৩ জানুয়ারি ২০২০, শুক্রবার, ৭:১২

৬০ ফুট এখন কয় ফুট

সরেজমিন :আগারগাঁও মিরপুর-২ সড়ক

আগারগাঁও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের সামনে থেকে শুরু করে মিরপুর ২ নম্বর পর্যন্ত সড়কটির নাম 'কামাল সরণি' হলেও এলাকাবাসী '৬০ ফুট' নামেই চেনেন ও জানেন। কারণ, সড়কটির প্রস্থ ৬০ ফুট। এর মধ্যে দু'পাশে ৫ ফুট করে ১০ ফুট প্রশস্ত ফুটপাত থাকার কথা। কিন্তু সড়কটির চলাচলযোগ্য জায়গা বর্তমানে এতই সংকীর্ণ হয়ে এসেছে যে খোদ এলাকাবাসীই প্রশ্ন করেন, '৬০ ফুট তুমি কত ফুট।' ২০১৪ সালের শেষ দিকে ২৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৩ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়কটির প্রতিটি লেন এখন দখলের কারণে কোথাও কোথাও ১০-১২ ফুটও হয়ে গেছে। সম্প্রতি মিরপুর ২ নম্বর থেকে বাংলাদেশ বেতার পর্যন্ত সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সড়কটির খুব কম জায়গাই আছে, যেখানে দখল নেই। সড়ক ও এর ফুটপাত দোকানপাট, বালু-সুরকির স্তূপ, ওয়ার্কশপ, চায়ের দোকান, কাঁচাবাজার, ময়লা-আবর্জনার বিন ইত্যাদিতে ভরে উঠেছে। নিরাপদে চলাচলের প্রতিবন্ধকতায় পুরো সড়কটিই ঠাসা। কোথাও স্বাচ্ছন্দ্যময় ফুটপাত নেই- সংকীর্ণ অংশও ব্যবহার করা যায় না দোকানপাটের কারণে। পথচারীরা চলেন মূল সড়ক দিয়ে। ৬০ ফুট সড়কের কোথাও আর এখন ৬০ ফুট নেই।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মিরপুর এলাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ হোসেন জানান, ওই সড়ক থেকে অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদের জন্য তারা প্রায়ই অভিযান চালান। কিন্তু অভিযানের পরদিনই তা পুরোনো অবস্থায় ফিরে আসে। অথচ পুলিশ প্রশাসন উচ্ছেদের পর তদারকি অব্যাহত রাখলে নতুন করে আর দোকানপাট বসতে পারে না। এভাবে উচ্ছেদের পর আবারও বসার সুযোগ পেলে রাস্তা কখনও দখলমুক্ত করা যাবে না।

এলাকাবাসী জানান, উদ্বোধনের পর থেকেই সড়কটি মিরপুরবাসীর কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের কারণে কয়েক বছর ধরে সড়কটিতে যানবাহনের চাপ আরও বেড়েছে। কারণ, রোকেয়া সরণির আগারগাঁও থেকে মিরপুর পর্যন্ত সড়কটি সরু ও ভাঙাচোরা। সেখানে স্বাভাবিক চলাচলের উপায় নেই। তাই মিরপুর এলাকার অসংখ্য যানবাহনের চাপ পড়ে ৬০ ফুটে। দখলের পাশাপাশি ভাঙচুর ও গর্তের কারণে সংকুচিত ৬০ ফুটেও লাগে যানজট।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, সড়কটিতে গত তিন বছরে অন্তত ৩০ বার অভিযান চালানো হয়েছে। তারপরও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা, পুলিশ প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা ছাড়া এ ক্ষেত্রে কোনো ফল মিলবে না।

সরেজমিন চিত্র :মিরপুর রোডের মিরপুর পোস্ট অফিসের পাশ দিয়ে সড়কটিতে গেলেই দেখা যায়, বাঁ পাশে ফুটপাতে বসেছে গামছা-লুঙ্গির দোকান। আছে ফল, খেলনা ও ভ্রাম্যমাণ খাবার গাড়ির দোকান। ডানেই রাস্তার ভেতর গোটাদশেক টং দোকান। আরও একটু সামনেই ডানে রয়েছে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের অফিস ও প্রতিবন্ধীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কল্যাণী ইনক্লুসিভ স্কুল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কারণে জনসমাগম হওয়ায় সেখানে এসব টং দোকানের ব্যবসা বেশ জমজমাট। আরেকটু এগোলেই মূল ৬০ ফুটে ওঠার বাঁক। সেখানকার রাস্তা ভেঙেচুরে একেবারেই তছনছ হয়ে গেছে। ফুটপাত নেই, প্রস্থও ৬০ ফুটের জায়গায় বড়জোর ২০ ফুট। ঢাকা শহরের কোথাও যানজট না থাকলেও বড়বাগের এই ছোট বাঁকে সারাক্ষণ যানজট লেগেই থাকে।

বড়বাগের দুলাল বুক হাউসের কর্মচারীরা জানান, বাঁক পার হতেই ১৫ মিনিট লাগে। রাস্তার ওপর গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়। মোড় পেরিয়ে বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারের সামনে যেতেই উদাহরণ মিলল তার কথার। ফার্মগেটগামী সারি সারি লেগুনা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। যেন পুরোদস্তুর লেগুনাস্ট্যান্ড। আরেকটু এগোলেই রাস্তার জায়গা হয়ে উঠেছে এলাকাবাসীর গৃহস্থালির বর্জ্য ফেলার স্থান- রাস্তার মধ্যেই রাখা হয়েছে বর্জ্য ফেলার কয়েকটা কনটেইনার। ফলে ব্যবহারযোগ্য রাস্তার প্রস্থ প্রতিটি লেনে বড়জোর ১০ ফুটে নেমে এসেছে। পুরো সড়কে বর্জ্য ফেলার জন্য সংরক্ষিত এ রকম অন্তত পাঁচটি স্থান রয়েছে। আরেকটু এগোলে স্বপ্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে রাস্তার ওপরেই বসেছে সবজিবাজার।

