১২ জানুয়ারি ২০২০, রবিবার, ১০:৫১

এলাচের কেজি এখন ৬০০০ টাকা

বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেইমুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে বাজার ব্যবস্থা। প্রত্যেকটি পণ্যের দামই হু হু করে বাড়ছে। পণ্যের দাম চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। এর বাইরে নেই মসলা জাতীয় পণ্যও। বাংলাদেশের বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অন্যান্য পণ্যের মতো এই মুহুর্তে গরম মসলার উত্তাপে ক্রেতা সাধারণের নাভিশ্বাস চরমে। পেঁয়াজের ঝাঁঝে ক্রেতাদের চোখের পানি এখনো ঝরছে। সকল প্রকার মসলার দাম বেড়েছে। তবে অসহনীয় মাত্রায় বেড়ে সহ্য ক্ষমতার অনেক বাইরে চলে গেছে এলাচের দাম। খুচরা দোকানে ক্ষেত্রবিশেষে ৩০ টাকার এলাচ কিনলে পাওয়া যাচ্ছে ১৫-২০টি। এতে একটি এলাচের দাম পড়ছে ২ টাকা করে। অবিশ্বাস্যভাবে দফায় দফায় দাম বেড়ে এলাচের কেজি এখন ৬০০০ টাকা। এছাড়া জিরা, দারুচিনি, গোলমরিচের দামও বেড়েছে। পাশাপাশি আদা ও রসুনের দামও বেড়েছে। মালিবাগ, রামপুরা, হাতিরপুল, কাওরান বাজারসহ রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এবং টিসিবি, ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গতকাল শনিবারের তথ্য অনুযায়ী প্রতিকেজি এলাচ বিক্রি হচ্ছে ৬০০০ টাকা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে অতিপ্রয়োজনীয় এই মসলাটির দাম বেড়েছে কেজিতে ১৫০০ টাকা। এক সপ্তাহ আগে প্রতিকেজি এলাচ বিক্রি হয়েছে ৩৫০০ টাকা। আর এক মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ২৪০০ টাকা। এক মাস আগেও প্রতিকেজি এলাচ বিক্রি হয়েছিল সর্বোচ্চ ৩৬০০ টাকা দরে। আর এক বছর আগে এ মসলাটি দাম ছিল প্রতিকেজি সর্বোচ্চ ২০০০ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এলাচের দাম কেজিতে বেড়েছে ৪০০০ টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বাজারের উপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রত্যেকটি পণ্যের দামই হুহু করে বাড়ছে। পণ্যের দাম চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। এর বাইরে নেই মসলা জাতীয় পণ্যও। অন্যান্য পণ্যের মতো এই মুহুর্তে গরম মসলার উত্তাপে ক্রেতা সাধারণের নাভিশ্বাস চরমে। বাজার নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে সাধারণ মানুষের ক্রোধের আগুনে পুড়তে হবে সরকারকে। এই মুহুর্তে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকারের জন্য বুমেরাং হবে।

তারা বলছেন, ইতোমধ্যে ক্রেতারা বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। পেঁয়াজ নিয়ে ঘটেছে হুলুস্থুল কান্ড। বেড়েছে ভোজ্য তেলের দাম। অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়েই চলেছে। ক্রমেই পণ্যের দাম মধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। আয়ের সাথে ব্যয়ের ব্যবধান বাড়ছে। এ অবস্থা থেকে বের হওয়া জরুরী।

এদিকে দফায় দফায় বাড়ছে এলাচের দাম। মাসের ব্যবধানে এলাচের দাম বেড়েছে ৬৭ শতাংশ। আর বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২১০ শতাংশ। মাস বা বছর নয় সপ্তাহের ব্যবধান ধরলেও এলাচের দাম বেড়েছে ১৫০০ টাকা। দফায় দফায় দাম বেড়ে এখন রাজধানীর বাজারে এই পণ্যটির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০০০ টাকা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এখন অনেক ব্যবসায়ী ১০-২০ টাকায় এলাচ বিক্রি করতে চাচ্ছেন না। এতে বিড়ম্বনায় পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। খুচরা দোকানে ক্ষেত্রবিশেষে ৩০ টাকার এলাচ কিনলে পাওয়া যাচ্ছে ১৫-২০টি। এতে একটি এলাচের দাম পড়ছে ২ টাকা করে। এলাচের এমন দাম বাড়ার কারণ হিসেবে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারিতে দাম বাড়ার কারণে তারা দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে। সেই সঙ্গে কমেছে সরবরাহ।

