১৫ জানুয়ারি ২০২০, বুধবার, ২:১৮

শেয়ারবাজারে 'সুনামি'

শেয়ারবাজারে যেন 'সুনামি' এসেছে। লাগাতার দরপতনে আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। এ অবস্থায় পরপর দু'দিন ৯০ শতাংশেরও বেশি শেয়ারের অস্বাভাবিক দরপতন হয়েছে। আগের দিনের চেয়ে গতকাল মঙ্গলবার পতনের মাত্রা ছিল আরও তীব্র। ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের পর ৯ বছর ধরেই থেমে থেমে দরপতন হচ্ছে। কিন্তু ২০১৩ সালের পর এমন সর্বগ্রাসী দরপতন আর দেখা যায়নি। ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা গতকাল রাজধানীর মতিঝিলের ডিএসই কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন। তারা চলতি দরপতনের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির দুর্নীতিকে দায়ী করে অবিলম্বে সংস্থাটির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চেয়েছেন।

গতকাল এমনও হয়েছে, অনেক বিনিয়োগকারী সোমবারের তুলনায় ১০ শতাংশ কমে কোনো কোনো কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করতে চেয়েছেন। কিন্তু ওই সব শেয়ারের ক্রেতা ছিল না। মাত্র এক মাস আগে তালিকাভুক্ত হওয়া শেয়ার রিং শাইন টেক্সটাইলের দর ওই সময় ২২ টাকায় উঠেছিল। গতকাল সাত টাকা ৭০ পয়সা দরেও এই শেয়ার কেনার ক্রেতা পাওয়া যায়নি।

বিনিয়োগকারীরা দিন দিন নিঃস্ব হয়ে গেলেও নির্বিকার শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। সংস্থাটির দিক থেকে কোনো বক্তব্যই মিলছে না। তবে শেয়ার কিনে পতন ঠেকাতে গত কয়েক দিনে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবিসহ একাধিক ব্যাংক চেষ্টা করেছে। কিন্তু আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির চাপ এত বেশি যে এই চেষ্টা ধোপে টিকছে না।

পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয় মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ শেয়ারবাজার-সংশ্নিষ্ট একাধিক পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠকে আইসিবি ছাড়াও বিএসইসি ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বিএমবিএর নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের বিষয়ে তাদের কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে সরকারি ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সব পক্ষের একটি জরুরি বৈঠক আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২০ জানুয়ারি এই বৈঠক হবে।

গতকাল প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ৩৫৫ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ২৯৩টি বা ৮২ শতাংশের দরপতন হয়েছে। চট্টগ্রামকেন্দ্রিক দেশের দ্বিতীয় শেয়ারবাজার সিএসইতে ৮০ শতাংশের বেশি শেয়ারের দরপতন হয়েছে। ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৮৭ পয়েন্ট হারিয়ে ৪০৩৬ পয়েন্টে নেমেছে। সূচক পতনের হার ২ দশমিক ১২ শতাংশ। আগের দিন পতনের হার ছিল ২ দশমিক ১১ শতাংশ। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় লেনদেন শুরুর আড়াই ঘণ্টা পর দুপুর ১টায় ৯০ শতাংশের বেশি শেয়ার দর হারায়। এতে বাজারের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১০০ পয়েন্ট কমে যায়। আধাঘণ্টা পর সূচকটি ১১৩ পয়েন্ট বা পৌনে ৩ শতাংশ হারিয়ে ৪০০৯ পয়েন্টে নামে। ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি ডিএসইএক্স চালুর দিন সূচকটির সর্বশেষ অবস্থান ছিল ৪০৫৫ পয়েন্ট। গতকাল সেদিনের তুলনায়ও ১৮ পয়েন্ট কমে যায়।

চলতি বছরে এখন পর্যন্ত মাত্র ১০ দিন শেয়ারবাজারে লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে সাত দিনই দরপতন হয়েছে। তাতে ডিএসইএক্স সূচক ৪২৩ পয়েন্ট বা সাড়ে ৯ শতাংশ পতন হয়েছে। গতকালই তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির শেয়ারের বাজারদর কমেছে পাঁচ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া এ বছরে এ পর্যন্ত কমেছে ২৬ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা।

গতকাল ব্রোকার ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের মতামত পাওয়া যায়নি। অনেকে মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছেন বা সরাসরি কথা বলতে রাজি হননি। এর মধ্যেও কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, ২০১০ সালের ধসের যৌক্তিকতা ছিল। তখন কোম্পানিগুলোর মুনাফা ও আর্থিক অবস্থার তুলনায় শেয়ারের দর কয়েকগুণ বেশি ছিল। কিন্তু ওই ধসের পর এখন দু-চারটি ছাড়া সব শেয়ারের বাজারদর তার যৌক্তিক মূল্যের চার বা পাঁচ ভাগের এক ভাগে নেমেছে। এ অবস্থায় দরপতনের যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শীর্ষ মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর কোনো প্রচেষ্টাই বর্তমান কমিশনের নেই। তারা ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে চাপ দিয়ে স্রেফ সূচকের পতন ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।

ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তারা জানান, গতকালও লেনদেন শুরুর আধাঘণ্টা আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা লেনদেনের প্রথম ঘণ্টায় কোনো শেয়ার বিক্রি না করার আদেশ দেন। তারা সাড়ে ১০টায় লেনদেন শুরুর প্রথম ১৫ মিনিট পর্যন্ত কোনো বিক্রির আদেশ দেননি। তারপরও বাজার বড় দরপতনের দিকে গেলে ওই নিষেধ কেউ মানেননি। সবাই নিজের টাকা বাঁচাতে শেয়ার বিক্রি শুরু করেন। এ বিষয়ে জানতে বিএসইসির সার্ভিল্যান্স বিভাগের নির্বাহী কর্মকর্তা ও সংস্থার মুখপাত্র সাইফুর রহমানের সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