স্থানীয় বাসিন্দা মেহের সুলতানা জানান, সকালে এখানে পুরো বাজার বসে। তখন মাছ-মুরগিও পাওয়া যায়। আর মনিপুর স্কুলের আশপাশে সব সময় রিকশাভ্যান-প্রাইভেটকারের জটলা লেগে আছে। স্কুল ছুটি ও শুরুর সময় এ পথে যাতায়াতকারীরা ভয় আর অস্বস্তিতে থাকেন। মোহনা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে দেখা যায়, রাস্তার ভেতরেই রাখা হয়েছে ইট-বালু-সুরকি, যা মজুদ করে রাখা হয়েছে পাশের নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের জন্যে। এর পাশেই রয়েছে ময়লা ফেলার স্থান। সেখানে ফুটপাত ভেঙেচুরে একাকার।

মনিপুর স্কুলের কিছু পরেই ভাই ভাই কাঁচাবাজারের সামনে দেখা গেল ফুটপাতে ক্রোকারিজের পসরা। দোকানি আফসান আলী বললেন, অনেকেই তো ফুটপাতে ব্যবসা করছে। তিনি সেখানে মাত্র কয়েকটা জিনিসপত্র রেখেছেন, যাতে লোকজন বুঝতে পারে, এখানে দোকান আছে। তা না হলে কাস্টমার আসে না। মনিপুরের লাজ ফার্মার পাশে দেখা গেল রাস্তা ও ফুটপাতের ওপর গড়ে উঠেছে গ্যারেজ। ফলে সেখানে রিকশার জট লেগেই আছে। রিকশাভ্যান মেরামত করেন ইয়াসিন মিয়া। তিনি বলেন, প্রতিদিন পুলিশকে ৫০ টাকা করে দিতে হয়। তা হলে আর কোনো সমস্যা করে না। না হলে ঝামেলা হয়। একই কথা জানান সড়ক-ফুটপাতের সব ব্যবসায়ী।

৩৩/২/এ উত্তর পীরেরবাগে আরআর এন্টারপ্রাইজের সামনের রাস্তায় দেখা গেল কয়েকটা ঠেলাগাড়ি। এগোতেই বোঝা গেল, দোকানটি থেকে বিক্রি করা রড-সিমেন্ট ঠেলাগাড়িতে করে সরবরাহ করা হয়। আরআর এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করে বলেন, 'এই দোকানের সামনে কিন্তু তেমন যানজট হয় না। ঠেলাগাড়ি রাখলেও তেমন সমস্যা হয় না।'

কিছুদূর এগোলেই দেখা গেল মেডিহোম হসপিটাল। সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে একটি অ্যাম্বুলেন্স। হাসপাতালের পাশে রয়েছে ওষুধের দোকান 'রাইট ফার্মা'। এর সাইনবোর্ড রাখা হয়েছে রাস্তার ভেতরে। সাইনবোর্ডে তীর চিহ্ন দিয়ে লেখা- 'এখানে সকল প্রকার দেশি-বিদেশি ওষুধ, শিশুখাদ্য ও প্রসাধনসামগ্রী ডিসকাউন্টে বিক্রয় করা হয়'।

সড়কটির পশ্চিম আগারগাঁওয়ে রয়েছে মিজান জামে মসজিদ। মসজিদের প্রায় অর্ধেকটাই রাস্তার ভেতরে। জায়গা না ছাড়ায় মসজিদের প্রান্তে রাস্তার প্রস্থ বড়জোর ছয় ফুট। স্থানীয়রা জানান, মসজিদটির জন্য সরকার অন্যখানে জায়গা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেয়নি। তাই মসজিদটি এখানেই রয়েছে। মসজিদের উত্তর পাশেই একটি পারিবারিক কবরস্থান। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মালিকপক্ষকে স্থানান্তরের অনুরোধ জানালেও তা সরানো হয়নি। সেখানেও সড়কে লেনের প্রস্থ ১০ ফুটের নিচে। সবচেয়ে বেহাল অবস্থা পশ্চিম আগারগাঁও এলাকায়। সেখানে রাস্তার ভেতরেই ফার্নিচারের শোরুম গড়ে উঠেছে।

এ পথে চলাচলকারী মনিপুরের বাসিন্দা শেখ ফয়সাল বলেন, রাস্তাটি হওয়ার আগে অপেক্ষায় ছিলেন, কবে রাস্তাটি চালু হবে আর দ্রুতই আগারগাঁও পৌঁছে যাবেন। সেই স্বপ্ন উবে গেছে। মনিপুরের গৃহবধূ উল্লাসী বিশ্বাস বলেন, 'ছেলেকে প্রতিদিন স্কুলে দিতে যাই। কী যে অবস্থা বলে বোঝানো যাবে না। সড়কটিতে ঠিকমতো হাঁটারও উপায় নেই।'

স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর হারুন অর রশিদ বলেন, 'রাস্তাটি দখলমুক্ত করতে অনেকবার মিটিং করেছি। অনেকবার অভিযানও চালিয়েছি। কিন্তু কাজ হচ্ছে না।'

https://samakal.com/capital/article/20018596/