৪ জানুয়ারি ২০২০, শনিবার, ১২:৩০

ব্যাংক ঋণের সুদ হার নিয়ে চলছে ‘ইঁদুর বিড়াল’ খেলা

ব্যাংক ঋণের সুদ হার নিয়ে ইঁদুর বিড়াল খেলা চলছেই। কার্যত বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটছে না। আমানতের সুদ হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে এলে তারল্য সংকট আরো প্রকট হবে। ব্যাংকগুলো আমানত পাবে না। এমনিতেই ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট অব্যাহত রয়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে আসার আগে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কে নেমে এসেছে, যাকে অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের বলছেন বিশ্লেষকরা।

জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আগে তৎকালিন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ব্যাংকিং খাত থেকে কর্পোরেট সুদ হার কমিয়ে ৩৮ শতাংশ করা হয়েছে। তখন ব্যাংখ মালিকদের সংগঠন বলেছিল তারা সুদ হার কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হবে। সরকার বাজেটে কর্পোরেট সুদ হার হার কমালেও ব্যাংক মালিকরা নানা অজুহারে সুদ হার ১১ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত আদায় করছে। শুধুতাই নয় ক্রেডিট কার্ড ক্ষুদ্র ঋণসহ বেশ কয়েকটি খাতে এখনও ১৮ শতাংশের ওপরে সুদ আদায় করছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এসব নিয়ন্ত্রন করার কেউ নেই।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে আমরা কোনভাবেই সুদ হার নির্ধারন করে দিতে পারি না। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে হলে এমনিতেই নিয়ন্ত্রন হবে। তারপরেও আমরা বহুবার সুদ হার কমাতে নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু তেমন কাজে আসেনি। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে রয়েছে বিদেশি ব্যাংকগুলো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৃহস্পতিবার যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, নভেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অক্টোবর শেষে তা ছিল ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতিতে এই খাতে ঋণের যে লক্ষ্য ধরেছে, বর্তমান অঙ্ক তার থেকে প্রায় ৫ শতাংশ পয়েন্ট কম।

আর এটাকেই এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখছেন অর্থনীতির বিশ্লেষক এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ও আহসান এইচ মনসুর।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টার মির্জ্জা আজিজ বলেন, এটা খুবই উদ্বেগের যে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, যা মুদ্রানীতির লক্ষ্যের চেয়ে অনেক কম।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর একে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ আখ্যায়িত করেন।

তিনি বলেন, এমনিতেই বিনিয়োগের অবস্থা খারাপ। বেশ কিছুদিন ধরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কম। তার উপর ব্যাংক থেকে সরকার প্রচুর ঋণ নেওয়ায় এই প্রবাহে আরও টান পড়েছে।

বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ খরা কাটাতে দীর্ঘদিন ধরে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহার কমিয়ে এক অঙ্কে (১০ শতাংশের কম) আনার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংক মালিকরাও দেড় বছর ধরে এমন ঘোষণা দিয়ে নানা সুবিধা নিয়ে আসছেন, তবে সুদহার কমেনি।

সর্বশেষ গত ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর এই সুদ হার হবে ৯ শতাংশ।

নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে উৎপাদন খাতে অর্থাৎ শিল্প খাতে ৯ শতাংশ সুদে ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণের নির্দেশনা সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল বোর্ড সভায়।

কিন্তু এক সপ্তাহ না যেতেই ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) এবং ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা দেন, ১ জানুয়ারি নয়, ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে ৯ শতাংশ সুদহার। র্তমানে ব্যাংক ভেদে উৎপাদন খাতে সুদহার ১১ থেকে ১৪ শতাংশ।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। এই মন্থর গতির কারণে গত ৩১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯-২০ অর্থবছরের যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে, তাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমিয়ে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ ধরা হয়।

মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গর্বনর ফজলে কবির বলেছিলেন, আগের মুদ্রানীতিতে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হলেও অর্জিত হয়েছে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। তা থেকে বাড়িয়ে এবার ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে।

বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা নেই, নেই জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধ। বিদ্যুৎ-গ্যাস সমস্যারও উন্নতি হয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটও নেই।

কিন্তু এ সবের কোনো প্রভাব অর্থনীতির প্রধান সূচক বিনিয়োগে পড়েনি। যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই আটকে আছে বেসরকারি বিনিয়োগ।

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়ার এটা একটি কারণ উল্লেখ করে বলেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা রয়েছে। এর মানে, বিনিয়োগ হচ্ছে না। অন্যদিকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি আছে। এর মানে হচ্ছে শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহৃত হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে কলকারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমেছে ১০ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২০ শতাংশের মতো।

এ প্রসঙ্গে আহসান মনসুর বলেন, ঋণ প্রবাহ এবং ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি কমা মানে দেশে বিনিয়োগ কম হচ্ছে। ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে না।

ব্যাংক থেকে সরকারের লাগামহীন ঋণ নেওয়ার কারণে বেরসকারি খাত বঞ্চিত হচ্ছে মন্তব্য করে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনসুর বলেন, বাজেটে সরকার পুরোবছরের জন্য যে ঋণ নিতে চেয়েছিল তা প্রায় ৫ মাসেই নিয়ে ফেলেছে। তাহলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে কোথায়? সুদের হার কমলেই কী খুব লাভ হবে?

আহসান এইচ মনসুর বলেন,একটা বিষয় সবাইকে মনে রাখতে হবে, বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না। আর কর্মসংস্থান বাড়ানোই এখন আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাস নয় দিনে (১ জুলাই থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা নিয়ে ফেলেছে সরকার। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৯ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়েছে ৩৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। অর্থাৎ ১২ মাসে ব্যাংক থেকে সরকারের যে টাকা ধার করার কথা ছিল, তার পুরোটাই পাঁচ মাসে নিয়ে ফেলেছে।

লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আদায় এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে বাধ্য হয়েই সরকারকে ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিতে হচ্ছে, বলেন আহসান মনসুর।

https://www.dailysangram.com/post/402190