ইন্ট্রা অপারেটিভ ইমেজিং সিস্টেম। ছবি: প্রতীকী
৪ জানুয়ারি ২০২০, শনিবার, ১২:৩৬

চট্টগ্রাম ও সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: ১৮ কোটি টাকায় কেনা তিন মেশিন ৮ বছরেও চালু হয়নি

‘ইন্ট্রা অপারেটিভ ইমেজিং সিস্টেম’-এর দুটি মেশিন চমেক হাসপাতালে এখনও স্থাপিত হয়নি, আরেকটি এসএসএমসিএইচ-এ বসানো হলেও চালু হয়নি * চাহিদা ছাড়াই অপরিকল্পিতভাবে কেনা হয় মেশিনগুলো * জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর করার নির্দেশ

আঠার কোটি টাকা ব্যয়ে ৩টি ‘ইন্ট্রা অপারেটিভ ইমেজিং সিস্টেম’ মেশিন কেনা হয় ২০১২ সালে। মেশিনগুলো কেনা হয়েছিল সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে এবং কোনো স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানের বা হাসপাতালের চাহিদা ছাড়াই।

সেগুলো বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হলেও সবাই গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করে। এক পর্যায়ে দুটি মেশিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ও একটি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (এসএসএমসিএইচ) পাঠানো হয়। এরপর ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সেগুলো চালু করা সম্ভব হয়নি।

২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির (পিএ কমিটি) ৭ম বৈঠকে মেশিন তিনটি জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে মন্ত্রণালয়ে জানানোর নির্দেশ দেয়া হয়। কারণ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেশিনটি অচল অবস্থায় পড়ে আছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেশিন দুটি এখনও প্রতিস্থাপন করা হয়নি।

এছাড়া সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের অডিট আপত্তির অনুচ্ছেদ ৩-এ বলা হয়েছে, অপরিকল্পিতভাবে এবং ব্যবহারকারীর চাহিদা বা প্রয়োজন ছাড়া ইন্ট্রা অপারেটিভ ইমেজিং সিস্টেম মেশিন ক্রয়ের ফলে সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে ১৮ কোটি ৬ লাখ ৪৫ হাজার ৫০৬ টাকা।

এই মেশিনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি মেডিকেল কলেজের একজন অধ্যাপক (সার্জারি) বলেন, হাসপাতালের জেনারেল সার্জারিতে এই মেশিনের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। তবে কার্ডিওভাসকুলর সার্জারি, কার্ডিয়াক সার্জারি বা প্লাস্টিক সার্জনদের চিকিৎসায় এর কিছু উপযোগিতা রয়েছে।

এটি একটি আধুনিক প্রযুক্তি। বাংলাদেশে এর ব্যবহার নেই বললেই চলে। ভারতেও দিল্লির দু-একটি হাসপাতাল ছাড়া এ মেশিনের ব্যবহার হয় না। মেশিনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি বলেন, উন্নত দেশে জটিল প্লাস্টিক সার্জারি অ্যান্ড রি-কনস্ট্রাক্টিভ সার্জারিতে এই মেশিন ব্যবহার হয়ে থাকে।

তবে বাংলাদেশে এই মেশিন ব্যবহারের কোনো উপযোগিতা বর্তমানে নেই। কারণ দেশে এই মেশিন চালানোর ওপর কোনো প্রশিক্ষণ কারও নেই। বর্তমানে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউট ছাড়া, দেশের অন্য কোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ ধরনের মেশিন ব্যবহারের কোনো সুযোগ বা প্রয়োজনীয়তাও নেই।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১২ সালে দেশের কোনো হাসপাতালের চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও ৫টি ইন্ট্রা অপারেটিভ ইমেজিং সিস্টেম কেনা হয়। এরপর সেগুলো কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে কার্ডিওভাসকুলার সার্জারি বিভাগ চালু না থাকায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইন্ট্রা অপারেটিভ ইমেজিং সিস্টেম মেশিন গ্রহণ না করে ফিরিয়ে দেয়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মেশিন তিনটির দুটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও একটি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর।

জানা যায়, ২০১৩ সালে ২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. হাবিবুর রহমান কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালককে যন্ত্রটি ফেরত নিতে অনুরোধ জানান। এ সংক্রান্ত এক স্মারকে তিনি বলেন, ‘কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরবরাহকৃত ইন্ট্রা অপারেটিভ ইমেজিং সিস্টেম যন্ত্রটি মেসার্স বায়োজিন ফার্মা লিমিটেড সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে আসে। যা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এই হাসপাতাল একটি জরুরি কমিটি গঠন করে। হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগ চালু না থাকায় মেশিনটি ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই।’

এর আগে ২০১২ সালের ৭ নভেম্বর মেশিন ব্যবহারে অপারগতা প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে (সিএমএসডি) লিখিত দেয় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। এক স্মারকে সিএমএসডি পরিচালককে তিনি বলেন, ‘অত্র হাসপাতালে ইন্ট্রা অপারেটিভ ইমেজিং সিস্টেম মেশিন সরবরাহ করা হয়েছে। যা চালু করার জন্য কোনো বিভাগ ও সার্জন নেই এবং অবকাঠামোগত কোনো সুবিধা এই হাসপাতালে নেই।’

শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ব্রি. জে. মো. আফজালুর রহমান এই মেশিন ফেরত নিতে সিএমএসডিকে বলেন। এক স্মারকে তিনি বলেন, ‘অত্র হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, এটি মূলত কার্র্ডিয়াক সার্জারি বা কার্ডিওভাসকুলার সার্জারি বিভাগে ব্যবহার করা হয়। সার্জারি বিভাগের এটি ব্যবহারের অবকাশ নেই। এই হাসপাতালে ওইসব বিভাগ নেই, এমনকি অদূর ভবিষ্যতে স্থাপন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।’

এসব স্মারকের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৎকালীন পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. এসএম ইব্রাহীম মেশিন তিনটি ঢাকা, চট্টগ্রাম ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশ দেন। নির্দেশ মোতাবেক একটি মেশিন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং দুটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এই দুই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও মেশিনগুলো চালু করা সম্ভব হয়নি।

এই ‘ইন্ট্রা অপারেটিভ ইমেজিং সিস্টেম’ মেশিনগুলো চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. মো. আমিনুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, এমন কোনো নির্দেশনা তিনি এখনও পাননি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/262972/