১৬ জানুয়ারি ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১:৫৩

ডিপিডিসির দরপত্রে শর্ত, গচ্চা যাচ্ছে ৩৩৭ কোটি টাকা

বিদেশি পণ্য আমদানির খেসারত * নেপথ্যে সিন্ডিকেটের কারসাজি * পাচার হয়ে যাচ্ছে শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা

দরপত্রে ভুল স্পেসিফিকেশনের জন্য একটি প্রকল্পে ৩৩৭ কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি)। দরপত্রে দেয়া শর্তে বলা হয়েছে- কোনো বিদেশি কোম্পানি সর্বনিম্ন হলে তাদের আমদানিকৃত পণ্যে কাস্টমস শুল্ক ও ভ্যাট দিতে হবে না।

শুল্ক ও ভ্যাট দেবে দরপত্র আহ্বানকারী প্রতিষ্ঠান ডিপিডিসি। অপরদিকে স্থানীয় উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে এই শুল্ক দেয়ার বিধান নেই। অথচ দরপত্রে এ বিষয়টি যথাযথভাবে সমন্বয় করা হয়নি। মূলত এ কারণেই বড় অঙ্কের এই অর্থ গচ্চা যাচ্ছে।

জানা গেছে, বিদেশ থেকে ট্রান্সফরমার, ক্যাবল, বৈদ্যুতিক খুঁটি, হার্ডওয়্যার, ইনসুলেটর, ফিউজ কাটআউট, লাইটিং অ্যারেস্টার, সিভিল ওয়ার্কসহ প্রায় ১১শ’ কোটি (১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) টাকার প্রকল্পে কার্যাদেশ দেয়ার আগমুহূর্তে এই ভুল ধরা পড়ে।

কোম্পানির ১১ কেভি নতুন ডিস্ট্রিবিউশন লাইনসহ ভুগর্ভস্থ ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম এবং চলমান ১১ কেভি ডিস্ট্রিবিউশন লাইন নবায়নের জন্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জামগুলো কেনার কথা। প্রথমদিকে বিষয়টি নিয়ে কর্ণপাত না করলেও এখন বড় ধরনের বিপাকে পড়ছে কোম্পানি।

এ অবস্থায় না পারছে কার্যাদেশ দিতে, না পারছে দরপত্র বাতিল করতে। অভিযোগ উঠেছে- কোম্পানির একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট একটি বিদেশি কোম্পানিকে কার্যাদেশ দিতে পরিকল্পিতভাবে এই ভুল দরপত্র তৈরি করেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে খোদ ডিপিডিসির শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এ সপ্তাহে প্রকল্পটির কার্যাদেশ দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। তিনি বলেন, চলমান রূপরেখা অনুযায়ী দরপত্রের শর্ত মেনে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ দেয়া হলে ডিপিডিসিকে আমদানিকৃত পণ্যের কাস্টমস শুল্ক এবং ভ্যাট বাবদ অতিরিক্ত এই ৩৩৭ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে।

তার মতে, স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকৃত একই মানের পণ্য না কিনে আমদানি করার খেসারত হিসেবে এই গচ্চা দিতে হচ্ছে। এর নেপথ্যে রয়েছে সিন্ডিকেটের কারসাজি।

জানা গেছে, এ প্রকল্পের জন্য গত বছর ২ এপ্রিল টার্ন-কি পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। ১৫ জুলাই দরপত্র খোলা হয়। দরপত্রে দেশি-বিদেশি ১৩টি কোম্পানি অংশ নেয়। নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে কারিগরি দরপত্র খোলা হয়।

পরবর্তী সময়ে কারিগরি মূল্যায়নে যারা রেসপন্সিভ হয় তাদের আর্থিক দরপত্রের জন্য ডাকা হয়। কারিগরি মূল্যায়নে ৪টি কোম্পানি রেসপন্সিভ হয়। এর মধ্যে ৩টি কোম্পানিকে আর্থিক দরপত্র খোলার প্রস্তাব করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিপিডিসির এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে ইতিমধ্যে নানা ধরনের কারসাজি হয়েছে। সর্বনিম্ন দরদাতার কারিগরি প্রস্তাবে ক্যাবল জয়েন্টিং, মালামাল, রিং মেইন ইউনিট, এমসিসিবি, টেস্ট ইকুইপমেন্ট ডিপিডিসির চাহিদা অনুযায়ী ছিল না।

সে কারণে প্রথম দফায় তাদের বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রহস্যজনক কারণে তাদের ফের রেসপন্সিভ করা হয়। গত ৬ জানুয়ারি কারিগরিভাবে উত্তীর্ণ তিন দরদাতা কোম্পানির আর্থিক দরপত্র খোলা হয়। এতে দেখা গেছে, প্রথম দফায় বাদ পড়া চীনা প্রতিষ্ঠানই সর্বনিম্ন দরদাতা।

তারা দর প্রস্তাব করে ৯২৪ কোটি টাকা। অপরদিকে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত হয় একটি দেশীয় কোম্পানি। তারা দর প্রস্তাব করে ৯৯২ কোটি টাকা। দুই দরদাতার মধ্যে প্রার্থক্য ৬৪ কোটি টাকা। সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ দেয়া হলে তাদের পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে।

আমদানি বাবদ দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী ৩৩৭ কোটি টাকা শুল্ক দিতে হবে ডিপিডিসিকে। এতে সর্বনিম্ন হলেও বাস্তবে তাদের দর প্রস্তাব দাঁড়াবে ১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। যা প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে বেশি হয়ে যাবে।

অপরদিকে স্থানীয় কোম্পানি অর্থাৎ দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা যদি দরপত্র অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করে তাহলে তাদের ক্ষেত্রে কোনো কাস্টমস শুল্ক দিতে হবে না। সে ক্ষেত্রে তাদের মূল দর হবে ৯৯২ কোটি টাকা।

সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতার চেয়ে প্রথম সর্বনিম্ন দরদাতার দর দাঁড়াবে ২৭০ কোটি টাকা বেশি। তারপরও আইনানুয়ায়ী সর্বনিম্ন দরদাতাকেই কার্যাদেশ দিতে হচ্ছে। এই অবস্থায় প্রকল্পটি নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ ধরনের টার্ন-কি দরপত্রের আওতায় যেসব বৈদ্যুতিক মালামাল ক্রয় করা হচ্ছে তার প্রায় ৯৯ শতাংশ মালামাল বর্তমানে দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের কোম্পানি গড়ে উঠেছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

এর আগেও ডিপিডিসির ১১ কেভি সরবরাহ লাইন নির্মাণের কাজেও এসব স্থানীয় কোম্পানির মালামাল ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সর্বমোট ৫৫ হাজার ২৪৬ কিলোমিটার বিতরণ লাইন এবং ৬৮৭ সার্কিট কিলোমিটার ট্রান্সমিশন লাইন দেশীয় প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত মালামাল দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে।

কিন্তু তারপরও রহস্যজনক কারণে ডিপিডিসিসহ বৈদ্যুতিক কোম্পানিগুলো একের পর এক টার্ন-কি পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে সরকারের মোটা অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিয়ে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বুধবার সন্ধ্যায় ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ানের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন ধরেননি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/267449/