৪ জানুয়ারি ২০২০, শনিবার, ১২:৩১

২০১৯ সালে দেশে ফিরেছে ৪ হাজার শ্রমিকের লাশ

প্রবাসী শ্রমিকের লাশ দেশে ফেরার সংখ্যা বেড়ে গেছে। প্রতি বছরই সেই সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি হিসাবে গত এক দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করতে যাওয়া ২৭ হাজার ৬শ’৬২জন শ্রমিকের লাশ দেশে ফেরত এসেছে। ২০১৯ সালেও তিন হাজার ৬৫৮ জনের লাশ ফিরেছে দেশে, অর্থাৎ গত বছর গড়ে প্রতিদিন ১০ জনের বেশি প্রবাসী শ্রমিকের লাশ দেশে ফিরে এসেছে। বেশির ভাগের মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং স্বাভাবিক মৃত্যু বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯৩ সালে মাত্র ৫৩ জন শ্রমিকের লাশ ফেরত এসেছিল প্রবাস থেকে, যে সংখ্যা ২০১৯ এ নভেম্বর পর্যন্ত এসে হয়েছে তিন হাজার ৬৫৮ জন। ডিসেম্বরে হিসেব যোগ হলে লাশের সংখ্যা ৪ হাজারের কাছাকাছি। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড বলছে, এই হিসাব কেবল যেসব লাশ ফেরত আসে সেই সংখ্যা ধরে। এর বাইরে অনেক লাশ সংশ্লিষ্ট দেশে দাফন করা হয়, যার হিসাব সব সময় হালনাগাদ থাকে না।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের উপ-পরিচালক জাহিদ আনোয়ার জানিয়েছেন, "যেসব প্রবাসীর লাশ ফেরত আসে দেশে, তাদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে লাশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে আসা ডেথ রিপোর্টে যা উল্লেখ থাকে, সেটিই জানা যায়। সেই হিসাবে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক,স্বাভাবিক মৃত্যু, এবং আত্মহত্যার কথা বেশি উল্লেখ থাকে। এর বাইরে কর্মস্থলে দুর্ঘটনা, সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিদগ্ধ হওয়া এবং অসুস্থতার কারণও উল্লেখ থাকে মৃত্যুর কারণ হিসেবে।

২০০৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশে প্রবাসী কর্মীর লাশ এসেছে ৪০ হাজার ৮০৬টি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যেসব মধ্য বয়সী কর্মীদের লাশ আসছে তাদের বেশির ভাগের মৃত্যু স্ট্রোকের কারণে। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের দেওয়া তথ্য থেকে এসব জানা গেছে। তাই আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস (১৮ ডিসেম্বর) পালনের এই সময় প্রশ্ন উঠেছে প্রবাসী কর্মীদের অকাল মৃত্যু নিয়ে।

২০০৫ সালের পর থেকে দেশে প্রবাসীদের লাশ আসার সংখ্যা বাড়ছে। ২০০৫ সালে লাশ এসেছে ১ হাজার ২৪৮, ২০০৬ সালে ১ হাজার ৪০২, ২০০৭ সালে ১ হাজার ৬৭৩, ২০০৮ সালে ২ হাজার ৯৮, ২০০৯ সালে ২ হাজার ৩১৫, ২০১০ সালে ২ হাজার ৫৬০, ২০১১ সালে ২ হাজার ৫৮৫, ২০১২ সালে ২ হাজার ৮৭৮, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৭৬, ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৩৩৫, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৩০৭, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৪৮১, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৩৮৭, ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৭৯৩ এবং ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৩ হাজার ৬৬৮ জনের। এই তালিকায় রয়েছেন নারী কর্মীরাও। চার বছরে নারী কর্মীর লাশ এসেছে ৪৭৯ জনের। যার মধ্যে ২০১৬ সালে ১১৭, ২০১৭ সালে ১১১, ২০১৮ সালে ১৩০ এবং ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১২১ জন নারীর লাশ দেশে এসেছে। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের দেওয়া তথ্য মতে, নারী কর্মীদের মধ্যেও বেশিরভাগ মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক, যার বেশির ভাগই এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এছাড়া আত্মহত্যা করেছেন ৪৪ জন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং ধার করে বিদেশ যাওয়ায় টাকা উপার্জনে মানসিক চাপে ভোগেন প্রবাসী কর্মীরা। প্রবাসীদের এমন অকালমৃত্যুর কারণ নিয়ে এখনও কোনও অনুসন্ধান হয়নি। প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো মৃত্যুর এই সংখ্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন। গত চার বছরে যত প্রবাসীর লাশ এসেছে, তাদের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অন্তত ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যু হয়েছে আকস্মিকভাবে। তাদের বয়স ২৮ থেকে ৪০ এর মধ্যে।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, মানুষ মারা যাবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু অল্প বয়সে, মধ্যবয়সে কিংবা অকাল মৃত্যু উদ্বেগের। তরুণ বয়সে যারা মৃত্যুবরণ করছেন তাদের নিয়ে আমাদের মধ্যেও উদ্বেগ আছে। বিদেশের আবহাওয়া কিংবা পরিবেশ গ্রীষ্মকালে ৪০ থেকে ৫০ ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে যায়। সে হিসেবে অনেকে হিট স্ট্রোকেও মারা যায়। যার জন্য কয়েকদিন আগে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আমাদের মিটিং ছিল। সেখানে এই মৃত্যুর বিষয়ে আমি আলোচনা করেছিলাম। তারা আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন, যারা বিদেশে যায় তাদের যেন আমরা কিছুটা ব্রিফিং দেই- কীভাবে চলতে হবে, কীভাবে থাকতে হবে, পানি বেশি খেতে হবে এসব বিষয়ে।

