ঢাবি ছাত্রীর ধর্ষকের বিচার দাবিতে ক্যাম্পাসে র্যালি : নয়া দিগন্ত
৮ জানুয়ারি ২০২০, বুধবার, ২:৩৮

ক্ষোভে ফুঁসছে ঢাবি ক্যাম্পাস

ধর্ষকের প্রকাশ্যে শাস্তি দাবি ; ধর্ষককে দেখলে চিনতে পারবেন নির্যাতিত ছাত্রী ; শিগগিরই খুঁজে বের করা হবে অভিযুক্তকে : আইজিপি ; মামলা ডিবিতে, সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের বিচার দাবিতে ক্ষোভে ফুঁসছে ঢাবি ক্যাম্পাস। ধর্ষককে দ্রুত গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনেও বিভিন্ন ছাত্র ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পাশাপাশি ঢাবির বিভিন্ন বিভাগ ও অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন। তারা ধর্ষকের দ্রুত গ্রেফতার ও তার প্রকাশ্য শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। এ দিকে আইজিপি ড. জাবেদ পাটোয়ারি বলেছেন, ঢাবির ছাত্রীর ধর্ষককে শিগগিরই খুঁজে বের করা হবে। ঘণ্টা হিসেব করে তদন্ত হয় না, তাই আশা করছি খুব শিগগিরই ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করা হবে।

গতকাল সকাল থেকেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল ও বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন। এ সময় সরকারের কঠোর পদক্ষেপের সাথে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার তাগিদ দেন তারা। ধর্ষণের দায় শুধু অপরাধীর না পুরো সমাজের- এমন ভাবনা থেকেই শিক্ষার্থীরা ঘৃণায় কালো কাপড়ে মুখ ঢেকেছেন সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যে। এ ছাড়া ঢাবির ছাত্রী ধর্ষণের প্রতিবাদে ধর্ষকের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা।

নির্যাতিতা ওই শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি রয়েছেন। তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, নির্যাতিত ছাত্রীর চিকিৎসায় গঠিত সাত সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যরা মঙ্গলবার সকালেও মেয়েটিকে দেখেছেন। তারা মেয়েটির ফিজিক্যাল কন্ডিশনে ট্রমা বা বিশেষ কিছু পাননি। সে প্রথম থেকেই মানসিকভাবে শক্ত রয়েছে।

রাজধানীর কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের প্রান্তে সড়কের পাশের জায়গাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনাস্থল হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। আসামি ধরতে প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও সিসিটিভির ফুটেজ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের ডিসি সুদীপ চক্রবর্তী। মামলাটির তদন্তভার ঢাকা মহাগনর গোয়েন্দা পুলিশে হস্তান্তর করা হয়েছে। মামলাটি ডিবি উত্তর তদন্ত করবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

ঢাবির ছাত্রীকে ধর্ষণের প্রতিবাদে গতকাল দুপুরে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্ষের পাদদেশে ধর্ষকের প্রতীকী কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীরা দ্রুত ধর্ষককে গ্রেফতারের দাবি জানান। মানববন্ধনে শিক্ষার্থীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ। তিনি বলেন, এখন শুধু ঢাকডোল বাজিয়ে উন্নয়নের কথা প্রচার করা হচ্ছে। উন্নয়ন মানে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন না। মানুষের চলাফেরার নিরাপত্তার উন্নয়ন না হলে এটাকে উন্নয়ন বলা যায় না। আমাদের যে ছাত্রীর ধর্ষকের এমন বিচার চাই, যা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

অর্ণি আনজুম নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণ বাড়ছে। যথাযথ সময়ে বিচার করলে ধর্ষণের ঘটনা কমত। আমরা একজন নারী ধর্ষণ হওয়ার পর তার চরিত্র সম্পর্কে খোঁজ নিতে থাকি। এটা হলো ধর্ষিতাকে মানসিকভাবে ধর্ষণ। মানববন্ধনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।

মঙ্গলবার সকাল থেকেই ঢাবি ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সংগঠন নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে। এর মধ্যে ধর্ষককে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনাসহ চার দফা দাবিতে চার ছাত্র সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের সামনে অনশন করছেন। তারা জানিয়েছেন, দাবি পূরণ হলেই কেবল অনশন ভঙ্গ করবেন। জানা গেছে, রোববার রাতেই সিফাতুল ইসলাম নামে দর্শন বিভাগের এক ছাত্র প্রথমে অনশন শুরু করেন। পরে তার সাথে ইতিহাসের ছাত্র ও মুহসিন হল সংসদের সদস্য আবদুর রহমান, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের ছাত্র ও ডাকসুর সদস্য সাইফুল ইসলাম এবং তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের মোস্তাফিজুর রহমান এই অনশনে যোগ দেন। তাদের সাথে অনেকে এসে সংহতি জানিয়েছেন। অনশনকারীদের চারটি দাবি হলোÑ ধর্ষককে গ্রেফতার করা, ওই অপরাধের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে হবে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ নিতে হবে এবং দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার করে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে। দাবি পূরণ হলেই অনমন ভঙ্গ করা হবে বলে জানান প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীরা।