বাজার-সংশ্নিষ্টরা জানান, কেউ কেউ মনে করেন, ২০১০ সালে ধসের পর শেয়ার কারসাজি বন্ধ হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বন্ধ হয়নি, নতুন নতুন মাত্রা পেয়েছে। বাজারের পুরোনো জুয়াড়ি চক্রের সঙ্গে তালিকাভুক্ত কোম্পানির মালিকরা নামে-বেনামে অ্যাকাউন্ট খুলে শেয়ার কারসাজি করেছে। এটা ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যবস্থা নেয়নি। সেকেন্ডারি শেয়ারবাজারে যেমন কারসাজি হয়েছে, তার থেকে বড় কারসাজি হয়েছে প্রাইমারি মার্কেটে, অর্থাৎ আইপিও নিয়ে। আর্থিকভাবে দুর্বল অনেক কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেওয়া হয়। বাজারে আসার পর ওই সব কোম্পানির মালিকরা শেয়ার বিক্রি করে চলে গেছেন। এগুলোর অন্তত ১০টি পুরোপুরি বন্ধ বা বন্ধের পর্যায়ে আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার কারণেই দরপতন হচ্ছে। এটা ঠেকানোর জন্য সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা অন্য কারও প্রচেষ্টা নেই। ফলে যারা এত দিন আশায় ছিলেন দরপতন বাড়তে থাকায় অন্তত সরকার হস্তক্ষেপ করবে, তারাও আশা ছেড়ে দিয়ে শেয়ার বিক্রি করছেন, যা বাজারকে ধসের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

এর বাইরে ব্যাংক খাতের তারল্য সংকটও শেয়ারবাজারে সমস্যা তৈরি করছে। গ্রামীণফোন, পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন, তিতাস গ্যাসের লভ্যাংশ ঘোষণার সীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেঁধে দেওয়ার ইস্যুতে বিদেশি বিনিয়োগকারীসহ দেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ না থাকায় দরপতন ব্যাপকতা পাচ্ছে বলে জানান অধ্যাপক আবু আহমেদ।

নতুন শেয়ারই দরপতনের বড় কারণ :অলিম্পিক অ্যাক্সেসরিজ শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০১৫ সালে। ২০ টাকা দরে আইপিওতে বিক্রি হওয়ার শেয়ারটির দর তালিকাভুক্তির পরপরই ৭০ টাকা ছাড়ায়। এ শেয়ারটিই এখন কেনাবেচা হচ্ছে ছয় টাকায়। তালিকাভুক্তির মাত্র পাঁচ বছরেই এর দর ১১ ভাগের এক ভাগে নেমেছে।

শুধু অলিম্পিক অ্যাক্সেসরিজ নয়, ২০১০ সালের ধসের পর গত ৯ বছরে তালিকাভুক্ত ৯২টি কোম্পানির সবক'টিরই প্রায় একই অবস্থা। গত পাঁচ বছরে এসব শেয়ার গড়ে ৬৫ শতাংশেরও বেশি দর হারিয়েছে। এর মধ্যে ২০টি এখন প্রকৃত বা অভিহিত মূল্যের (১০ টাকা) কমে কেনাবেচা হচ্ছে। গত দুই বছরের ব্যাপক দরপতনে পুরোনো শেয়ারগুলো গড়ে যেখানে ২১ দশমিক ৬৭ শতাংশ দর হারিয়েছে, সেখানে নতুন শেয়ারগুলো গড়ে ৫২ শতাংশ দর হারিয়েছে।

নতুন শেয়ারগুলোর এমন দরপতনের কারণ কী- জানতে চাইলে ডিএসইর এক পরিচালক সমকালকে বলেন, ২০১০ সালের আগেও আইপিও কারসাজি এবং আইপিওর আগে প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে রমরমা বাণিজ্য ছিল। ওই বাণিজ্যই সে সময় শেয়ারগুলোর দরকে আকাশে তোলে। ধসের পর সবাই আশা করেছিল, এই অনিয়ম বন্ধ হবে। প্রকৃতপক্ষে সেটা বন্ধ হয়নি।

তিনি বলেন, ২০১০ সালের ধসের পর সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি প্লেসমেন্ট বাণিজ্য বন্ধ করতে সুপারিশ করেছিল, সেখানে বর্তমান কমিশন গোপনে আইনি শর্ত শিথিল করে প্লেসমেন্ট বাণিজ্যকে উস্কে দিয়েছে। নতুন ইস্যু করা শেয়ারের সিংহভাগ প্লেসমেন্ট শেয়ার হিসেবে বিক্রি করা হয়। মালিকরাও আত্মীয়স্বজনসহ নিজেদের অন্য কোম্পানির নামে ও বেনামে শেয়ার নিয়ে রাখেন। তালিকাভুক্তির পর এই শেয়ার বিক্রি করে বড় অঙ্কের মুনাফা পেতে কারসাজি করেছেন। তারপর শেয়ার বিক্রি করে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে ভেগেছেন। এরই মধ্যে অন্তত ১০টি কোম্পানি বন্ধ হয়েছে বা প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। রুগ্‌ণ হয়েছে আরও বেশি।

https://samakal.com/bangladesh/article/20019745/