১২ জানুয়ারি ২০২০, রবিবার, ১১:০৮

পলিথিনে পরিবেশ বিপর্যয়

নিষিদ্ধ হলেও পুলিশের সামনেই উৎপাদন ও বিপণন

উৎপাদন, বিপনন, ব্যবহার নিষিদ্ধ; অথচ সবার হাতে হাতে পলিথিন। নিত্যদিনের বাজার সদাই মানেই পলিথিনের ব্যবহার। নিধিদ্ধ পলিথিনে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটেছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের পরিবেশের। ঢাকা শহর এখন বিশ্বের এক নম্বর বায়ূ দুষণের শহর। দোকানে আইন শৃংখলা বাহিনীর চোখের সামনে পলিথিনের স্তুপ, আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতেও শোভা পায় পলিথিনের ব্যাগ: অথচ আইন করে সর্বনাশা পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ আইনের কঠোর ব্যবহারে ২০০২-৩ সালেও পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হয়েছিল।

কিন্তু ২০১০ সালের পর ক্রমান্বয়ে পলিথিনের ব্যবহার বেড়ে যায়। জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. এ কে এম রফিক আহমেদ বলেন, পলিথিনসহ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সব কিছুর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। শুধু ঢাকায় নয় সারাদেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাট-বাজরে পলিথিনের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে।

পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক পলিথিন উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরও অবাধে চলছে পলিথিনের উৎপাদন ও বিপনন প্রক্রিয়া। দৈনন্দিন জীবনের সব কাছে চলছে পলিথিনের ব্যবহার। নিত্যদিনের বাজার সদাই থেকে শুরু করে এক টাকা দামের চকলেট হোক বা লাখ টাকার ফ্রিজ সব কিছুর সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে পলিথিন। এসব পলিথিন ব্যবহারের পর যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হচ্ছে। অপচনশীল পলিথিনে ভরাট হচ্ছে পয়োনিষ্কাশনের নালা-নর্দমা। আর তাতে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।

ধূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এ ছাড়া চাপা পড়া পলিথিন নষ্ট করছে মাটির গুণাগুণ। পলিথিন বা প্লাস্টিক বর্জ্যে নদী থেকে সাগরের পানি পর্যন্ত দূষিত হচ্ছে। ঢাকা এবং ঢাকার আশপাশে নিষিদ্ধ এই পলিথিনের উৎপাদন চলছে অনেকটা নির্বিঘেœ। পুরান ঢাকার ইসলামবাগ, যাত্রাবাড়ি, কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় পলিথিন কারখানা আছে ভুরি ভুরি। মাঝে মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর বা বিভিন্ন সংস্থার ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালালেও ক’দিন যেতে না যেতেই আবার স্বাভাবিকভাবেই সেসব কারখানা আবার চালু হয়।

সর্বনাশা এই পলিথিন বা প্লাস্টিক (একবার ব্যবহার যোগ্য) সামগ্রী এক বছরের মধ্যে বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে হাইকোর্ট। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি সম্প্রতি সর্বনাশা পলিথিনের ব্যবপক ব্যাবহারের ফলে পরিবেশের যে মারাত্মক দূষন হচ্ছে তা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে পরিবেশের বিষ পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট বিভাগের কার্যক্রম আরও জোরদার এবং প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানি করে রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানির ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র না দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর সে আলোকে কাজ করছে। পলিথিন উৎপাদন ও বিপননের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান সারা দেশে অব্যাহত রয়েছে। অভিযানের পাশাপাশি এ বিষয়ে জনসচেতনা বৃদ্ধির কার্যক্রমও শুরু হচ্ছে।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. এ কে এম রফিক আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, পলিথিনসহ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সব কিছুর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। শুধু ঢাকায় নয় সারাদেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাট-বাজরে পলিথিনের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে। আগের চেয়ে পলিথিনের ব্যবহার অনেক কমেছে। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে অভিযানের পাশাপাশি জনসচেতনতাও প্রয়োজন। জনগণ সচেতন হলে পরিবশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক এই পলিথিনের ব্যবহার শিগগিরই বন্ধ করা সম্ভব হবে।

পলিথিন আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। স্বাভাবিকভাবে পলিথিন পঁচনশীল নয়। ব্যবহৃত পলিথিনের পরিত্যক্ত অংশ দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত ও অবিকৃত থেকে মাটি, পানি ইত্যাদি দূষিত করে। পলিথিন মাটির উবর্বরতা হ্রাস করে ও মাটির গুনাগুন পরিবর্তন করে ফেলে। পলিথিন পোড়ালে এর উপাদান পলিভিনাইল ক্লোরাইড পুড়ে কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন হয়ে বাতাস দূষিত করে পলিথিনের ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিস শহরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ‘নারডল’ নামক এক প্রকার প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রের পানিতে মিশে পানি দূষিত হচ্ছে। এতে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়ছে। পলিথিন ও বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য ব্যাপকভাবে ব্যবহারে সারাদেশে খাল-বিল, নদী-নালা থেকে শুরু করে সমুদ্র্র পর্যন্ত প্লাস্টিক ছড়িয়ে পড়ছে। এতে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। সেই সাথে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। প্লাস্টিক শুধু আসবাবপত্র বা পলিথিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমানে নামিদামি কসমেটিক কোম্পানির সাবান, ফেসওয়াস, টুথপেস্ট, বডিওয়াস, ডিটারজেন্ট, বিস্কিট , চানাচুর, চিফস, মশলা ইত্যাদিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্যাদির মোড়কে মাইক্রোবিড নামক ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি দেখা যায়। যা ব্যবহারের পর নদী-নালা, খাল-বিল ও অন্যান্য জলাশয়ে যাচ্ছে এবং মাছের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করছে। আর এর ফলে চর্মরোগসহ মারাত্মক ক্যান্সার পর্যন্ত হচ্ছে।