গতকাল রাজু ভাস্কর্য থেকে রোকেয়া হল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে প্রতিবাদী আলপনা আঁকছেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়াও এ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শ’পাঁচেক শিক্ষার্থী। রাজু ভাস্কর্য থেকে রোকেয়া হল পর্যন্ত আলপনায় সড়কেও ছাপ পড়েছে ধর্ষণবিরোধী নানা প্রতিবিম্ব। নারীর দিকে ধর্ষকের লোলুপ থাবা যেন এঁকেছেন শিক্ষার্থীরা। দেখিয়েছেন অপরাধীর কালো হাত কী করে চেপে ধরেছে প্রগতির ডানা। পুরো রাস্তা যেন হয়ে উঠেছে দ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। আলপনার বিষয়ে জানতে চাইলে চারুকলা অনুষদের সিরামিক বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, পুরুষ, কাঁটাতার ও পায়রা দিয়ে একটি আলপনা আঁকা হয়েছে। পায়রা হলো শান্তির প্রতীক। আর এই শান্তি কিভাবে পুরুষের নৈতিক স্থলনের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে, তা বোঝানো হয়েছে। আর কাঁটাতার দিয়ে বোঝানো হয়েছে, মেয়েরা কিভাবে সমাজের কাঁটাতারের মধ্যে আটকে আছে। ছাত্রলীগের ডাকে শুধু প্রতিবাদী আলপনা আঁকা নয়, হয়েছে মানববন্ধনও।

২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধর্ষকের গ্রেফতার চান ডাকসু নেতারা : ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার ও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন ডাকসু নেতারা। সোমবার রাতে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করে স্মারকলিপি দেন তারা।

স্মারকলিপিতে ৪ দফা দাবি পূরণের কথা বলেছেন ডাকসু নেতৃবৃন্দ। এর মধ্যে রয়েছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দোষীদের গ্রেফতার, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ব্যবস্থা, ‘কাউন্টার রেইপ অ্যান্ড ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন সেল’ গঠন এবং ধর্ষণবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

ছাত্রদলের আলটিমেটাম : ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষকের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করে ছাত্রদল। একই সঙ্গে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে আলটিমেটাম দেয় তারা। অন্যথায় ছাত্রসমাজকে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দেন ছাত্রদলের নেতারা। মঙ্গলবার ছাত্রদলের সমাবেশে ঢাবি ছাত্রদলের আহ্বায়ক রাকিবুল ইসলামের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন, সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসাইন শ্যামল। এতে কেন্দ্রীয়, বিশ^বিদ্যালয় ও বিভিন্ন হল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অংশ নেন।

সমাবেশে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন বলেন, আওয়ামী সরকার সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। মা-বোনদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিদিন কোনো-না-কোনো স্থানে গুম, খুন, হত্যা, ধর্ষণ হচ্ছে তার কোনো সুষ্ঠু তদন্ত হচ্ছে না এবং কোনো ন্যক্কারজনক ঘটনার বিচার হচ্ছে না; তাই অপরাধী রা তাদের অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দোষীদের তদন্ত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অন্যথায়, ছাত্রদল ছাত্রসমাজকে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে।

