৪ জানুয়ারি ২০২০, শনিবার, ১২:৪৬

ইভিএমে নিরপেক্ষতা

ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আগামী ৩০ জানুয়ারি ভোট গ্রহণের দিন নির্ধারণ করে তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। ২২ ডিসেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ তফসিল ঘোষণা করেন। প্রথমবারের মতো এবারই সবগুলো কেন্দ্রে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। একটি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তির কল্যাণের জন্য একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন একান্ত অপরিহার্য। অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল হলে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। কিন্তু এই সরকারের আমলে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ে যত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সবই বিতর্কমুক্ত ছিল এমন কিন্তু নয়! তারপরও প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইভিএমের পক্ষে ওকালতি করেছেন। তবে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়ে মাহবুব তালুকদার প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি মনে করেন ইভিএম নিয়ে অনেকের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। অতীতের তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আমার কাছে মোটেই সুখকর নয়! আসন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিগত ওই তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। তিনি ভোটারদের বলেন, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্র হরণকারীদের উপযুক্ত জবাব দিন।

ইভিএম ব্যবহার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। শাসকদল ইভিএমের পক্ষে ওকালতি করলেও বিরোধী দলগুলো ইভিএমের বিপক্ষে। আজ যারা ক্ষমতায় আছে তারা যখন বিরোধী দলে যাবে তখন কি তারা ইভিএমের পক্ষে থাকবেন? নিশ্চয় না। কারণ তাদের অতীত ইতিহাস এটা বলে না। দলটি যখন বিরোধী দলে ছিল তখন জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গী করে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের কাছ থেকে আদায় করেছিল। অথচ তারাই যখন আবার ক্ষমতায় এলো তখন কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করল। ইভিএম-পদ্ধতি নিয়ে বির্তক হতো না, যদি ডিজিটাল কারচুপির ভয় না থাকত। মানুষের তৈরি প্রযুক্তি ক্ষমতাসীন দল যেভাবে চাইবেন সেভাবেই অপারেট হবে। তার নমুনা তো আমরা বিগত নির্বাচনগুলোতে দেখিছি। ১২ ডিসেম্বরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পক্ষ থেকে বলা হয় যে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সব কমিশনারের আশু অপসারণ ও নির্বাচন কমিশনকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই উল্লেখ করে বিষয়টিতে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা করে। কারণ হিসেবে টিআইবি বলেছে, একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেভাবে একের পর এক কেলেঙ্কারির জন্ম দিচ্ছে তা অভূতপূর্ব ও পুরো জাতির জন্য বিব্রতকর। আন্তর্জাতিকভাবেও ইভএমের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বপ্রথম ইভিএম পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। বর্তমানে বিশ্বের ৯০ শতাংশ দেশে এখন ইভিএম-পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। যে কয়েকটি দেশে ইভিএম চালু করা হয়েছিল সে ক’টি দেশে এখন ইভিএম পদ্ধতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি পশ্চিমা দুনিয়ার কোনো আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রে ইভিএম ব্যবহার করা হয় না। কারণ সেখানে ম্যানিপুলেশন বা কারসাজি করার সুযোগ থাকে। তারা যদি ব্যালট পেপারে ভোট করতে পারে তাহলে আমাদের ব্যালটে ভোট করতে বাধা কোথায়? পৃথিবীর যেসব দেশ ইভিএম-পদ্ধতি চালু করেছিল তারা ইতোমধ্যে এই পদ্ধতি পরিত্যাগ করেছে। ২০০৬ সালে আয়ারল্যান্ড ই-ভোটিং পরিত্যাগ করেছে। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে জার্মানির ফেডারেল কোর্ট ইভিএমকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে। একই বছরে ফিনল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট তাদের তিনটি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করেছে। নেদারল্যান্ডসে ই-ভোটিং কার্যক্রম জনগণের আপত্তির মুখে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সারা বিশ্ব যখন ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে তখন সিইসি কার স্বার্থে ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তা বোধগম্য নয়!

