কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদ। ফাইল ছবি
২ জানুয়ারি ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১২:১২

ভূমিদস্যুদের দখলে কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের ৩শ’ কোটি টাকার সম্পদ

অধিকাংশ জমি ও পুকুরের মালিকানার রেকর্ড গায়েব

কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের ৩শ’ কোটি টাকা মূল্যের ৫৬ দশমিক ৫৮ একর জমি ও ৫০টি বড় পুকুর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নির্বিঘ্নে ভোগদখল করছে একশ্রেণির ভূমিদস্যু। সুষ্ঠু তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় তারা এ সম্পদ দখলে নেয়ার সুযোগ পেয়েছে।

শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক প্রভাব আর এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে ভূমিদস্যুরা অধিকাংশ জমি ও পুকুরের মালিকানার প্রকৃত রেকর্ড পর্যন্ত গায়েব করে ফেলেছে।

জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে চক্রটি জমি ও পুকুরের মালিক সেজে বসেছে। পরিস্থিতি এমন যে, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিজেও জানেন না পরিষদের সম্পদের পরিমাণ কত।

অনুসন্ধানে জানা যায়- অধিগ্রহণ, ক্রয়, দান ও বিনিময় সূত্রে কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের ১৫৮ দশমিক ৬৩ একর স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। ‘দ্য ইস্ট বেঙ্গল’ এবং ‘আসাম গেজেট ডিক্লারেশন’, ‘ন্যাশনাল গেজেট’, ‘দ্য ক্যালকাটা গেজেট’, ‘দ্য ঢাকা গেজেট’ ইত্যাদিতে এসব সম্পত্তির বিবরণ রয়েছে।

এলাকার জনগণ যখন পুকুরের অভাবে পানি সংকট, চিকিৎসালয় ও চিকিৎসকের অভাবে চিকিৎসা সংকট এবং ইটাখলার অভাবে স্থাপনা তৈরির সমস্যায় ভুগছিল (১৮৮৫-১৯৩৯ সাল) তখন জেলা পরিষদ এসব সম্পত্তি ক্রয় কিংবা অধিগ্রহণ করে দাতব্য চিকিৎসালয়, পুকুর, ইটাখলা ইত্যাদি গড়ে তোলে।

স্বাধীনতাপূর্ব ও উত্তরকালেও জেলা পরিষদের এসব অবকাঠামোর নিদর্শন অবিকৃত ছিল। কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে সুষ্ঠু তদারকির অভাবে ইটখোলা ও দাতব্য চিকিৎসালয়গুলো মুখ থুবড়ে পড়ে। পরিত্যক্ত ও জরাজীর্ণ অবস্থায় দীর্ঘদিন পড়ে থেকে ধ্বংস কিংবা গণলুটপাটের শিকার হয় এসব প্রতিষ্ঠান।

পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় একশ্রেণির স্থানীয় প্রভাবশালীর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে এসব মূল্যবান সম্পদে। জেলা পরিষদের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে দাতব্য চিকিৎসালয়, ইটখোলার বিপুল পরিমাণ জমি এবং পুকুর দখলে নিয়ে নেয় তারা।

দীর্ঘদিন দখলে থাকায় ইতিমধ্যে অধিকাংশ ভূমি ও পুকুর ভূমি দস্যুদের নামে আরএস রেকর্ড হয়ে গেছে। আর এ সুযোগে তাদের কেউ কেউ জোত ও সিএস রেকর্ডের মালিকের উত্তরাধিকারীদের নাম ব্যবহার করে জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ভুয়া দলিল তৈরি করে এসব সম্পত্তি হজমের প্রয়াস চালাচ্ছে।

বেহাত হয়ে যাওয়া সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে- কিশোরগঞ্জ-হোসেনপুর সড়কের ডাহরা এলাকায় ইটাখলার জন্য ব্যবহৃত ১৫ বিঘা ১৯ কাঠা, একই সড়কের নারান ডহর এলাকায় অবস্থিত ইটাখলার জন্য ব্যবহৃত ১৩ বিঘা ১৭ কাঠা, ভৈরব কামালপুর গোরস্থান এলাকায় ৩ দশমিক ১৬ একর, তাড়াইল উপজেলার দড়িজাহাঙ্গীরপুর গ্রামের দশমিক ৫০ একর পুকুর, ভৈরব উপজেলার শিমুলকান্দি গ্রামের দশমিক ৫৩ একর পুকুর, মিঠামইন উপজেলার আবদুল্লাহপুর গ্রামে ১ দশমিক ২৪ একর পুকুর, সদর উপজেলার বড়খাপন ও পাঁচদাহ গ্রামে ৯ দশমিক ৯২ একর জমি, কটিয়াদী উপজেলার বড়গ্রাম দাতব্য চিকিৎসালয়ের ১ দশমিক ১০ একর, হোসেনপুর উপজেলার বাগান-খেলার মাঠ ও সিভিল ইংলিশ স্কুলের ২ বিঘা ৬ কাঠা জমি।

বুধবার দুপুরে সরেজমিন পরিদর্শনকালে কিশোরগঞ্জ-হোসেনপুর সড়কের নারানডহর (নারোদহার) গ্রামে গিয়ে জেলা পরিষদের ১৩ বিঘা ১৭ কাঠা জমিতে রাকিব ব্রিকস নামে একটি ইটাখলার অস্তিত্ব পাওয়া যায় । আর বাকি জমি দখলদারদের ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে।

এ সময় রাকিব ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যানের ছোট ভাই শফিকুল ইসলাম বাবলুর সঙ্গে কথা হয়। তিনি দাবি করেন, ‘প্রায় ৭০ কাঠা জমির একটা অংশ তার ভাই সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আরজুল ইসলাম আরজু এলাকার তিন ব্যক্তির কাছ থেকে ক্রয় করেছিলেন। বাকি জমি বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে লিজ নেয়া হয়েছে।’

জেলা পরিষদের জমি কী করে ক্রয়-বিক্রয় এবং লীজ দেয় হয়- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না না এসব জেলা পরিষদের জমি নয়।’ কিন্তু ব্রিকস ফিল্ড থেকে বের হয়ে আসার পথে দক্ষিণ পুমদী গ্রামের এক বৃদ্ধ যুগান্তরকে জানান, ৪-৫ বছর আগে এসব জায়গা খালি করার জন্য জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ দখলদারদের নামে নোটিশ পাঠিয়েছিল। রহস্যজনক কারণে পরে এ উদ্যোগ ভেস্তে যায়।

একই সময় পার্শ্ববর্তী ধনকুড়া গ্রামের এক অধিবাসী জানান, সাংবাদিক এসেছে এমন খবরে অনেক দখলবাজ গা-ঢাকা দিয়েছে। জানাতে চাইলে কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান বলেন, ইতিমধ্যে জেলা পরিষদের প্রায় ২০০ কোটি টাকা মূল্যের ভূমি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বাকি ৫৬ দশমিক ৫৮ একর ভূমি ও ৫০টি পুকুর উদ্ধারেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, তদানীন্তন অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ এসব নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু, সুষ্ঠু তদারকি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় সহায়-সম্পত্তি লুটপাট এবং রেকর্ড গায়েবের ঘটনা ঘটে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/262281/