১৫ জানুয়ারি ২০২০, বুধবার, ২:০৭

ব্রুনাইয়ে থামছে না শ্রমিক নির্যাতন

তিন মন্ত্রণালয়ে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ

ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের লেবার উইং কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রবাসী শ্রমিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। দূতাবাসের ভেতরেই প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের মারধরের একাধিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ব্রুনাইয়ের বাংলাদেশী হাইকমিশন। উপরন্তু দালালীর অভিযোগ এনে সাত ব্যবসায়ীর পাসপোর্ট বাতিল করে তাদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়াও ব্রুনাই থেকে বাংলাদেশ ভ্রমণেচ্ছুকদেরও হয়রানি করছে দূতাবাস। এমন হয়রানির প্রতিকার চেয়ে স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

ব্রুনাই থেকে ফিরে আসা শ্রমিকরা জানান, হাইকমিশনের লেবার উইংয়ে কর্মরতদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারা প্রবাসী শ্রমিক বা ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা না করে উল্টো তাদের শোষণ করে যাচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, নিজেদের দুর্নীতি ও ব্যর্থতা ঢাকতে প্রবাসীদের হয়রানি করছে। প্রবাসী মজুরি সংক্রান্ত জটিলতা কিংবা হয়রানির বিষয়ে হাইকমিশনে অভিযোগ করে কোনো সমাধান পাওয়া যায় না। প্রতিবাদ করলে মিথ্যা, মানবপাচার বা চুরি মামলার আসামি হয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে অনেক শ্রমিককে। হাইকমিশনের দুর্নীতি ও হয়রানির প্রতিবাদ করায় গত অক্টোবর ও নভেম্বরে প্রায় ২০ জন প্রবাসী শ্রমিক ও ব্যবসায়ীকে দেশে ফিরতে বাধ্য করা হয়েছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের দিয়ে ভুয়া অভিযোগ করাচ্ছে লেবার উইং।

ভুক্তভোগীরা জানান, হাইকমিশনের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ করা হলে প্রবাসীদের পাল্টা আক্রমণ এবং নির্যাতনের শিকার হতে হয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় কামরুল নামের এক শ্রমিককে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয় ব্রুনাই হাইকমিশনের ভেতরেই। এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। নির্যাতনের শিকার কামরুল হাসান দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে মামলা উঠানোর জন্য হাইকমিশন থেকে ভয়ভীতি দেখানো হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালের ৭ মার্চ অন্যায়ভাবে হাইকমিশন ভবনে মনির হোসেন নামে একজনকে নির্যাতন করা হয়। ঘুষ না দেয়া এবং অনৈতিক দাবির প্রতিবাদ করায় তাকে পিটিয়ে আহত করা হয়। এ ঘটনায় মনির হোসেন বাদি হয়ে ব্রুনাই ব্রাকাস থানায় মেডিক্যাল রিপোর্টসহ ২০১৮ সালের ৮ মার্চ মামলা করেন। মামলায় নির্যাতনের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। মামলা তুলে নেয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে হুমকি দেয়া হয়। তাতেও মামলা তুলে না নেয়ায় মানবপাচারের সাজানো অভিযোগ করা হয় তার বিরুদ্ধে। পরে তাকে জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।

ভুক্তভোগী মেহেদী হাসান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগে বলেন, সাত বছর ধরে ব্রুনাইয়ে সুনামের সাথে ব্যবসা করে আসছেন। সম্প্রতি হাইকমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা তাদের ঘুষের দাবি না মেটানোয় বিভিন্নভাবে তাকে হয়রানি করেন। তাকে কোনো কিছু না জানিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তাকে এবং ব্রুনাই সরকারের বিভিন্ন দফতরে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে। তার এবং তার কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্রুনাই সরকারের কোনো অভিযোগ না থাকায় পাসপোর্ট বহাল রাখার অনুরোধ জানান তিনি।

নির্যাতনের শিকার ব্রুনাই প্রবাসী ব্যবসায়ী সবুজ মির্জা নামের একজন এ বিষয়ে বলেন, ব্রুনাইতে প্রায় ১৫ বছর ধরে ব্যবসা করছি। সেখানে আমার পুরো পরিবার থাকে। আমার পাঁচটি দোকান ছিল। গত ২৭ অক্টোবর হঠাৎ ব্রুনাই পররাষ্ট্র দফতর জানায়, আমার বিরুদ্ধে অবৈধ মানবপাচার ব্যবসা ও ভিসা জালিয়াতির অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ হাইকমিশন। আমাকে দেশ ছাড়তে বলা হয়। আমাকে দোকান থেকে তুলে নিয়ে ২৮ ও ২৯ অক্টোবর জেলে রেখে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