এ সময় তারা ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি এবং খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দেন। সমাবেশ শেষে ধর্ষণের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়ে স্বারষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছেন তারা। এছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীরা কলাভবনের সামনে মানববন্ধন করেন। পরে মিছিল নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে দাবি জানান নারী নির্যাতন বন্ধে নতুন আইন প্রণয়নের। সকালে মুখে কালো কাপড় বেঁধে মৌন মিছিল করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা সমাবেশ করেন রাজু ভাস্কর্যের সামনে। এতে সংহতি জানান কয়েকজন শিক্ষকও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগ মানববন্ধন করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানায়।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রীকে কুর্মিটোলায় যে স্থানে ধর্ষণ করা হয়েছে তার আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে বল জানিয়েছেন ডিএমপির গুলশান বিভাগের ডিসি সুদীপ কুমার চক্রবর্তী। গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিক্যালে ধর্ষণের শিকার ঢাবির ছাত্রীকে দেখে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। খুব দ্রুত ধর্ষককে শনাক্ত ও গ্রেফতার করা সম্ভব হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গতকালই মামলাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে অধিকতর তদন্তের জন্য ডিবি উত্তরের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রথম থেকেই প্রযুক্তি ও ম্যানুয়ালি দু’ভাবেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, ঘটনাস্থলের আশপাশের কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এটি একটি ব্যস্ত সড়ক। ফুটেজগুলো গতকালও (সোমবার) যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। আজো (মঙ্গলবার) সেই কাজ চলছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। এর আগে গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, নির্যাতিত ছাত্রীর চিকিৎসায় গঠিত সাত সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যরা আজ সকালেও মেয়েটিকে দেখেছেন। তারা মেয়েটির ফিজিক্যাল কন্ডিশনে ট্রমা বা বিশেষ কিছু পাননি। সে প্রথম থেকেই মানসিকভাবে শক্ত রয়েছে। তিনি আরো বলেন, গতকালের চেয়ে সার্বিকভাবে সে আজকে (মঙ্গলবার) আরেকটু স্বাভাবিকের দিকে আগাচ্ছে। আশা করি দু-এক দিনের মধ্যে তাকে ছেড়ে দিতে পারব। তার ফিজিক্যাল কন্ডিশন ইমপ্রুভ করছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম জানিয়েছেন, ধর্ষণের শিকার ঢাবি ছাত্রী আসামিকে দেখলে চিনতে পারবেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী অভিজ্ঞ চিত্রশিল্পীর মাধ্যমে আসামির ছবি এঁকে শনাক্ত করা হবে। তিনি জানান, আসামির মাঝারি গঠন এবং বাকি সব কিছুই কেমন দেখতে তা বলতে পারবেন ঢাবির ওই শিক্ষাথী। ধর্ষণের শিকার ঢাবি ছাত্রীর খোঁজ নিতে এবং তার সাথে দেখা করতে গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা মেডিক্যালে যান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম। এ সময় তিনি ওই ছাত্রী ও চিকিৎসকদের সাথে চিকিৎসার বিষয়ে কথা বলার পর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, মেয়েটিকে দেখেছি, তার সাথে কথা হয়েছে। মেয়েটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। এ জন্য সে ধর্ষণের আলামত নষ্ট হতে দেয়নি। তার ডিএনএ টেস্ট করার জন্য আলামতগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। তার বর্ণনা অনুয়ায়ী আসামির ছবি আঁকার মাধ্যমে এবং ভিকটিমের ডিএনএ সেস্টের সাথে আসামির ডিএনএ’র নমুনা ম্যাচ করলে শনাক্ত করতে সুবিধা হবে। তিনি আরো বলেন, এ ঘটনাটি অবশ্যই মানবাধিকার লঙ্ঘন। এর নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। আমরা শুধু নিন্দা ও উদ্বেগ জানাব, তা নয়। এটির নিরসন হওয়া উচিত। নারী-পুরুষ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, যাতে এ ধর্ষণের ঘটনা বন্ধ হয়।

নাছিমা বেগম বলেন, বর্তমানে যে ডিএনএ ল্যাবটি রয়েছে, সেটি নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। এখন অধিদপ্তর গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। বিষয়টি সচিব কমিটিতে পেন্ডিং রয়েছে। ডিএনএ আইনে স্পষ্ট বলা আছে, আমাদের সবার ডাটাবেজ সখোনে থাকবে। যেখানে আপনার আমার সবার ডিএনএ প্রোফাইল থাকবে। এখন যদি সবার ডিএনএ ডাটাবেজ থাকত, তাহলে এ মেয়েটির কাছ থেকে যে আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে, তার মাধ্যমেই আসামি শনাক্ত করা যেত। এ জন্য আমরা নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও সরকারের কাছে আশা করব, দ্রুত যেন এটি গঠন করে সবার ডিএনএ ডাটাবেজ সংগ্রহ করা হয়।

জানা গেছে, গত ৫ জানুয়ারি বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে ওই ঢাবি শিক্ষার্থী শেওড়া এলাকায় তার বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার উদ্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে রওনা দেন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাসটি ক্যান্টনমেন্ট থানার কুর্মিটোলা বাস স্ট্যান্ডে থামে। শিক্ষার্থী বাস থেকে নেমে ফুটপাথ দিয়ে শেওড়ার দিকে হাঁটতে থাকেন। তিনি আর্মি গলফ ক্লাব মাঠ সংলগ্ন স্থানে পৌঁছালে পেছন দিক থেকে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি পেছন থেকে তার গলা চেপে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। এসময় ওই শিক্ষার্থী অজ্ঞান হয়ে পড়লে আসামি তাকে ধর্ষণ করে। ওই শিক্ষার্থীর জ্ঞান ফিরলে আসামি তাকে মারধর করে এবং ভয়ভীতি দেখায়। তার কাছে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞাসা করে। তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন, হাতঘড়ি, নগদ টাকা ও ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। একপর্যায়ে ওই শিক্ষার্থী ঘটনাস্থল থেকে দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে রিকশা নিয়ে তার সহপাঠীর বাসায় যায়। সেখান থেকে তাকে ঢাবি ক্যাম্পাসে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর সহপাঠীদের সহযোগিতায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়।