এ কারণে এলাচের দাম বেড়েছে। বিভিন্ন খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯ সালের শুরুর দিকে এলাচের কেজি ছিল ১৩০০-১৪০০ টাকার মধ্যে। তবে জানুয়ারির মাঝামাঝি এ পণ্যটির দাম বেড়ে ১৫০০-১৬০০ টাকায় ওঠে। এরপর রোজার ঈদকে কেন্দ্র করে মার্চে এই মসলাটির দাম ১৮০০-২০০০ টাকায় পৌঁছে যায়। অবশ্য এখানেই থেমে থাকেনি মাংস রান্নার অপরিহার্য এলাচের দাম বাড়ার প্রবণতা। কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে হু হু করে বাড়তে থাকে পণ্যটির দাম। ফলে ২০১৯ সালের আগস্টে এলাচের কেজি ৩০০০ টাকায় পৌঁছে যায়। কোরবানির ঈদের পরও বাড়তে থাকে এলাচের দাম। গত বছরের ডিসেম্বরে এ পণ্যটির দাম বেড়ে ৪ হাজার টাকায় পৌঁছে। ২০১৯ সালজুড়ে দফায় দফায় দাম বাড়ার প্রবণতা চলতি বছরের শুরুতেও অব্যাহত। বছরের প্রথম ১১ দিনই অবিশ্বাস্যভাবে কেজিতে এলাচের দাম বেড়েছে ২ হাজার টাকা।

ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যেও। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, এক বছর আগে এলাচের কেজি ছিল ১৫৫০-২০০০ টাকা। দফায় দফায় দাম বেড়ে শনিবার (১১ জানুয়ারি) পণ্যটির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০০০-৬০০০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৪০০০-৪৫০০ টাকা এবং এক মাস আগে ছিল ৩০০০-৩৬০০ টাকা কেজি। রাজধানীর মধুবাগের বাসিন্দা মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার বাজারে গরম মসলা কিনতে গিয়ে দোকানির কাছে ২০ টাকার এলাচ চাই। দোকানি বলেন, ভাই ২০ টাকার এলাচ দেয়া সম্ভব নয়। এখন এলাচের অনেক দাম। কমপক্ষে ৩০ টাকার নিতে হবে। এরপর ৩০ টাকার এলাচ নিলে দোকানি মাত্র ১৬টি দেন। দোকানিকে বললাম, ভাই এ কয়েকটা দিলেন। উত্তরে দোকানি বলেন, ভাই মাপে নিলে আরও কম পাবেন। ৩০ টাকার এলাচ হাতে দু:খে হেসেছি আর ভেবেছি এও সম্ভব। কি সেলুকাস বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ। আকশ ছোঁয় এ দামেও কেউ উচ্চবাচ্য করছে না। অথচ আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের এখন সংসার চালানোই চ্যালেঞ্জের মুখে। তিনি বলেন, বাজারে একের পর এক জিনিসের দাম বাড়ছে। কিন্তু দাম বাড়ার প্রবণতা ঠেকানো কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। ছোট একটা এলাচের দাম ২ টাকা পড়ছে। বড় এলাচ হলে তো দাম আরও বেশি পড়বে। বিষয়টি একটু চিন্তা করে দেখেন। এটা কীভাবে স্বাভাবিক হয়। এভাবে পণ্যের দাম বাড়ার কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু সবাই অসহায় কেউ কিছু বলতে পারছে না। সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি দেখা উচিত।

মালিবাগে বসবাসকারী সালেহা বেগম বলেন, আগে ১০ টাকার এলাচ কিনলে ১৫-২০টি পাওয়া যেত। এখন ১০ টাকা তো দূরের কথা ২০ টাকা দিয়েও এলাচ কেনা যায় না। অনুরোধ করলে ব্যবসায়ীরা ২০ টাকায় ৮-১০টি এলাচ দেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে মাংস রান্না করলে নামমাত্র এলাচ দেই। এতো দাম হলে এলাচ কিনে খাবো কীভাবে?

রামপুরার ব্যবসায়ী সামছুল আলম বলেন, পাইকারিতে আমরাই এক কেজি এলাচ কিনছি ৫ হাজার টাকায়। এ দামে কিনে কতই বিক্রি করব আপনিই বলেন? আগে বেশিরভাগ ক্রেতাই ১৫-২০ টাকায় এলাচ কিনতেন। এখন এলাচের যে দাম ২০ টাকার এলাচ ওজনে বিক্রি করলে ৫-৬টা হবে। তাহলে ২০ টাকার এলাচ বিক্রি করা কি সম্ভব?

এলাচের এই দামের বিষয়ে বাংলাদেশ পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. এনায়েত উল্লাহ জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে এলাচের দাম বেড়ে গেছে। ভারতেও এলাচের দাম বাড়তি। সরবরাহ কমে গেছে। এ কারণেই এলাচের দাম বেড়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, তাদের কাছে অভিযোগ রয়েছে মধ্যবিত্তরা তাদের জমানো টাকা ভেঙ্গে খাওয়া শুরু করেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে মধ্যবিত্তের কাছে যে জমানো টাকা আছে তা শেষ হয়ে যাবে। তারা বলছেন, নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। তাদের আয় দিয়ে তিন বেলা খাওয়ার টাকাও যোগাড় হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে বেড়ে যাবে সামাজিক অস্থিরতা। বিপজ্জনক অবস্থানে পৌঁছার আগেই সরকারের এদিকে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।

https://www.dailysangram.com/post/403146