পলিথিন তৈরির চেয়ে আরও ভয়াবহ ক্ষতিকর হচ্ছে পুরানো পলিথিন পুরিয়ে এর থেকে আবার নতুন পলিথিন বা প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরী করা। ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া পুরনো পলিথিন বা পানির বোতল কুড়িয়ে এনে তা গলিয়ে আবারও বানানো হচ্ছে নতুন ব্যাগ। এতে পরিবেশ আরও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গাবতলী বেড়িবাঁধের ¯øুইস গেট এলাকায় পুরনো পলিথিন ব্যাগ বা প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ এবং বাছাইয়ের কাজ করেন অনেকে। ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া নোংরা পলিথিন ব্যাগ বা বোতল তারা সংগ্রহ করেন। সেগুলো বাছাই ও পরিষ্কার করে একত্রে রাখেন। আর এই কাজের জন্য একেকজন শ্রমিক মাসিক পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা বেতন পান। এসব পলিথিন বা কুড়ানো বোতল পুরান ঢাকার ইসলামবাগসহ বিভিন্ন এলাকার কারখানায় পাঠানো হয়। সেখানে পুরনো পলিথিন গলিয়ে তা দিয়ে আবার তৈরি করা হচ্ছে নতুন পলিথিন ব্যাগ। এতে করে বায়ুদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করছে। পুরানো ঢাকার অসংখ্য কারখানায় পুরানো পলিথিন বা প্লাস্টিক সামগ্রি পুরানোর ফলে বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকা বার বার বিশ্বের মধ্যে শীর্ষে জায়গা করে নিচ্ছে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর স¤প্রতি প্রকাশিত তথ্যে উল্লেখ করা হয়, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরির প্রায় এক হাজার ২০০ কারখানা রয়েছে। যার বেশির ভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। শুধু পুরান ঢাকার অলিগলিতে আছে ৫শতাধিক কারখানা। সংস্থাটির দেওয়া তথ্যমতে, কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, টঙ্গীতে ছোট-বড় বেশকিছু কারখানা আছে। আর যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে কয়েকশ’ কারখানা।

ঢাকার পলিথিন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আছে একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। পলিথিন বাজারজাতকরণে ‘পরিবহন সিন্ডিকেট’ নামে আরেকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে। সিন্ডিকেটটি এই পলিথিনগুলো ‘জরুরি রপ্তানি কাজে নিয়োজিত’ লেখা ট্রাকে করে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দেয়। এমনকি পণ্য বহনে পরিবেশবান্ধব পাটজাত ব্যাগ ও কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করার কথা থাকলেও আইন অমান্য করে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ, উৎপাদন, মজুদ, বাজারজাত ও ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে রপ্তানিযোগ্য কিছু পণ্য, প্যাকেজিং, নার্সারির চারা, রেণু পোনা পরিবহন ও মাশরুম চাষের জন্য পলিথিন উৎপাদনের ছাড়পত্র নিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পলিথিন ব্যাগ তৈরি করছে।

ক্ষতিকর জানলেও দিন দিন এই ব্যাগের ব্যবহার বেড়েই চলছে, যা পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে হুমকির দিকে। এ বিষয়টি সবাই জানলেও কার্যত তেমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। ২০০১-২সালে তৎকালীন সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রী শাহজাহান সিরাজ পলিথিনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এর উৎপাদন ও বিপনন প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছিল। এরপর সরকার পরিবর্তনের পর ধীরে ধীরে আবারও পলিথিনের উৎপাদন ও এর ব্যবহার শুরু হয়। যা বর্তমানে ব্যাপক আকারে রূপ নিয়েছে।

২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করা হয়। আইন বলছে, ‘সরকার নির্ধারিত পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণে প্রথম অপরাধের দায়ে অনধিক দুই বছরের কারাদন্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা জরিমানা। আবার উভয়দন্ড হতে পারে। আবার পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধী অন্য‚তম দুই বছর, অনধিক ১০ বছরের কারাদন্ড বা অন্য‚তম দুই লাখ টাকা, অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন। বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও রয়েছে শাস্তির বিধান। এক্ষেত্রে অনধিক এক বছরের কারাদন্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে। পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের দায়ে অন্য‚নম দুই বছর, অনধিক ১০ বছরের কারাদন্ড বা অন্য‚তম দুই লাখ টাকা, অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন অপরাধীরা।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান এ বিষয়ে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধে আইন থাকলেও এর কার্যকারিতা একেবারেই নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের আন্তরিকতা ও জবাবদিহিতার অভাবই এর মূল কারণ। পলিথিন বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর পুরোপুরি ব্যর্থ। তাদের ব্যর্থতার জন্য জাতি আজ নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। পলিথিন দূষণ আমাদের ভূমি, নদী-সাগর সব বিষাক্ত করছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার কারণে নিষিদ্ধ পলিথিন এখনো অবাধে উৎপন্ন ও বাজারজাত হচ্ছে। রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় এক হাজার ২০০ কারখানায় নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরি হচ্ছে। এগুলোর বেশির ভাগই ঢাকা কেন্দ্রিক।

https://www.dailyinqilab.com/article/260290/