১৫ জানুয়ারি ২০২০, বুধবার, ২:১৭

ঢাকা শিক্ষা বোর্ড

স্কুল-কলেজ অনুমোদনে বেপরোয়া বাণিজ্য

স্কুল-কলেজ অনুমোদন পেতে শর্ত পূরণ করতে হয় কমপক্ষে ১৪টি। কিন্তু ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে শর্ত ভঙ্গ করে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ওই সব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই চলছে ভাড়া বাড়িতে। এমনকি তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অনিয়মের সঙ্গেও জড়িত বলে অভিযোগ আছে। সেই স্কুল-কলেজগুলোই গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো অবস্থাতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না সেগুলো।

জানা যায়, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীন অবৈধভাবে স্কুল-কলেজ অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি চক্র। তারা টাকা হলে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি এবং শর্ত লঙ্ঘন করে স্কুল-কলেজ অনুমোদন দেওয়ায় কাজ করছে। চক্রের বেশির ভাগ কর্মকর্তাই এখন শিক্ষা প্রশাসনের অন্য দপ্তরে বড় পদে পদায়ন পেয়েছেন।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে সিটি করপোরেশন এলাকায় ০.৫০ একর, পৌর ও শিল্প এলাকায় ০.৭৫ একর এবং মফস্বল এলাকায় কমপক্ষে এক একর জমি থাকতে হয়। থাকতে হয় প্রয়োজনীয় ক্লাসরুম, পাঠাগার, বিজ্ঞানাগার, শিক্ষক-কর্মচারী। এ ছাড়া আশপাশের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখলেই কেবল নতুন স্কুল-কলেজ অনুমোদন দেওয়া হয়।

কিন্তু ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনেই এমন শতাধিক স্কুল-কলেজ আছে, যাদের নিজস্ব জমি নেই। ওই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সারা বছর শিক্ষার্থীও থাকে না। শুধু পরীক্ষার সময় কিছু শিক্ষার্থীর নাম দেখা যায়। কারণ অনেক প্রতিষ্ঠানে যেসব শিক্ষার্থী পাবলিক পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পায় না, তারা ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে ওই সব অখ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষা দেয়। তখন তারা বড় অঙ্কের টাকাও আদায় করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে।

প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অনিয়মেও জড়িত থাকে।

রাজধানীতে ভাড়া বাড়িতে চলা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বর্তমানে শিক্ষার্থী আছে ওয়েস্টার্ন কলেজে দুজন, নিউ ক্যাসল কলেজে আটজন, গ্রীণ ফিল্ড কলেজে ১০৯ জন, উত্তরা পাবলিক কলেজে ১৩৩ জন, ঢাকা ইস্টার্ন কলেজে ৯৭ জন, ঢাকা গোল্ডেন কলেজে ৪৬ জন, কুইন মেরী কলেজে দুজন, লিবার্টি কলেজে ৭২ জন, কিংস কলেজে আটজন ও মাইলেসিয়াম কলেজে ৭৭ জন।

নরসিংদী পৌর এলাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকা কলেজগুলোর মধ্যে নরসিংদী ইউনাইটেড কলেজ, নরসিংদী উদয়ন কলেজ, নরসিংদী সেন্ট্রাল কলেজ, স্কলাসটিকা মডেল কলেজ, নরসিংদী পাবলিক কলেজ, নরসিংদী অক্সফোর্ড কলেজ, নরসিংদী ইমপেরিয়াল কলেজ, স্ট্যান্ডার্ড কলেজ অন্যতম।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পর প্রথম তিন বছর পাঠদানের অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর শিক্ষার্থী পাসের হার, স্থায়ী অবকাঠামো চূড়ান্ত হলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে সেই স্বীকৃতিও নবায়ন করতে হয় তিন বছর পর পর। কিন্তু বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আর্থিক যোগসাজশে ভাড়া বাড়িতে থেকেই প্রতিষ্ঠানগুলো স্বীকৃতি নবায়ন করে নেয়। রাজধানীর বাড্ডায় ন্যাশনাল কলেজ, নরসিংদী আইডিয়াল কলেজ ও নরসিংদী বিজ্ঞান কলেজ ভাড়া বাড়িতে চলেও গত অক্টোবরে এমপিওভুক্ত হয়েছে।