ইভিএমে ভোট জালিয়াতি ও ভোট চুরির অফুরন্ত সুযোগ থাকবে না এটি নিশ্চিত করে বলা যায় না। এই মুহূর্তে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তাব করাটা দুরভিসন্ধিমূলক। কারণ ইভিএম নিয়ে বিশ্বজুড়ে যখন হতাশা ও সমালোচনার ঝড় বইছে তখন এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়! নির্বাচন কমিশন স্বাধীন একটি কমিশন। এটি কারো অজানা নয়। তবে এই কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে যখন জনমনে প্রশ্ন দেখা দেয় তখন কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে কমিশন হচ্ছে একটি কাগুজে বাঘ। ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একটি ওয়ার্ডে ভোট গ্রহণের মাধ্যমে ইভিএমের যাত্রা শুরু হয়। ২০১৩ সালের ১৫ জুন রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেখানকার একটি ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণের সময় ইভিএম বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ওই কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করতে বাধ্য হয় নির্বাচন কমিশন। ২০১২ সালে যখন ইভিএম ব্যবহারের কথা উঠেছিল তখনো রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধিতা করেছিল। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য মতে, ইভিএম দিয়ে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেয়া যেমন সম্ভব তেমনি এক টিপে ৫০টি ভোট দেয়া সম্ভব। এমনকি বিদেশের মাটিতে বসেও ইভিএম হ্যাকিং করা যায় এবং একটি ইভিএম হ্যাকিং করতে এক মিনিটের বেশি সময় লাগে না। দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে ইভিএমের চেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা বেশি জরুরি। অথচ নির্বাচন কমিশনের সে দিকে দৃষ্টি অন্ধের হাতি দেখার মতো। অতীতের নির্বাচনগুলোতে সরকারি দলের মহড়ার কারণে বিরোধী দলের প্রার্থী এজেন্টরা কেন্দ্রে ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। এ অবস্থা এবারো বিদ্যমান থাকলে ইভিএমের জটিলতা আরো বাড়বে। ক্ষমতাসীন দলের অতি উৎসাহী মাসলম্যানরা বিরোধী প্রার্থীর ভোটারদের ইভিএমের বাটনে হাত দিতে দেবে না, বলবে আপনার কষ্ট করার দরকার নেই, আমরাই বাটন চেপে ভোট দিয়ে দিচ্ছি। নির্বাচনে পেশিশক্তির ব্যবহার হবে না এমন গ্যারান্টি কি নির্বাচন কমিশন দিতে পারবে!

এই সরকারের শাসনামলের অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, নির্বাচনী ব্যবস্থা এক রকম ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। যদিও নির্বাচনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তারাই কার্যত নির্বাচন পরিচালনা করে থাকেন। কিন্তু নিকট অতীতে হয়ে যাওয়া ইউনিয়ন পরিষদের রক্তমাখা বীভৎস নির্বাচনের চিত্র মনে হলে গা শিউরে ওঠে। প্রতিটি নির্বাচন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, হামলা, ভাঙচুর, কেন্দ্র দখল, কারচুপি আর ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম হলেও নির্বাচন কমিশন নীরব ছিলেন। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোটকেন্দ্র দখল, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটসমর্থিত প্রার্থীর এজেন্টদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়, যে কারণে বিএনপিসহ অন্যান্য দলের প্রার্থীরা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান ও বর্জন করে। নির্বাচন-পরবর্তী দু-তিন দিনের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে নির্বাচনে সংঘটিত অনিয়মের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার সিটি নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন আখ্যায়িত করে। জাতিসঙ্ঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কিন মুন সিটি নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান। একই অনুরোধ ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশী কূটনীতিকরা সিটি নির্বাচনে অনিয়মে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং সংঘটিত অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের আহ্বান জানান। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু দেশবাসী নয়, বিশ^বাসী এ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা গণতন্ত্রের শোকযাত্রায় আর শামিল হতে চাই না। গণতন্ত্রের স্বার্থে ইভিএমের ভোট গ্রহণ পরিহার করে একটি সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ গ্রহযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশন করবে, এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

http://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/469300