৮ জানুয়ারি ২০২০, বুধবার, ২:৪০

বোরোতে অনীহা কৃষকের

কৃষক গত আমন মৌসুমে ধানের প্রকৃত দাম পাননি। খরচ তো ওঠেইনি বরং মণপ্রতি ২০০ থেকে ৫০০ টাকা ক্ষতির শিকার হয়েছেন তারা। খরচ না ওঠায় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন কৃষক। এ কারণে বোরো চাষেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন তারা। পৌষ মাস শেষ হতে চললেও চাষিদের তাই নেই কোনো ব্যস্ততা।

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পাটকেলঘাটা এলাকার কৃষক লুৎফর রহমান বাচ্চু বলেন, গত মৌসুমে বোরোর মণপ্রতি উৎপাদন খরচ ৯২০ টাকা হলেও তা বিক্রি হয়েছে ৫৮০ টাকা দরে। একইভাবে আমন মৌসুমেও ধানের ন্যায্যমূল্য পাইনি। এ জন্য এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

বগুড়া জেলার ধুনট উপজেলা সদরের পশ্চিম ভরনশাহী গ্রামের প্রান্তিক চাষি সুবিদ আলী বলেন, প্রতি বছর পৌষ মাসের এ সময় বোরো চাষে কৃষকরা ব্যস্ত থাকত। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। এবারসহ কয়েক বছর ধরে ধানের উপযুক্ত দাম পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতি বছরই লোকসান দিতে হচ্ছে। তাই এবার ধান চাষের কোনো ব্যস্ততা নেই। বোরো বীজতলা প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

পাবনা সদর উপজেলার গয়েশপুর ইউনিয়নের কৃষক আবদুল গফুর বলেন, গত বছর থেকে এবার আমি ৩০ ভাগ বোরো আবাদ কমিয়ে দিয়েছি। কারণ গত আমন মৌসুমে বেশ ক্ষতির শিকার হয়েছি।

বিএডিসি (বীজ) খুলনার উপপরিচালক মো: লিয়াকত আলী জানান, ঘূর্ণিঝড় ফণি ও বুলবুলের কারণে গত মৌসুমে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েন কৃষকরা। এ ছাড়া বোরো ও আমনের ন্যায্যদাম না পাওয়ায় এবারো বোরো চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন তারা। এ ছাড়া এবার পেঁয়াজের মূল্য বেশি হওয়ায় আমন চাষিরা কিছুটা সে দিকে ঝুঁকেছেন।

নয়া দিগন্ত খুলনা ব্যুরোর এরশাদ আলী জানান, গেল বোরো মৌসুমে ফসলের ন্যায্য দাম পাননি খুলনা অঞ্চলের কৃষকরা। ফলে স্থানীয় মহাজন, বিভিন্ন এনজিও ও ব্যাংকের কাছে বেড়েছে তাদের ঋণের বোঝা। তাই চলতি মৌসুমে বোরো আবাদের আগ্রহ হারিয়েছেন এ অঞ্চলের অনেক কৃষক। এ দিকে কৃষকদের বোরো আবাদে আগ্রহ না থাকায় এবার খুলনায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ৯০০ মেট্রিক টন বোরো বীজ অবিক্রীত রয়েছে।

গত ৯ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে খুলনায় ২৫ হাজার হেক্টর আমন ধান ও ৮৬৪ হেক্টর জমির শাকসবজি নষ্ট হয়। কারেন্ট পোকার আক্রমণে খুলনার রূপসা, বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া উপজেলার কয়েক শ’ একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হন খুলনার অন্তত তিন লাখ ১৬ হাজার কৃষক।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরা, কালিগঞ্জ ও বাগেরহাট বিএডিসির গুদামে দুই হাজার মেট্রিক টন বীজ বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে বিআর-২৬, বিআর-২৮, ব্রি-২৯, ব্রি-৪৭, ব্রি-৫৮, ব্রি-৬৩, ব্রি-৬৭, ব্রি-৭৪, ব্রি-৮১ ও ব্রি-৮৬ জাতের ধান উল্লেখযোগ্য। গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ওই তিন জেলার ৪০৫ জন ডিলার ১ হাজার ১৭১ মেট্রিক টন বীজ বিক্রি করেন।

