১৮ জানুয়ারি ২০২০, শনিবার, ১১:০৭

বিচারক যখন নিজের বুকে গুলি চালান

একজন বিচারক ন্যায়ের পক্ষে রায় দিতে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় নিজেই নিজের বুকে গুলি চালিয়েছেন। এমনই চাঞ্চল্যকর এক ঘটনা ঘটেছে কিছুদিন আগে আমাদের খুব কাছের দেশ থাইল্যান্ডের আদালতে। ঘটনাটা খুব সাধারণ বা স্বাভাবিক নয়। একজন বিচারক খুব সাধারণ ব্যক্তি নিশ্চয়ই নন। মানুষের জীবনমৃত্যু পারত্রিক বিশ্বাসমতে মহান আল্লাহর নির্ধারিত হলেও মানুষের আদালতেও অনেকের জীবনমরণ নির্ভর করে বা নির্ধারিত হয়ে থাকে। এমন সিদ্ধান্তগ্রহণের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে পৃথিবীর অনেক দেশের সংবিধানে। শুনতে এমন কথা স্থূল মনে হলেও বাস্তবতা কিন্তু এটাই। মানুষের আদালতে যিনি মানুষের জীবনমৃত্যুর সিদ্ধান্ত দেন তিনি হলেন বিচারক। দেশের সংবিধান বা আইন বিচারককে এমন ক্ষমতা দেয়।

হত্যা মামলার আসামিদের সাব্যস্ত করবার শক্ত কোনও প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও ওপরের নির্দেশ ছিল, শাস্তি দিতেই হবে অভিযুক্তদের। কিন্তু শেষপর্যন্ত চাপ উপেক্ষা করেই আসামিদের বেকসুর খালাস দিলেন বিচারক। আর ন্যায়বিচারে বাধা দেবার প্রতিবাদ জানালেন তিনি সঙ্গে সঙ্গেই।

এজলাসে বসেই পকেট থেকে পিস্তল বের করলেন। নিজের বুক তাক করেই গুলি চালালেন তিনি। দক্ষিণ থাইল্যান্ডের ইয়ালা আদালতভবনের তৃতীয় তলায় এক শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৩টায় ঘটে ঘটনাটি। এ ঘটনার পর দ্রুত বিচারককে হাসপাতালে নেয়া হয়। অপারেশনের পর সৌভাগ্যবশত বিচারক প্রাণে বেঁচে যান।

এর আগে প্রতিবাদী বক্তব্য দিয়ে ঘটনাটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্টও করেন। ন্যায়বিচারে এমন নজিরবিহীন প্রতিবাদের জন্য এখন প্রশংসায় ভাসছেন বিচারক কানাকর্ন পিয়ানচানা। নিজের বুকে গুলি চালানোর আগে বিচারক কানাকর্নের লেখা বিবৃতিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে।

২৫ পৃষ্ঠার বিবৃতি থেকে জানা যায়, তিনি যে মামলার শুনানি করছিলেন তা জাতীয় নিরাপত্তা এবং গোপন সংগঠন, ষড়যন্ত্র ও অস্ত্রবিষয়ক। কানাকর্নের দাবি, মামলায় রায় নিয়ে জ্যেষ্ঠ বিচারকদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। প্রমাণের অভাবে পাঁচ অভিযুক্তকে খালাস দিতে চেয়েছিলেন কানাকর্ন। তবে জ্যেষ্ঠ বিচারকেরা তাঁকে তিন অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ড এবং বাকি দু’জনের কারাদণ্ড দিতে চাপ দেন বলে বিবৃতিতে দাবি করা হয়।

এতে আরও বলা হয়, ‘এ মুহূর্তে অন্যান্য অধস্তন বিচারকদের সঙ্গেও একই আচরণ করা হচ্ছে যেমনটি আমার সঙ্গে হয়েছে। তাহলে সম্মান ছাড়া বাঁচবার চেয়ে আমি মরে যাবো।’ থাইল্যান্ডের বিচার বিভাগ ও এর বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে বেশ অভিযোগ রয়েছে। দেশটির আদালতের রায় বেশিরভাগই বিত্তবান ও প্রভাবশালীদের পক্ষেই যায়। অন্যদিকে ছোট্ট অপরাধে সাধারণ মানুষকে দেয়া হয় গুরুতর সাজা। বিচারের নামে অবিচার, প্রহসন দেশে দেশে চলছে। প্রকৃত অপরাধী বেঁচে যায়। আর নিরপরাধ মানুষ সাজা ভোগ করেন। এমনকি মিথ্যে অভিযোগের দায়ভার মাথায় নিয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলেও যেতে হয় অনেককে। উল্লেখ্য, ঊর্ধ্বতন বিচারকরা ক্ষমতাবানদের দ্বারা প্রভাবিত থাকেন প্রায়শই। বিচারব্যবস্থা একটা দেশের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব থাকে এ বিভাগের ওপর। রাষ্ট্রপ্রধান অথবা সরকারপ্রধান নানা কারণে নিজের সুবিধার্থে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ অন্যায় এবং দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন। এমনকি প্রতিপক্ষকে হত্যার মতো অপরাধ পর্যন্ত করতে পারেন। এমতাবস্থায় বিচারবিভাগই পারে এমন অপরাধের শাস্তিবিধান করতে। কিন্তু বিচারবিভাগ যদি স্বাধীন না হয়, তাহলে শাসক তথা সরকারপ্রধানের ইচ্ছের বি
রুদ্ধে রায় প্রদানের ক্ষমতা কোনও বিচারকের থাকে না। তখন সরকারপ্রধান বা যিনি দেশের ক্ষমতায় থাকেন তাঁর ইচ্ছা বা অনিচ্ছারই প্রতিফলন ঘটতে বাধ্য হয় বিচারে। এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাই ঘটেছে থাইল্যান্ডের আদালতে। তাই সেখানকার বিচারক কানাকর্ন পিয়ানচানা ন্যায়বিচার করতে ব্যর্থ হয়ে নিজের বুকে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এটা শুধু কানাকর্ন পিয়ানচানার আত্মহত্যার চেষ্টা নয়। বিচারব্যবস্থার প্রতি ক্ষমতাসীনদের অন্যায় চাপ প্রয়োগের নজিরবিহীন প্রতিবাদ। তিনি প্রথমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লেখনি ধারণ করেছেন। এরপরও যখন ক্ষমতাধররা আদালতের কথা শোনেননি তখন তিনি আত্মহত্যার মাধ্যমে প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে-আদালতে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার পায় না, সে-আদালতের বিচারক পদে তাঁর থেকে সার্থকতা কোথায়? আমরা কানাকর্নকে ধন্যবাদ জানাই।

