৪ জানুয়ারি ২০২০, শনিবার, ১২:৪২

বিপদে কর্ণফুলী

দখল-দূষণ-পলিথিন এই তিনে মরণদশা

মহাবিপদে চট্টগ্রাম বন্দরের ধারক কর্ণফুলী নদী। দখলে-দূষণে নদীর এখন মরণদশা। প্রতিদিন চট্টগ্রাম মহানগরীর লাখ লাখ টন বর্জ্য পড়ছে নদীতে। বর্জ্যরে সাথে যাওয়া পলিথিন আর নানা জঞ্জালে ভরাট হয়ে গেছে তলদেশ। এতে বিঘিœত হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের ক্যাপিটাল ড্রেজিং। ড্রেজারের সাথে মাটির বদলে উঠে আসছে টনে টনে পলিথিন।

দুই পাড়ে গড়ে উঠা কল-কারখানার বর্জ্যও পড়ছে নদীতে। মারাত্মক ক্ষতিকর সব বর্জ্যরে ভারে কর্ণফুলীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে হরেক প্রজাতির মাছ। চরম হুমকিতে জীব-বৈচিত্র্য। নির্বিচারে পাহাড় কাটার ফলে বৃষ্টিতে পাহাড় থেকে নেমে আসছে কাদা মাটি আর বালুর ঢল। অসংখ্য ছোট বড় খাল, নালা, ছরা হয়ে তা জমছে নদীতে।

নদী দখল করে গড়ে উঠেছে ছোট বড় অসংখ্য স্থাপনা। আর তাতে নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে চর জাগছে। ভাটার সময় নদীতে অসংখ্য চর চোখে পড়ে। ভরাট হয়ে যাওয়ায় দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং করতে হচ্ছে।

দেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ কর্ণফুলী রক্ষায় নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও তাতে সুফল মিলছে না। নদীখেকোদের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হওয়া অভিযানও থমকে গেছে। সরকারি দলের নেতা এবং প্রভাবশালীদের অসংখ্য স্থাপনা অক্ষত আছে। ফলে কর্ণফুলী নদীর অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ভ‚মিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে কর্ণফুলীর অস্তিত্ব থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী নদী কর্ণফুলী হাজার বছরের ইতিহাসের অমরসাক্ষী। কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম প্রান্তের শেষে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। নদীর মোহনায় পৃথিবীর বিখ্যাত সমুদ্র বন্দর দেশের সমৃদ্ধির সোনালী দ্বার চট্টগ্রাম বন্দর। তাই দেশের অন্য সব নদীর তুলনায় লুসাইকন্যা কর্ণফুলীর গুরুত্ব অপরিসীম। অথচ কর্ণফুলীর এখন মরণদশা। দেশের প্রধান বন্দরনগরীর লোকসংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। বিশাল এই জনগোষ্ঠির নিত্যদিনের বর্জ্যরে বিরাট অংশ খাল, নালা হয়ে মিশে যাচ্ছে কর্ণফুলীতে। চট্টগ্রাম ওয়াসা ৬৫ বছরেও সুয়ারেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। আর তাই নগরীর পয়ঃবর্জ্যও পড়ছে নদীতে। জোয়ারের সময় নদীর দুইদিকে পলিথিনসহ বর্জ্যরে জঞ্জাল ভাসতে দেখা যায়। ভাটার সময় এসব জঞ্জালের নীচে চাপা পড়ে নদী। নৌযান থেকে নেমে যাত্রীরা এইসব জঞ্জালের ওপর দিয়ে হেঁটে আসেন পায়ে কাদা না লাগিয়ে।

জঞ্জালে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তাতে ব্যাহত হচ্ছে ১৬৮ কোটি টাকার ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প। ড্রেজার দিয়ে মাটি তুলতে গিয়ে আসে পলিথিন। তলদেশে চার-পাঁচ ফুট পলিথিনের স্তরের জন্য ড্রেজারের কাঁটার ব্যবহার বিঘিœত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ মহলের পক্ষ থেকে নদী রক্ষায় পলিথিন বন্ধের তাগিদ দেয়া হলেও এ ব্যাপারে কোন কার্যকর উদ্যোগ নেই। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকেও নালা-নর্দমায় আর্বজনা না ফেলতে নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বিনামূল্যে বাসা-বাড়ি দোকানপাটে দেয়া হয় ডাস্টবিন। তাতেও বন্ধ হয়নি নালা-নর্দমায় আবর্জনা ফেলা।

নদীতে পড়ছে মিল-কারখানার তরল বর্জ্য। অনিয়ন্ত্রিত নৌযানের পোড়া তেলও পড়ছে। তাতে পানি দূষিত হয়ে জীব বৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে। পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক মোয়াজ্জম হোসেন বলেন, দূষণরোধে প্রতিনিয়তই অভিযান চলছে। নদী তীরের কারখানাগুলোকে জরিমানা করা হয়েছে। নদী দখল করে গড়ে ওঠা ইটের ভাটা উচ্ছেদেরও প্রস্তুতি চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

নদীর সবচেয়ে বড় সর্বনাশ করছে দখলদাররা। নদীর উপরও গড়ে উঠেছে পাকা দালানসহ অসংখ্য স্থাপনা। সরকারি দলের নেতা ক্যাডার থেকে শুরু করে নাম করা ব্যবসায়ীরাও নদী দখল করে আছেন বছরের পর বছর। উচ্চ আদালতের নির্দেশে গেল বছরের ফেব্রæয়ারিতে নদী দখলমুক্ত করতে অভিযান শুরু হয়। টানা এক সপ্তাহের অভিযানে চার শতাধিক স্থাপনা গুঁড়িয়ে ১০ একর জমি দখলে নেয়া হয়। নগরীর সদরঘাট থেকে রশিদ বিল্ডিং পর্যন্ত অংশের দখলমুক্ত ওই জমি ফের দখল হয়ে গেছে। গেল জুলাই মাসে লালদিয়ার চরে নদী পাড়ের ২৫ একর জমি উদ্ধার করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় থমকে গেছে অভিযান।

জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, আদালতের নির্দেশনায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। পরবর্তীতে আদালত দখলদার উচ্ছেদে বন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেন। এখন জেলা প্রশাসনের আর করার কিছু নেই। তাছাড়া এ বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনার জন্য লোকবল ও অর্থ জেলা প্রশাসনের নেই।

বন্দরের ভূ-সম্পত্তি বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার জিল্লুর রহমান বলেন, আদালতের নির্দেশনায় খুব শিগগির উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে, এ লক্ষ্যে প্রস্তুতি এগিয়ে চলছে। কর্ণফুলীর ১১ নম্বর ঘাট থেকে ১৫ নম্বর ঘাট পর্যন্ত ৭৫ একর মূল্যবান জমি বেদখল ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ২৫ একর দখলমুক্ত করা হয়েছে। বাকি ৫০ একরও মুক্ত করা হবে।

কর্ণফুলী নদী দখল, মাটি ভরাট ও নদীতে সব ধরনের স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদের এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুই তীরের প্রায় দুই সহস্রাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ দুঃখজনক উল্লেখ করে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ইনকিলাবকে বলেন, জাতীয় স্বার্থেই কর্ণফুলীকে রক্ষা করতে হবে। তিনি এ জন্য চট্টগ্রামবাসীকে আরো বেশি সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।

https://www.dailyinqilab.com/article/258523/