বাগেরহাটের ফকিরহাট, মোল্লাহাট, চিতলমারী, শরণখোলা ও খুলনার ডুমুরিয়া, পাইকগাছা, ফুলতলা, তেরখাদা এবং সাতক্ষীরার কলারোয়া, তালা ও আশাশুনি উপজেলায় ব্রি-২৮ জাতের বীজের চাহিদা বেশি।

বিএডিসি (বীজ) খুলনার উপপরিচালক মো: লিয়াকত আলী জানান, ঘূর্ণিঝড় ফণি ও বুলবুলের কারণে গত মৌসুমে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েন কৃষকরা। এ ছাড়া বোরো ও আমনের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় এবারো বোরো চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন তারা। এ ছাড়া এবার পেঁয়াজের মূল্য বেশি হওয়ায় আমন চাষিরা কিছুটা সে দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।

ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, ব্রি-২৮ জাতের বোরো বীজের চাহিদা বেশি থাকলেও কৃষকরা বেসরকারি কোম্পানির হাইব্রিড বীজও কিনেছেন। গত মৌসুমে ভালো ফলন দিয়েছিল ব্রি-২৮ জাতের বীজ। উপজেলার ২১ হাজার ৩১৫ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়।

খুলনা কৃষি বিভাগের একজন কর্মকর্তার সাথে কথা বলা হলে তিনি পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, আমরা মাঠপর্যায়ে যে বাস্তবতা দেখছি সে অনুযায়ী গত বছরের তুলনায় এবার খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার ৪০ শতাংশ জমিতে বোরো আবাদ হবে না। চাষিরা গত বোরো সিজন থেকে ধানের যে দাম পাচ্ছেন তাতে আবাদের খরচ উঠছে না। এখন সার ও কীটনাশকসহ সব উপকরণের দাম বেড়েছে। ফলে কৃষকরা এখন খাওয়ার জন্য প্রয়োজন পরিমাণ ধানের আবাদ করতেই চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক।

নয়া দিগন্ত বগুড়া অফিসের আবুল কালাম আজাদ জানান, এবার আমন ধানের উপযুক্ত দাম না পেয়ে কৃষক হতাশ হয়ে বোরো ধান চাষ শুরুই করেননি। ফলে বোরো আবাদ কম হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বগুড়ার ধুনট উপজেলা সদরের পশ্চিম ভরনশাহী গ্রামের প্রান্তিক চাষি সুবিদ, খোকা ও মোনায়েম খান জানান, প্রতি বছর পৌষ মাসের এ সময় বোরো চাষে কৃষকরা ব্যস্ত থাকতেন; কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। এবারসহ কয়েক বছর ধরে ধানের ন্যায্য দাম পাওয়া যাচ্ছে না। তাই প্রতি বছরই লোকসান দিতে হয়। তারা বলেন, সরকার গুদামে বাজারের চেয়ে বেশি দামে ধান কিনলেও এ সুবিধা পান হাতেগোনা কয়েকজন কৃষক। স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা এ সুবিধা নিয়ে নেন। ফলে লোকসানে পড়ার ভয়ে এবার বোরো ধান চাষে কৃষকের আগ্রহ নেই। তাই পৌষ মাস শেষ হতে চললেও ধান চাষের কোনো ব্যস্ততা নেই। এ ছাড়া বোরো বীজতলা প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

পাবনা সংবাদদাতা এস এম আলাউদ্দিন জানান, পাবনা জেলার কৃষকরা লোকসানের ভয়ে এবার বোরো আবাদ অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। ধানের দাম না পাওয়ায় কৃষকরা এখন পেঁয়াজ চাষের দিক ঝুঁকছেন। সুজানগর উপজেলার কৃষক আবদুল আলিম বলেন, গত বছর ২০ বিঘার মতো ধান চাষ করেছিলাম। কিন্তু এবার ৪-৫ বিঘার মতো বোরো আবাদ কমিয়ে দিয়েছি। এসব জমিতে পেঁয়াজ লাগানোর টার্গেট নিয়েছি। কারণ ধানের দাম তেমন পাওয়া যায় না। এখন পেঁয়াজের যে দাম তাতে ধান না চাষ করে পেঁয়াজ লাগানো ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/470484/