বাজারে বিক্রি হয় ৩৫ টাকা, যা পাঁচ দিন ছিল ৩০-৩২ টাকা কেজি। সেক্ষেত্রে দেখা যায়, সপ্তাহের ব্যবধানে এই চালের দাম খুচরা পর্যায়ে বাড়ে কেজিতে ৩-৫ টাকা।

কথা হয় রাজধানীর মালিবাগ বাজারের খুচরা চাল বিক্রেতা খালেক রাইস এজেন্সির মালিক দিদার হোসেনের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীর সবাই এখন সিটি নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। আর এই সুযোগে আবারও মিলাররা চালের দাম বাড়াতে শুরু করেছে।

মিল পর্যায় থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা বাজারে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। তাহলেই মিলারদের কারসাজি ধরা পড়বে। তিনি বলেন, গত বছরের শেষের দিকে হঠাৎ চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল মিল মালিকরা। সে সময় খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মিলারদের কয়েক দফায় বৈঠক হয়। পরে মিলাররা চালের দাম কমায়।

সোমবার রাজধানীর একাধিক বাজারে কথা হয় সাধারণ ক্রেতাদের সঙ্গে। তারা বলছেন, কিছুদিন সরকারের তৎপরতায় চালের দাম হাতের নাগালে ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে দাম ফের বাড়তে শুরু করেছে। আমরা পড়েছি বেকায়দায়। সরকারের উচিত দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া।

জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, হঠাৎ করে চালের দাম বেড়েছে। সারা দেশের মিল থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিশেষভাবে মনিটরিং করা হবে। অসাধু উপায়ে দাম বাড়ালে ভোক্তা আইনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।

দিনাজপুরে বিপাকে পড়েছেন নিু আয়ের মানুষ : দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠেছে চালের বাজার। এক সপ্তাহের ব্যবধানে দিনাজপুরের খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ৩ থেকে ৪ টাকা। আর বস্তাপ্রতি বেড়েছে ১৫০ থেকে ২শ’ টাকা। বাজারে চাল বিক্রেতারা বলছেন, মিল মালিকরা হঠাৎ চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ দাম বাড়িয়ে দেয়াকে মিল মালিকদের চাল নিয়ে চালবাজি বলে উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে মিল মালিকরা বলছেন, বাজারে ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং সরকারি আমণ সংগ্রহ অভিযান শুরু হওয়ায় বেড়েছে চালের দাম। দিনাজপুর শহরের বাহাদুর বাজার এনএ মার্কেটে গিয়ে সোমবার দেখা যায়, প্রতিবস্তা (৫০ কেজি) মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২শ’ টাকায়, বিআর-২৮ চাল বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৯শ’ টাকায়, সুমন স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪শ’ টাকা থেকে ১ হাজার ৫শ’ টাকা এবং গুটি স্বর্ণ চাল প্রতিবস্তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩শ’ টাকায়।

এক সপ্তাহ আগে প্রতিবস্তা (৫০ কেজি) মিনিকেট চাল বিক্রি হতো ২ হাজার টাকা থেকে ২ হাজার ৫০ টাকায়, বিআর-২৮ চাল বিক্রি হতো ১ হাজার ৮শ’ টাকায়, সুমন স্বর্ণ চাল বিক্রি হতো ১ হাজার ২শ’ টাকায় এবং গুটি স্বর্ণ চাল বিক্রি হতো ১ হাজার ২শ’ টাকা থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকা।

বাজারে হঠাৎ চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে নিু আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। নির্দিষ্ট আয় দিয়ে বাড়তি দামে চাল কিনে খেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।

বাজারে চাল কিনতে আসা মনসুর আলী জানান, চালের দাম বাড়ায় নির্দিষ্ট আয় দিয়ে চাল কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।

বাহাদুরবাজারের চাল বিক্রেতা লিয়াকত আলী জানান, হঠাৎ করে মিল মালিকরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই বেশি দামে চাল কিনে বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের।

দিনাজপুর চালকল মালিক সমিতির সভাপতি মোসাদ্দেক হুসেন জানান, সরকারিভাবে আমন সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী খাদ্য বিভাগে চাল সরবরাহ করতে মিল মালিকরাও বাজারে ধান কেনার প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। এই কারণে বাজারে ধানের দাম বেড়ে গেছে।

দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার কৃষক এএসএম শীষনবী মণ্ডল জানান, ভরা আমন মৌসুমে কৃষকরা জরুরি প্রয়োজন মেটাতে পানির দামে ধান বিক্রি করেছে। এখন কৃষকের ঘরে তেমন আর ধান নেই।

কৃষকের ঘরের ধান এখন মজুদ রয়েছে মিল মালিকদের কাছে। কৃষকের ঘরে ধান ফুরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বাজারে ধানের দাম বাড়তে শুরু করেছে। তিনি জানান, কৃষকের লাভ এখন ভোগ করবে মিল মালিকরা।

দিনাজপুর জেলা কৃষক সমিতির সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল জানান, প্রান্তিক কৃষকের কাছে এখন কোনো ধান নেই। ধান কাটার পরপরই তারা জরুরি প্রয়োজনে ধান বিক্রি করে ফেলেছে। এখন ধান আছে মিল মালিক ও মজুতদারের কাছে।

এদিকে কৃষকদের ঘরে আমন ধান প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার পর পুরোদমে আমন সংগ্রহ শুরু করেছে জেলা খাদ্য বিভাগ। দিনাজপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আশ্রাফুজ্জামান জানান, দিনাজপুরে ৩৯ হাজার ৮২ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই ২ হাজার ৭৮ জন মিল মালিকের সঙ্গে চুক্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ডিসেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ৯ হাজার ৬৫১ টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/269343/