পুলিশের পোশাকে আটক ছিনতাইকারী শামীম
৮ জানুয়ারি ২০২০, বুধবার, ৩:৩১

আতঙ্কের নাম নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোড

আতঙ্কের নাম নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোড। প্রায় আট কিলোমিটা দীর্ঘ এই সড়কটি দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে যাত্রী সাধারণদের কাছে। ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বারবার আলোচনায় এসেছে সড়কটি। সর্বশেষ গত শনিবার বিকালে এ সড়কের ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে পুলিশের পোশাক পরিহিত ছিনতাইকারী চক্র একটি মাইক্রোবাস ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। ছিনতাইকারীরা গাড়িটি ছিনতাইয়ে সফলও হয়। তবে গাড়ির চালকের বুদ্ধিমত্তায় ধরা পড়ে যায় পুলিশের পোশাক পরা শাহিন ওরফে শামীম নামে এক ছিনতাইকারী। অথচ ঘটনাস্থলের খুব কাছেই ছিল ফতুল্লা পুলিশের একটি পুলিশ বক্স। তবে ছিনতাইকারীরা মেট্রোপলিটন এলাকার পুলিশ পোশাক পরিহিত ছিল।

যে স্থান থেকে পুলিশের পোশাক পরে মাইক্রোবাসটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করা হয়, ছয় বছর আগে একই স্থান থেকে সাত খুনের ঘটনায় নিহত সাতজনকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েই তুলে নেয়া হয়েছিল। এছাড়া প্রায়ই সড়কটির কোন না অংশে অপরাধ সংঘটিত অব্যাহত রয়েছে। এরমধ্যে ছিনতাই ঘটনার সংখ্যা আশঙ্কাজনক।

পুলিশের একাধিক চেকপোস্ট, সিসিটিভি ক্যামেরা এবং টহল পুলিশও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোডের এই ৮ কিলোমিটার রাস্তাকে নিরাপদ রাখতে পারছে না। নিরাপত্তার এসব ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে অপরাধীরা ঠিকই তাদের কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের ১৬ই এপ্রিল ব্যবসায়ী আবু বকর লিটুকে অপহরণের ঘটনা এবং একই বছরের ২৭শে এপ্রিল ৭জনকে অপহরণ করে খুনের পর সারাদেশে আলোচনায় চলে আসে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোডের এই ৮ কিলোমিটার রাস্তা। এই লিঙ্ক রোড থেকে ব্যবসায়ী লিটু অপহরণ, দৃক গ্যালারির প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইরফানুল ইসলামের লাশ উদ্ধার হলেও ওইসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের এখনও শনাক্ত বা ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।

২০১৯ সালের ৭ই মার্চ দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের শিবু মার্কেট এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে উঠে ফতুল্লার পাগলার নন্দনাইলপুর এলাকার প্রাইম টেক্সটাইল মিলের কর্মকর্তা আতাউর রহমানের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের সময় জনতার হাতে আটক হয় জুয়েল (৩০) ও জামাল হোসেন (৩৮) নামে দুই ছিনতাইকারী।

২০১৭ বছরের ২২শে মে সকাল ১০টার দিকে লিঙ্ক রোডের ভূঁইগড় এলাকায় গুলি করে সিঙ্গার প্লাস শোরুমের ব্যবস্থাপক নূর আহমেদ সোহেলের কাছ থেকে ১ লাখ ৭৪ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় মোটরসাইকেল আরোহী তিন ছিনতাইকারী। একই বছরের ৩১শে জুলাই বেলা পৌনে ১টার দিকে নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের রঘুরাথপুরে পুলিশের চেকপোস্টে বন্ধু পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসে তল্লাশিকালে গুলি ছুড়ে পালিয়ে যায় দুই সন্ত্রাসী। এসময় সন্ত্রাসীদের ফেলে যাওয়া ৬ রাউন্ড নাইনএমএম এর তাজা গুলি ও এক রাউন্ড গুলির খোসা উদ্ধার করে পুলিশ। একই বছরের ৮ই সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের শিক্ষানবিশ সাংবাদিক শাহরিয়াজ মাহমুদ শুভ্রর লাশ উদ্ধার করা হয় এ সড়কের পাশের একটি ডোবা থেকে। ছিনতাইকারীরা তাকে হত্যার পর লাশ ডোবায় ফেলে দেয়।

২০১৬ সালের ৩রা এপ্রিল ঢাকার দৃক গ্যালারির প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইরফানুল ইসলামের লাশ লিঙ্ক রোডের জালকুঁড়ি এলাকার একটি ডোবা থেকে উদ্ধার করা হয়। তার হত্যার সঙ্গে কারা জড়িত তা আজও অজানাই রয়ে গেছে। একই বছরের ২৭শে অক্টোবর লিঙ্ক রোডে দিনে দুপুরে যাত্রীবাহী বাসের গতিরোধ করে ২ যাত্রীর কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা।

২০১৫ সালের ৩রা আগস্ট রাত পৌনে ১০টায় লিঙ্ক রোডের মাহমুদ নগর এলাকায় চলন্ত যাত্রীবাহী বাসের সামনে বোমা ফাটিয়ে বাসের গতিরোধ করে নুরুল ইসলাম (৪০) নামে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২০১৪ সালের ১৬ই এপ্রিল দুপুরে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক লিটুকে এ লিঙ্ক রোড থেকেই অপহরণ করা হয়েছিল। তবে ৩৫ ঘণ্টা পর অপহরণকারীরা লিটুকে ঢাকার মিরপুরে আনসার ক্যাম্পের সামনে নামিয়ে দিলেও সে ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত তা এখনও পুলিশ উদঘাটন করতে পারেনি। এদিকে, গত শনিবার যে স্থান থেকে পুলিশের পোশাক পরে মাইক্রোবাসটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা হয়, গত পাঁচ বছর আগে একই স্থান থেকে সাত খুনের ঘটনায় নিহত সাতজনকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছিল।

নারায়ণগঞ্জ পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। নিয়মিত রিপোর্টও পেশ করা হচ্ছে।

ফতুল্লা মডেল থানার ওসি আসলাম হোসেন বলেন, গত শনিবার লিঙ্ক রোডের যে স্থান থেকে মাইক্রোবাসটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করা হয়, ওই স্থান থেকে কিছুটা দূরে পুলিশ বক্সের অবস্থান। তাই সে সময় দায়িত্বরত পুলিশ ঘটনার কিছুই দেখতে পারেনি। তবে গ্রেপ্তার হওয়া এক ছিনতাইকারীর সূত্র ধরে তার সহযোগীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তিনি আরো বলেন, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোডের দৈর্ঘ মাত্র ৮ কিলোমিটার হলেও এ সড়কটির দু’পাশেই রয়েছে অসংখ্য সংযোগ সড়ক, যে সড়কগুলো ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে এসে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। মূলত শাখা সড়কগুলোর কারণেই এ রোডকে পুরোপুরি নিরাপদ করা যাচ্ছে না। তা ছাড়া লিঙ্ক রোডের অনেকাংশে রাস্তার দু’পাশে এখনও সেভাবে বসতি গড়ে ওঠেনি। তবে লিঙ্ক রোডের সাইনবোর্ড, জালকুঁড়ি এবং খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে সিসিটিভিসহ পুলিশের তল্লাশি চৌকি রয়েছে। পাশাপাশি টহল পুলিশের একাধিক টিমও কাজ করে।

https://www.mzamin.com/article.php?mzamin=207186