জাবি-কুবিসহ ভার্সিটিগুলোয় শাস্তির দাবিতে মিছিল-সমাবেশ : রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণ, নির্যাতন এবং বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে সারা দেশ। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা

জাবি সংবাদদাতা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কুর্মিটোলায় ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনায় ধর্ষককে চিহ্নিত ও গ্রেফতার এবং সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে জাহাঙ্গীনরগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনারে এসে তা শেষ হয়।

মানববন্ধনে ছাত্রলীগের জাবি শাখার সভাপতি জুয়েল রানা বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার এতদিন পরেও এ দেশের নারীরা নিরাপদ নয়। প্রতিদিন আমাদের আশপাশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। যারা ধর্ষণ করে তারা মানুষরূপী পশু। তাদের এই সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্টতর স্থানে নিক্ষেপ করতে হবে।’ মানববন্ধন থেকে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ধর্ষণের সাথে জড়িত সবার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানানো হয়।

এদিকে ঢাবি ছাত্রী ধর্ষণ ও গত সপ্তাহে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন আমবাগান এলাকায় ১০ বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিকেল সাড়ে ৪টায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানার। বিক্ষোভ মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে ক্যাম্পাসের প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে মুরাদ চত্বরে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি সুস্মিতা মরিয়ম, ছাত্রফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী) সাধারণ সম্পাদক সুদীপ্ত দে, কার্যকরী সদস্য অমর্ত্য রায় প্রমুখ।

কুমিল্লা সংবাদদাতা জানান, কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) শাখা ছাত্রলীগ ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা ধর্ষণের সাথে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান। গতকাল মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সড়কে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

বিশ^বিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান হোসাইনের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ, সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক আইভি রহমান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হানিফ ওয়াহিদ, কাজী নজরুল ইসলাম হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিক আব্দুল্লাহ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক তানভীর সাবিক, ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি ফারিদ মুস্তাকিমসহ অন্যান্যরা। মানববন্ধনে বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের তিন শতাধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে।

ফেনী অফিস জানায়, কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণে জড়িত ধর্ষকের বিচার দাবি ও প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে ফেনী। ‘ধামরা ফেনীর সন্তান’র ব্যানারে গতকাল বিকেলে শহরের ট্রাংক রোডের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে মানববন্ধন ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে অংশগ্রহণ করে শহরের সর্বস্তরের মানুষ। সন্ধ্যায় শহীদ মিনার থেকে শুরু হয় মশাল মিছিল। ধর্ষকের বিচারের দাবিতে স্লেøাগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠে ফেনী। মিছিল অংশগ্রহণ করে পথচারীরা। প্রায় হাজার খানেক জনতার মিছিল থেকে দাবি তোলা হয় ধর্ষকের যেন ফাঁসি হয়। মশাল মিছিলটি শহরের খেজুর চত্বর, দোয়েল চত্বর, প্রেস ক্লাব ও শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় শহীদ মিনারে এসে বিক্ষেভে মিলিত হয়। সেখানে সমবেত মানুষ ধর্ষকের বিচারের জন্য সরকারের দ্রুত প্রদক্ষেপ আশা করেন।

মানববন্ধন-মিছিলে অংশ নেন প্রতিবাদ কর্মসূচির আহ্বায়ক ও ফেনী প্রেস ক্লাব একাংশের সাবেক সভাপতি আসাদুজ্জামান দারা, সময় টিভি ব্যুরো প্রধান বখতেয়ার ইসলাম মুন্না, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ফেনীর সাধারণ সম্পাদক সমর দেব নাথ, সাংস্কৃতিক সংগঠক শান্তি চৌধুরী, মানবজমিন ও বিডি নিউজ প্রতিনিধি নাজমুল হক শামীম, সাপ্তাহিক নিহারীকা ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আরিফুল আমিন রিজভী, সংগঠক নাসিম আনোয়ার জাকি, উৎপল সুজন, সৈয়দ আশ্রাফুল হক আরমান, এখলাস উদ্দিন খোন্দকার বাবলু, আমের মক্কী, সাহাব উদ্দিনসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধি।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/470490/