তিনি বলেন, হার্ট ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় নানারকম পরামর্শ সম্বলিত একটি প্যামপ্লেট বানিয়েছি। যখন প্রাক বহির্গমন ট্রেনিং দেই তখন এটাও একটা করে দেবো যাতে তারা সাবধানতা অবলম্বন করতে পারেন। অকালমৃত্যু কিংবা অস্বাভাবিক মৃত্যু আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না। এছাড়া আত্মহত্যার বিষয়টি নিয়ে আমাদের বিরাট প্রশ্ন আছে। আমরা সৌদি সরকারের কাছে তাদের তথ্য দিয়েছি। তারা অবশ্যই তদন্ত করবে বিষয়টি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মপ্রবাসী কর্মীদের অকাল মৃত্যু কমাতে গন্তব্য দেশের আবহাওয়া, খাবার ও সংস্কৃতি সম্পর্কে শ্রমিকদের আগেই ধারণা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান মনে করেন, সৌদি আরবের তাপমাত্রা অনেক বেশি, কখনও ৫০ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে, কতটুকু মাংস খাবে, কতটুকু পানি খাবে, ধুমপানে বিধিনিষেধ সম্পর্কে তাদের ধারণা দেওয়া হয় না। সে দেশে মাংস খুব সস্তা, সিগারেটও অনেক কম দামে পাওয়া যায়।

কিনি বলেন, এই মৃত্যুর সঙ্গে আবার উচ্চ অভিবাসন ব্যয় জড়িত আছে। একজন কর্মী যখন অনেক টাকা খরচ করে যান তার সবসময় টেনশন থাকে এই টাকা তুলে আনার। এই টাকা তোলার জন্য তিনি মরিয়া হয়ে থাকেন। ১৮ ঘণ্টা থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করেন। এক রুমের মধ্যে গাদাগাদি করে থাকেন, অতিরিক্ত টাকা কামাইয়ের জন্য অবৈধ হয়ে যান। অবৈধ হয়ে গেলে পরে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন না। তিনি বলেন, আমাদের কিন্তু ৬১ শতাংশ লাশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে যার মধ্যে ৩১ শতাংশ সৌদি আরবের।

বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) গবেষক ড. জালাল উদ্দিন শিকদার বলেন, গার্মেন্টসের বাইরে অন্যান্য খাত যেমন কন্সট্রাকশন খাতে যারা কাজ করতে যান, তাদের কী শুধু বেতন নিশ্চিত করেই শেষ? তাদের বিনোদনের সুযোগ কোথায়? যেখানে আমাদের কর্মীরা হাসি-খুশি আনন্দ নিয়ে কাজ করবেন সে রকম একটা পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি বলে আমি মনে করি। এছাড়া স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় বিদেশগামী কর্মী মানসিকভাবে প্রস্তুত কিনা তা যাচাই করা দরকার।

বিদেশ যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে প্রবাসীদের পুনরায় স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, যারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং অভিবাসনের প্রয়োজন রয়েছে এ রকম লোকজনকে বিদেশে পাঠানো উচিত। কারণ একজন কর্মী বিদেশ যাওয়ার সময় প্রচুর স্ট্রেস (মানসিক চাপ) নিয়ে যান। দেখা যায় যে, শারীরিকভাবে শক্ত না এবং অনেক টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশ যাচ্ছেন অনেকে। এই অবস্থায় যখন উষ্ণ মরুর দেশে যান তখন তারা একটা বড় ঝুঁকিতে থাকেন।

বাংলাদেশে অভিবাসন খাত নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলছেন, প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু তদন্তে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। "লাশের গায়ে ডেথ সার্টিফিকেটে যা লেখা থাকে, তাই সবাই জানে এবং মেনে নেয়। কিন্তু বাংলাদেশেও যদি সেটি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবার ব্যবস্থা থাকত তাহলে স্বজনদের মনে কোন সন্দেহ থাকতো না। শ্রমিকদের কাজের নিরাপদ পরিবেশ, তাদের স্বাস্থ্য এবং মৃত্যুর কারণ দেশে যাচাই না করলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে না।

https://www.dailysangram.com/post/402192