৭ জানুয়ারি ২০২০, মঙ্গলবার, ১২:৪২

পেঁয়াজের দাম নিয়ে নৈরাজ্য চলছেই

দাম বৃদ্ধির জন্য আমদানিকাকরদের দূষছেন আড়তদাররা

পেঁয়াজের দাম নিয়ে সৃষ্ট হওয়া নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে না আসতেই নতুন বছরের শুরুতে বৈরী আবহাওয়ার অজুহাতে আবার পণ্যটির দাম বাড়তে শুরু করেছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির পেছনে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। তাদের কারসাজিতে পেঁয়াজসহ একাধিক পণ্যের দাম বাড়ছে। অতি মুনাফার জন্য তারা ভোক্তার পকেট কাটছে। তবুও তারা অধরাই থেকে যাচ্ছে। সোমবার রাজধানীর খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৮০-২০০ টাকা। আর পাইকারি বাজারে বিক্রি হয়েছে ১৭০-১৮০ টাকা।

গত বছর ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার পর রাজধানীতে পেঁয়াজের কেজি সর্বোচ্চ ২৬০ টাকা হয়। আর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিমানে করে পেঁয়াজ আনা হয়। টিসিবির মাধ্যমে রাজধানীসহ সারা দেশে পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়। জেলা প্রশাসন ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ একাধিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাজার তদারকি করে। এছাড়া গত বছরের শেষের দিকে একাধিক দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ বাড়ানো হয়। সঙ্গে নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসায় দাম কমতে থাকে। কিন্তু নতুন বছরের শুরুতেই আবারও পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। হু হু বাড়ছে পণ্যটির দাম। শুধু রাজধানীতে নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও দাম বাড়ছে। এতে নিম্ন আয়ের ভোক্তারা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন।

সোমবার রাজধানীর পেঁয়াজের পাইকারি আড়ত শ্যামবাজার ও কারওয়ান বাজারের পাইকারি বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এদিন প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ১৭০-১৮০ টাকা। আমদানি করা চায়না পেঁয়াজ বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৬৫ টাকা, যা রোববার একই দরে বিক্রি হয়। এছাড়া রাজধানীর একাধিক খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুচরা পর্যায়ে দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১৯০-২০০ টাকা। আর চায়না পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৮৫-৯০ টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর নয়াবাজারের এক খুচরা পেঁয়াজ বিক্রেতা বলেন, পেঁয়াজ নিয়ে আমদানিকারকদের একটি সিন্ডিকেট আছে। তারা দেশের পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এ সিন্ডিকেট যেমন বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে। ঠিক তেমনি কৃষকের কাছ থেকেও পেঁয়াজ অল্প দামে কিনে নেয়। পরে এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা একটি দাম নির্ধারণ করে দেয়। সেই দামেই তারা মোকাম পর্যায়ে বিক্রি করে। এতে দাম যা বাড়ানোর তারাই বাড়ায়। আর এ বাড়তি দামের প্রভাব পাইকারি ও খুচরা বাজারে এসে পরে। তাই পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কঠোর শাস্তি দিতে হবে। এটা করা গেলে পেঁয়াজের বাজার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

একই কথা বলেন কারওয়ান বাজারে একাধিক পাইকারি বিক্রেতা। তারা জানান, আমরা কারওয়ান বাজারের আড়তে পাইকারি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করি। মূলত পেঁয়াজ রাজধানীর শ্যামবাজারের মোকাম থেকে আনতে হয়। তাদের কাছ থেকে কিনে এনে আমরা পাইকারি বিক্রি। বর্তমানে বৈরী আবহাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে আবারও দাম বাড়িয়েছে। তাই বেশি দাম দিয়ে এনে আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তারা আরও জানান, গত বছর সংকটের কথা বলে পেঁয়াজ কম দিয়েছে। এবার আবহাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে কম পেঁয়াজ দিচ্ছে। মূলত তারা রমজানের আগেই আবারও বাজার অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে। সরকারের এদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্যামবাজারের পেঁয়াজ আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রেতা সংকর চন্দ্র ঘোষ বলেন, কয়েকদিনের বৃষ্টিতে কৃষক মাঠে গিয়ে পেঁয়াজ উত্তোলন করতে পারেননি। যার কারণে মোকামে পেঁয়াজের সরবরাহ কমেছে। তবে আবহাওয়া ভালো হচ্ছে, আশা করি আর মাত্র দু’একদিনের মধ্যে দাম আবারও ৪০-৫০ টাকায় নেমে আসবে। এছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। এতে রমজানের আগেই পেঁয়াজের দাম ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতায় চলে আসবে।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে দু’দিনের ব্যবধানে কেজিতে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে সব ধরনের পেঁয়াজের দাম। খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ৪০ টাকা পর্যন্ত। আমদানিকারকদের কারসাজি, দেশি পেঁয়াজ বাজারে না আসা এবং আমদানিও কিছুটা কমে যাওয়ায় পেঁয়াজের দাম বেড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়ায় চাপ বেড়েছে টিসিবির ট্রাকে। সোমবার নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী, কোতোয়ালি, আন্দরকিল্লাসহ কয়েকটি জায়গা ঘুরে দেখা গেছে, টিসিবির পেঁয়াজ বিক্রির ট্রাকে নিম্ন আয়ের মানুষের উপচে পড়া ভিড়।

আড়তদারদের অভিযোগ, পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর নেপথ্যে আমদানিকারকরা। তারা অনেকটা জোর করে কমিশন এজেন্ট বা আড়তদারদের বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য করছেন। আমদানি মূল্য বেশি দাবি করেই এমন জোরাজুরি করছেন তারা। যে কারণে আড়তদাররা পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করেন। প্রশাসন আড়তদারদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও আমদানিকারকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমদানিকারকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

কিছুদিন বাজার মোটামুটি স্থির থাকলেও বৃহস্পতিবার থেকে আবারও অস্থির হয়ে উঠে পেঁয়াজের বাজার। এখানে মিয়ানমারের পেঁয়াজের দাম কেজিতে ২০ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে ১৫০ টাকা থেকে ১৬০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। চীন থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ কেজিতে ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা থেকে ৫৫ টাকা। মিসরের পেঁয়াজ কেজিতে ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা বেড়ে ৮৫ টাকা থেকে ৯০ টাকা, তুরস্ক থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার যুগান্তরকে বলেন, পেঁয়াজের দাম যাচাই করা হচ্ছে। মোকাম থেকে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে তদারকি করা হচ্ছে। অনিয়ম পাওয়া গেলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/news/264196