জানা যায়, মূলত ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়ম করে অনুমোদন পায়। আর ওই সময় সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর এপিএসের নেতৃত্বে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে একটি শক্ত সিন্ডিকেট ছিল। তারাই মূলত আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে স্কুল-কলেজের অনুমোদন, ইচ্ছামতো ম্যানেজিং কমিটির অনুমোদনসহ নানা কাজ করেছে। এই সিন্ডিকেটের অন্যতম অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক ছিলেন। বোর্ডের সচিব পদে ছিলেন গত বছরের মার্চ পর্যন্ত। এরপর আরো উচ্চ পদে অর্থাৎ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) পদে পদায়ন পান। সম্প্রতি তিনি ভিকারুননিসায় অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে গিয়ে অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। তবে তিনি পরে যাতে বড় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বোর্ডে না থাকেন, সে বিষয়ে এরই মধ্যে নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০১৭ সালে জুতা পায়ে মাউশি অধিদপ্তরের শহীদ মিনারে ওঠা, গভীর রাতে হোটেল থেকে বেরোনোর পর পুলিশের গুলিতে আহত হওয়া, জাতীয়করণ হওয়া শিক্ষকদের আত্মীকরণের বিরুদ্ধে মামলা করাসহ নানা ঘটনার জন্ম দেন তিনি। রাজনীতিতে ভিন্ন ঘরানার এই কর্মকর্তা ওই পদেই আছেন এখনো।

ড. শ্রীকান্ত চন্দ্র চন্দ ২০০৯ সাল থেকে ঢাকা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক ছিলেন। এরপর তিনি ওই বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হন। ২০১৭ সালে তিনি ক্যাডার পরিবর্তন করে প্রশাসনের উপসচিব পদে আসেন। এখন তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (কলেজ) পদে আছেন। এখনো তিনি ওই সিন্ডিকেটের পক্ষেই কাজ করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।

এসব বিষয়ে জানতে কয়েকবার ফোন করা হলেও তা ধরেননি প্রফেসর শাহেদুল খবির চৌধুরী। তবে ঢাকা বোর্ডের সাবেক কলেজ পরিদর্শক ও বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. শ্রীকান্ত চন্দ্র চন্দ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হয়তো কোনো বিধান ছিল, বিশেষ করে রাজধানীর জন্য। এ জন্যই আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন দিয়েছি।’

২০১৪ সাল থেকে বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক ছিলেন অধ্যাপক এ টি এম মঈনুল হোসেন। তিনি এখন ঢাকা কলেজের উপাধ্যক্ষ। একই সময় কলেজ পরিদর্শক ছিলেন ড. আশফাকুস সালেহীন। তিনি এখন এক হাজার ৫০০ মডেল স্কুল উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক। দুজনকেই অনিয়মের অভিযোগে ২০১৮ সালের শেষ দিকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হলেও গত বছর আরো উচ্চ পদে পদায়ন পেয়েছেন। এ ছাড়া সিন্ডিকেটে ছিলেন বোর্ডের সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক আবুল বাসার, সাবেক উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাসুদা বেগম তোফা ও উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. আল মাসুদ করিম। তবে নানা অনিয়মের অভিযোগে আবুল বাসারকে গত ডিসেম্বরে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছে। আর মাসুদা বেগমকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বদলি করা হলেও গত মে মাসে আবার জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে পদায়ন দেওয়া হয়। এরপর আবার বদলি করা হয় ঢাকার বাইরে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভাড়া বাড়িতে চলা প্রতিষ্ঠানে যেহেতু কিছু শিক্ষার্থী পড়ছে, তাই তাদের অনুমোদন বাতিল করতে পারছি না। তবে তাদের শোকজ দিয়েছি, শৃঙ্খলার মধ্যে আনার চেষ্টা করছি। এর পরও ঠিক না হলে নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করব। গত দুই বছরের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পায়নি। তবে তারা কিভাবে অনুমোদন পেয়েছে সে ব্যাপারে আমি বলতে পারব না।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2020/01/15/862629