১২ জানুয়ারি ২০২০, রবিবার, ১১:১২

আস্থাহীনতায় পুঁজিবাজার

তলানীতে লেনদেন : মূলধন হারিয়ে নিঃস্ব বিনিয়োগকারীরা

দীর্ঘদিন থেকেই শেয়ারবাজারে চরম মন্দাভাব চলছে। সরকারের জন্য শেয়ারবাজার যেন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ধস নামার পর বাজার স্বাভাবিক ধারায় আনতে চেষ্টা চলছে। গত কয়েক মাসে বিনিয়োগকারীদের নানা আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা দেয়া হয়েছে। তারপরও ২০১৯ সালের মন্দাভাব দিয়ে পতনের মধ্যেই শরু হয়েছে ২০২০ সাল। কোনো সুবিধাই যেন কাজে আসছে না। দরপতনের ধাক্কায় ছোট-বড় সব বিনিয়োগকারী হতাশ-ক্ষুব্দ। শেয়ারবাজারের প্রধান সূচকটি নেমে এসেছে ৪ হাজার ২০০ পয়েন্টের নিচে। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন অনেক বিনিয়োগকারী। দরপতনের কবলে পড়ে গত এক সপ্তাহে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে বিনিয়োগকারীদের ১৭ হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে। একই সঙ্গে বড় পতন হয়েছে মূল্যসূচকের, দেখা দিয়েছে লেনদেন খরাও। গত সপ্তাহজুড়ে লেনদেন হওয়া পাঁচ কার্যদিবসেই লেনদেনে অংশ নেয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে। সপ্তাহ শেষে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। সা¤প্রতিক সময়ে এক সপ্তাহে এতো বড় দরপতন শেয়ারবাজারে হয়নি। অপরদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১১০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১২ হাজার ৭৭৬ পয়েন্টে।

অথচ বিশ্বের সব শেয়ার বজারেই ভালো অবস্থা। পাকিস্তানের শেয়ারবাজারে শেয়ারের সূচক ১১ হাজার পয়েন্টের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। ভারতের শেয়ার বাজারের সূচকও প্রতিদিন বাড়ছে। শুধু বাংলাদেশেরটাই উল্টো পথে চলছে। যদিও গত বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, বিনিয়োগ করে কেউ ঠকবে না। অবশ্যই লাভবান হবেন। এ জন্য বিনিয়োগকারীদের পক্ষে কিছু বাস্তব সিদ্ধান্তও নেন। কিন্তু আস্থাহীনতায় অর্থমন্ত্রীর সেই আশ্বাসের কোন কিছুই পাচ্ছে না বিনিয়োগকারীরা। এছাড়াও কয়েক বছরে শেয়ারবাজার ইস্যুতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কয়েক দফায় আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। বর্তমান ও সাবেক অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেছেন। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেও বৈঠক করে সমস্যার কথা শুনেছেন। বাজারের জন্য সহায়ক হতে পারে এমন পদক্ষেপ নিতে বলেছেন।

সরকারের এমন আন্তরিক প্রচেষ্টার পরও শেয়ারবাজার সংকটের সমাধান না হওয়ার কারণ কী- এমন প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অনেক পদক্ষেপই সময়মতো নেওয়া হয়নি। বিনিয়োগকারীদের জন্য আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়নি। আর এ কারণে নতুন করে কেউই বাজারে বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছেন না। এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা একের পর এক মানহীন কোম্পানীর নতুন আইপিওর অনুমোদন এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে চরম সমন্বয়হীনতা। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুঁজিবাজারে। তাদের মতে, সবার আগে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো জরুরি। বাজে কোম্পানি বাজারে আনা বন্ধ করতে হবে। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে নিবিড় সমন্বয় দরকার। শুধু নিজেরা নিজেরা সমন্বয়ের কথা বললে হবে না। বিনিয়োগকারীরা যাতে বুঝতে পারে সরকারের সব সংস্থা শেয়ারবাজারের উন্নয়নে আন্তরিক, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রফেসর আবু আহমেদ বলেন, যখনই দরপতন মাত্রা ছাড়িয়েছে, সমালোচনার ঝড় উঠেছে, তখনই সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে উঠেছেন। দফায় দফায় মিটিং-সিটিং করেছেন। বেশিরভাগ সময় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার বাস্তব কার্যকারিতা ছিল না বা বিলম্বে সিদ্ধান্ত হয়েছে, কার্যকর হয়েছে আরও পরে। তার থেকেও বড় কথা, শেয়ারবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কোনো অগ্রগতিই হয়নি।

তিনি বলেন, সমস্যাগ্রস্ত শেয়ারবাজারকে স্বাভাবিক ধারায় আনতে দক্ষতা, সততা এবং প্রয়োজনে কঠোরতার মাধ্যমে পরিচালনার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থায় যে নেতৃত্বের দরকার ছিল, সরকার তা নিশ্চিত করতে পারেনি। কিছু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়ম, এমনকি আইন করে স্বার্থানেষী মহলকে সুবিধা করে দেওয়ার অভিযোগ আছে।

ডিএসই ব্রোকার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আহমেদ রশীদ লালী বলেন, খুবই খারাপ অবস্থা। বাজার যে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে কিছুই বুঝতে পারছি না। লেনদেন শুরু হলেই বাজার পড়ছে। ছোট-বড়, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ভালো-মন্দ সব শেয়ারের দামই কমতে কমতে একেবারেই শেষ প্রান্তে নেমে এসেছে। এটা বড় উদ্বেগের বিষয়। তিনি বলেন, আসলে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের কোনো আস্থা নেই। অর্থনীতির অবস্থাও ভালো না। মানুষের হাতে টাকাও নেই। সবমিলিয়েই বাজারের খারাপ অবস্থা কাটছে না।

বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর কি কোনো সম্ভাবনা নেই- এ প্রশ্নের উত্তরে আহমেদ রশীদ লালী বলেন, একমাত্র উপায় আছে, সরকারের সাপোর্ট। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে যে ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল চাওয়া হয়েছিল সেটা দ্রুত দিয়ে এখন বাজার স্বাভাবিক করতে হবে। একই সঙ্গে এই ১০ হাজার কোটি টাকা শুধু আইসিবিকে দিলে হবে না। ভালো ভালো ব্রোকার হাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকেও দিতে হবে।

আনোয়ারুল ইসলাম নামে এক বিনিয়োগকারী জানান, আগে দেখেছি, দেশের বিনিয়োগকারীরা যখন বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন তখন বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ত। পরে তাদের দেখাদেখি স্থানীয়রাও একটু একটু করে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতেন। এবার দেখলাম সারা বছর বিদেশি বিনিয়োগ কমছে। তাতে দেশের বিনিয়োগকারীরা বাজার নিয়ে আরও বেশি আস্থাহীনতায় ভুগছে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া মাত্র ৩৪টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৩১০টির। আর ১৩টির দাম অপরিবর্তিত। অর্থাৎ সপ্তাহজুড়ে ৮৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে।

দরপতনে সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২৩ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। যা আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক সপ্তাহে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ১৭ হাজার ১৬১ কোটি টাকা।

সূত্র মতে, দরপতনের মধ্যেই গত ২ জানুয়ারি পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠকে বসেন অর্থমন্ত্রী মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এই বৈঠকের পর বাজার ফিরবে প্রত্যাশা করেছিল বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু এরপর পতন আরো বেগবান হয়েছে।

২০১০ সালে বড় ধসের পর পুঁজিবাজারে সবচেয়ে ‘খারাপ’ অবস্থা গেছে ২০১৯ সাল। তাই ছোট-বড় সব বিনিয়োগকারীরই প্রত্যাশা ছিল নতুন বছরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ভালো হবে। কিন্তু তার বদলে বড় পতন হচ্ছে বাজারে। এই অবস্থায় গত বুধবার ফের রাস্তায় নেমেছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। মতিঝিলে ডিএসই ভবনের সামনে মুখে কালো কাপড় বেঁধে বিক্ষোভ করেছেন তারা।

সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ডুবতে থাকা পুঁজিবাজারকে টেনে তুলতে বা বাজার স্বাভাবিক রাকতে পাঁচ সদস্যের কমিটি করেছে সরকার। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মাকসুরা নুরকে কমিটির সমন্বয়ক করা হয়েছে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হলেও গত মঙ্গলবার কমিটি গঠন করা হয়।

এদিকে অভিযোগ রয়েছে, বাজারে চাহিদা না থাকার পরও নিয়ন্ত্রক সংস্থা একের পর এক মানহীণ কোম্পানির নতুন আইপিওর অনুমোদন দিয়েছে। এ কারণে তালিকাভুক্তির পর কিছুদিন না যেতেই এসব কোম্পানির আয় কমতে থাকে। অনেকগুলোর দাম অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে। কিছু কোম্পানিতো বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয় না।

আব্দুর রহিম নামে এক বিনিয়োগকারী বলেন, আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানিগুলো বাজার থেকে টাকা লুটপাট করে নিয়ে গেছে। যার প্রভাব সেকেন্ডারি মার্কেটে পড়েছে। আর সে কারণে পুঁজি হারিয়ে বিপাকে পড়েছে বিনিয়োগকারীরা। একই সঙ্গে বাজার পতনের জন্য তিনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে চরম সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেন। তার মতে, এক সংস্থার পদক্ষেপ সম্পর্কে অন্য সংস্থা জানে না। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শেয়ারবাজারে।

বাজারের এই পরিস্থিতিতে হতাশা প্রকাশ করে ডিএসই’র শেয়ারহোল্ডার পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে সব শেয়ারের দাম অনেক কমে গেছে। বলা যায়, একেবারে তলানীতে। এই দামে শেয়ার কিনলে ভালো মুনাফা হবে। সে আশায় সবার শেয়ার কেনার কথা। অথচ কেউ শেয়ার কিনছে না। কারো হাতে টাকা নাই। যাদের সাপোর্ট দেয়ার কথা আইসিবি; তারাও কিনছে না। সবাই ট্রেডার হয়ে গেছে। কেউ বিনিয়োগ করছে না। সে কারণেই এই করুণ দশা বাজারের।

শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন বলেছেন, গত কয়েক মাসে বড় কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে। এগুলো হল- গ্রামীণফোন, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, স্কয়ার ফার্মা এবং ইউনাইটেড পাওয়ার। সামগ্রিকভাবে বাজারে এর প্রভাব পড়েছে।

ড. খায়রুল হোসেন বলেন, সম্প্রতি বাজারের সূচক কমছে। এর অনেক কারণ রয়েছে। অন্যতম হল-প্রাক বাজেট আলোচনায় এনবিআর চেয়ারম্যান বলেছিলেন, বিও অ্যাকাউন্ট (বেনিফিশিয়ারি ওনার) খুলতে টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) লাগবে। এর পর থেকেই সূচক কমতে থাকে। পরবর্তীতে কর পরিশোধ নিয়ে গ্রামীণফোনের সঙ্গে বিটিআরসির দ্ব›েদ্ব কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কমেছে। এছাড়াও বিভিন্ন কারণে আরও কয়েকটি বড় কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে। এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম কমলে সামগ্রিকভাবে বাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

https://www.dailyinqilab.com/article/260255/