৩ জানুয়ারি ২০২০, শুক্রবার, ৭:১০

কারাগার দেখতে বিদেশ যাবেন ১৩ সরকারি কর্মকর্তা

বিদেশে বন্দিরা কিভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন তা শিখে এসে দেশে প্রয়োগ করতেই এই ‘শিক্ষা’ সফর

অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিসের সব শেষ তথ্য মতে, বিশ্বে নিরাপদ ও কম অপরাধপ্রবণ দেশ হিসেবে ১৫০টি দেশের মধ্যে উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডার অবস্থান ৬ নম্বরে। অথচ সেই নিরাপদ ও কম অপরাধপ্রবণ দেশে কারাগারে বন্দিরা কিভাবে জীবনযাপন করেন এবং সেখানকার কারাগারগুলোর ব্যবস্থাপনা কেমন তা দেখতে ১৩ জন সরকারি কর্মকর্তা দেশটি সফরে যাবেন। উদ্দেশ্য সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে এসে এ দেশে কাজে লাগানো। শুধু কানাডাই নয়; কম অপরাধপ্রবণ দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান যেখানে বিশ্বে ১৩ নম্বরে, সেই দেশটিতেও যাবেন সরকারি কর্মকর্তারা। ‘দেশের সকল কারাগারে স্বজন লিংক স্থাপন’ শিরোনামের একটি প্রকল্পের (এ প্রকল্পের আওতায় বন্দিরা মোবাইল বুথ ব্যবহার করে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাবেন) আওতায় কর্মকর্তারা ওই দেশ দুটিতে সফরে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। এই ১৩ জন কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন কারা অধিদপ্তর থেকে চারজন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের তিনজন, পরিকল্পনা কমিশন থেকে তিনজন, এটুআই প্রকল্প থেকে দুইজন এবং প্রকল্প পরিচালক একজন। কোন কোন কর্মকর্তা সফরে যাবেন, তাঁদের নাম এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে এই বিদেশ সফর নিয়ে আপত্তি তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, দেশের ৬৮টি কারাগারে বন্দিরা যাতে তাঁদের পরিবার-পরিজনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলতে পারেন, সে জন্য ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য—বন্দিদের জন্য কারাগারের ভেতরে মোবাইল ফোন বুথ নির্মাণ করা হবে; যাতে তাঁরা পরিবার-পরিজনের সঙ্গে নির্দিষ্ট একটি সময় কথা বলতে পারেন। এই প্রকল্পের আওতায়ই সরকারি কর্মকর্তারা চারটি দেশ বাছাই করেছেন। সেসব দেশের কারাগার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাঁরা জ্ঞানার্জন করতে যাবেন। সেই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের কারাগারে কাজে লাগাবেন। দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে সাতজনের একটি গ্রুপ যাবে অস্ট্রেলিয়া ও ব্রাজিল। ছয় সদস্যের আরেকটি গ্রুপ যাবে কানাডা ও আর্জেন্টিনা। প্রত্যেক গ্রুপ সাত দিন করে ওই সব দেশে অবস্থান করবে। এই সফরে মোট খরচ হবে ৪০ লাখ টাকা, যা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জোগান দেওয়া হবে। ৫০ কোটি টাকার নিচে হওয়ায় প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় যাবে না। প্রকল্পটি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান নিজ ক্ষমতাবলে অনুমোদন করতে পারবেন। প্রকল্পটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়টি নিয়ে কথা হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বিদেশ সফর অযৌক্তিক নয়। শেখার অনেক কিছুই আছে। কিন্তু কারাগারে বন্দি ও কারাগার দেখতে যে চারটি দেশ বাছাই করা হয়েছে, ওই সব দেশের অপরাধের ধরনের সঙ্গে বাংলাদেশের অপরাধের ধরনের মিল নেই বললেই চলে। ওই সব দেশের আইনি কাঠামোও বাংলাদেশের মতো নয়। কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই দেশ। কিসের ভিত্তিতে এই দুই দেশ বাছাই করা হয়েছে; তা খুবই কৌতূহলের। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রযুক্তির বিকাশের ফলে ঘরে বসেই অনলাইনে পৃথিবীর তাবৎ তথ্য পাওয়া যায়। জনগণের করের টাকায় এসব অপ্রাসঙ্গিক বিদেশ সফর সরকারি কর্মকর্তারা এড়িয়ে গেলে ভালো হয়। কারণ, কারাগার ব্যবস্থাপনা দেখতে কানাডায় যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। কানাডায় পিএইচডিতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি সারোয়ার শিপন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কানাডার অপরাধ এবং শাস্তির ধরনের সঙ্গে বাংলাদেশের অপরাধ এবং শাস্তির ধরনের কোনো মিল নেই। বাংলাদেশে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্তকে ধরে জেলে পাঠানো হয়। কানাডায় জেলের পরিবর্তে কমিউনিটি সেবা করতে পাঠানো হয়, জরিমানা করা হয়। কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলেও ওই অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সময়টা বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। কানাডায় সহজেই কাউকে জেলে পাঠানো হয় না। সারোয়ার শিপন বলেন, এসব বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাইলে বাংলাদেশের মতো অপরাধ বা সামাজিক সাংস্কৃতিকভাবে মিল আছে এমন কোনো দেশ সফরে গেলে সেটি ভালো হবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে এখন মোট কারাগার আছে ৬৮টি। এর মধ্যে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার আর ৫৫টি জেলা কারাগার। বর্তমানে কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার ৬৬৪ জন। এর বিপরীতে বন্দি আছেন ৯০ হাজারের বেশি, যা ধারণক্ষমতার দিগুণ। প্রতিদিন সারা দেশে ২০ হাজার আত্মীয়-স্বজন বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে যান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বন্দিদের সঙ্গে আত্মীয়-স্বজনের নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ ও যোগাযোগ না হলে বন্দিদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। কারাগার থেকে পালানোর প্রবণতা বাড়তে থাকে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করা হবে। সে জন্য প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে।

এই প্রকল্পের আওতায় ৬৮টি কারাগারের জন্য দুটি করে মোট ১৩৬টি ল্যাপটপ কেনার প্রস্তাবও করা হয়েছে। এতসংখ্যক ল্যাপটপের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। একই সঙ্গে প্রকল্পটি শেষ হয়ে গেলে এই ল্যাপটপ ও বুথের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে কমিশনের। প্রকল্পটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৬৮টি কারাগারে মোট মোবাইল ফোন বুথ স্থাপন করা হবে ৩৬৫টি। ৫০টি কারাগারে হবে তিন বুথবিশিষ্ট রুম। আর ১৮টি কারাগারে পাঁচ বুথবিশিষ্ট রুম। প্রতি ৫০০ বন্দির জন্য একটি বুথ স্থাপন করা হবে। কর্মকর্তারা বলছেন, এরই মধ্যে টাঙ্গাইল কারাগারে পাইলট আকারে টেলিফোন বুথ স্থাপন করা হয়েছে। কারাগারে বন্দিরা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কিভাবে কথা বলবেন, তার একটি নীতিমালা ২০১৫ সালে করা হয়েছে। বুথ স্থাপনের পর বিদ্যমান নীতিমালার আলোকে বন্দিরা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2020/01/03/858285