মানবপাচারসহ বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে দেশে ফেরত এসেছেন এমন কয়েকজন হচ্ছেন আসিফ (পাসপোর্ট নম্বর : ইঋ০৭৮৯৪৬৬), শাহেদ মজুমদার মুন্না (পাসপোর্ট নম্বর : ইঘ০৪৯০২১২), জাকির হোসেন (পাসপোর্ট নম্বর : ইগ০৪২১৮২১), জসিম সরকার (পাসপোর্ট নম্বর : ইজ০৭৭৩৪৬০), সোহরাব খান (পাসপোর্ট নম্বর : ইঔ০৭৩৭৮১৮), মো: মেহেদী হাসান (পাসপোর্ট নম্বর : ইজ০৬৭১৯৫৮), মো: মনির হোসেন, আব্দুর রহিম (পাসপোর্ট নম্বর : ইজ০১৯১৫০৬), মো: ইসমাইল সরদার (পাসপোর্ট নম্বর : ইগ০১৯৩২৭৭), জাজ মিয়া, কামরুল হাসান (পাসপোর্ট নম্বর : ইচ০১২১৪৭৭) এবং মো: আনোয়ার হোসেন (পাসপোর্ট নম্বর : ইঋ০৫৮২৯৬৯)।

নির্যাতিত শ্রমিকদের অভিযোগÑ ব্রুনাই প্রবাসী শ্রমিকরা বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করে কোনো কারণে বেতনভাতাসহ বিভিন্ন বকেয়া না পেয়ে অভিযোগ করেন হাইকমিশনের কাউন্সিলরের (শ্রম) কাছে। ওই সময় সুযোগ বুঝে কাউন্সিলর সিন্ডিকেটের আবু নাঈম কৌশলে অভিযুক্ত কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করে এবং মামলার ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে নেন। কিন্তু ভুক্তভোগী বেশির ভাগ শ্রমিক কোম্পানি থেকে পাওনা টাকা বুঝে পান না। বাংলাদেশের আদালতে করা মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার জন্য ব্রুনাই হাইকমিশন কর্মীদের ভিসা ছাড়পত্রের আবেদন করার পর থেকেই চলে ঘুষের জন্য চাপ সৃষ্টি। কর্মীপ্রতি ছাড়পত্রের জন্য ব্রুনাইয়ে ১৫ ডলার দেয়ার নিয়ম থাকলেও ওই সিন্ডিকেট কর্মীপ্রতি ছাড়পত্রে ৫০০ থেকে ৬০০ ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে। কেউ ছাড়পত্রের জন্য টাকা কম দিতে চাইলে কিংবা বেশি টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে লেবার কাউন্সিলর ছাড়পত্র দেন না, কিংবা তার ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করে দেয়া হয়। ছাড়পত্রের জন্য টাকা না দিয়ে প্রতিবাদ করায় কোম্পানিকে ব্ল্যাকলিস্ট করাসহ নানাভাবে বিতর্কিত করা হয়।

হয়রানির শিকার ব্রুনাইয়ের পর্যটক : হয়রানি থেকে বাদ যাননি বাংলাদেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করতে উৎসাহী ব্রুনাইয়ের নাগরিকও। গত বছর ব্রুনাই থেকে বাংলাদেশ ভ্রমণের জন্য ভিসার আবেদন করেন মালয়েশিয়ান নাগরিক সারাহ বিনতে ওকিল (পাসপোর্ট নং- ঐ৬০৯৮৫৪১০)। বাংলাদেশ দূতাবাস সেই ভিসা দেয়ার জন্য পাসপোর্টে স্ট্যাম্পিংও করে। কিন্তু ভিসা না দিয়ে সেই স্ট্যাম্পিং ক্যানসেল করা হয়। দ্বিতীয়বারও একইভাবে স্ট্যাম্পিং ক্যানসেল করে বাংলাদেশ দূতাবাস। ব্রুনাইয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এয়ার ভাইস মার্শাল (অব:) মাহমুদ হোসেনের সাথে এ নিয়ে মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তার ড্রাইভার জামাল ফোন রিসিভ করে বলেন, স্যার মিটিংয়ে আছেন।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/472306/