সমাজ যখন অন্যায় আর অবিচারে ভরে যায়, ভারাক্রান্ত হয়, শাসক ও ক্ষমতাধররা তখন যা খুশি তাই করেন। যার অগাধ শক্তি তিনি কাউকে পরোয়া করেন না, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে পৈতিক সম্পত্তি মনে করেন, তখন একমাত্র ভরসাস্থল থাকে বিচারালয় বা আদালত। কিন্তু ক্ষমতালিপ্সু শাসক যখন ন্যায়বিচারের গলা টিপে ধরেন বা বিচারের রায়কে নিজের পক্ষে নিতে প্রভাব খাটান বা চাপ প্রয়োগ করেন তখন বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। আর বিচারক নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যার পথ খোঁজেন।

বিচারকরা বিভিন্ন কারণে ন্যায়বিচার করতে পারেন না বলে নিরপরাধ ব্যক্তি অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে সাজা ভোগ করেন, ফাঁসির দড়িতে ঝোলেন। অন্যদিকে প্রকৃত অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায়। এমনকি হত্যাকারীও নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্ত মানুষ হিসেবে ঘুরে বেড়ায়। এর চেয়ে বিচারব্যবস্থার জন্য অসম্মানজনক আর কিছু হতে পারে না। যেসব কারণে এমন ওলোটপালোট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তারমধ্যে বিচারব্যবস্থার ওপর উচ্চতর প্রশাসনের হস্তক্ষেপ। এছাড়া বিচারকের প্রতি অবৈধ ক্ষমতাবানদের হুমকিও কাজ করে। বিচারক জীবনের ভয়েও কখনও কখনও ন্যায়বিচার থেকে পিছু হটেন এবং সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে ঘোষণা দিয়ে উল্টো রায় দিতে বাধ্য হন। এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা পৃথিবীতে অনেক ঘটছে। ফলে বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘটছে অঘটনও।

কোনও দেশের বিচারব্যবস্থা বা আদালতের ওপর থেকে যখন সাধারণ মানুষের আস্থা উঠে যায় তখন কেউ কাউকে পরোয়া করে না। আইন অমান্যের প্রবণতা প্রবল হয়। যে যার মতো করে চলা শুরু করে। অরাজক পরিস্থিতির জন্য অস্থিরতা বিরাজ করে সর্বত্র। মানুষ মানুষকে হত্যা করতে দ্বিধা করে না। ব্যবসায়ীরা যাচ্ছেতাই পণ্যের দাম নেয়। ঘুষ-দুর্নীতি বেড়ে যায়। মানুষ প্রতারণা করতে শুরু করে। ঠকবাজি, চোগলখোরি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। কেউ কাউকে গণ্য করে না। মানুষের বিশ্বাস, ভালোবাসা, সদ্ভাব, বন্ধুত্ব লোপ পায়। মানুষের সন্দেহপ্রবণতা ভয়াবহ রূপ নেয়। দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণচিন্তা রাজনীতিবিদদের মধ্যে হ্রাস পায়। দেশ ও জাতি ক্রমাগত দুর্যোগের দিকে ধাবিত হতে থাকে। তাই কোনও দেশ বা জাতিকে টিকিয়ে রাখতে চাইলে আগে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে হবে। বিচারকদের নিরাপত্তা করতে হবে নিশ্চিত। অন্যথায় থাইল্যান্ডের বিচারক কানাকর্ন পিয়ানচানা ন্যায়বিচার করতে ব্যর্থতার দায় নিয়ে যেভাবে নিজের বুকে গুলি চালিয়েছিলেন সেভাবে আরও অনেক সৎ ও নীতিনিষ্ঠ বিচারক আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হবেন। তবে যেসব বিচারকের মেরুদণ্ড বলে কিছু নেই তাঁদের কথা ভিন্ন।

যাই হোক, অসৎ ও স্বার্থপর ক্ষমতাবান থাই প্রশাসন এবং তার দ্বারা প্রভাবিত ঊর্ধ্বতন বিচারকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদী বিচারক কানাকর্ন পিয়ানচানার প্রতি আমাদের অনিঃশেষ শ্রদ্ধা এবং শুভেচ্ছা রইলো। আমরা এমন নির্ভীক বিচারকের দীর্ঘায়ু কামনা করি।

http://dailysangram.info/post/403847