২৬ ডিসেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৩:৪৪

ডাকসুতে হামলা

যেভাবে গায়েব হয় সিসিটিভি ফুটেজ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হক নুরসহ তার সহযোগীদের ওপর হামলার পর ডাকসু ভবনের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) ফুটেজ নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। এ ফুটেজে স্পষ্ট ছিল কারা এ হামলায় সরাসরি অংশ নিয়েছিল। কিন্তু হামলাকারীরা সিসিটিভির ফুটেজ গায়েব করে ফেলায় অভিযুক্তদের সনাক্ত করতে কঠিন হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তাই সিসিটিভির ফুটেজ উদ্ধারে পুলিশের সহায়তা চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ডিএমপি কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম জানান, তারা ফুটেজ উদ্ধারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে নিরাপত্তার জন্য লাগানো সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব হওয়ায় প্রশাসনের সমালোচনা চলছে সর্বত্র। শিক্ষার্থীরা বলছেন, সিসিটিভিরই যদি নিরাপত্তা না থাকে তাহলে তা কিভাবে সার্বিক পরিস্থিতি মনিটরিং করবে বা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় কাজে লাগবে। গত রোববার দুপুর সাড়ে ১২টায় ডাকসু ভবনে ভিপি নুরুল হক নুর ও তার অনুসারীদের ওপর চার দফায় হামলা করেছে ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীরা।

এতে ভিপি নুরসহ ২৮ শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়। প্রথম দফায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের হামলার পর যোগ দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন নুরের কক্ষে গিয়ে তাকে শাসিয়ে আসেন। এসময় সনজিত নুরের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি কিন্তু বড় গুণ্ডা। কিছুক্ষণ পরেই বুঝবি আমি কে।’ এরপর দুই নেতা ডাকসু ভবন থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় নেতাকর্মীদের হামলার সবুজ সংকেত দেন। প্রত্যক্ষদর্শী একজন বলেন, ডাকসু ভবন থেকে নেমে যাওয়ার সময় সাদ্দাম নিজের অনুসারীদের বলেন, ‘এমনভাবে মারবি যেন মরে না যায়।’ এরপর তিন দফায় নুরদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। এসময় ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ ছিল সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব করার দায়িত্বে। তারা ডাকসুর কর্মকর্তা থেকে জোর করে সিসিটিভির হার্ডডিক্স ছিনিয়ে নেয়। যেন হামলার কোন প্রমাণ না থাকে। প্রত্যক্ষদর্শী এক শিক্ষার্থী জানান, হামলাকারীদের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত ছিল সিসি ক্যামেরাগুলো ভেঙে ফেলা। পরক্ষণে নিজেদের সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে সিসিটিভির হার্ডডিক্স খুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয় তাদের। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হামলাকারীদের একটি গ্রুপ ডাকসু ভবনের কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদের কাছে যান। এরপর তার কাছ থেকে জোরপূর্বক চাবি আদায় করে সিসিটিভির হার্ডডিক্স খুলে নেয়। এসময় আবুল কালাম আজাদ সিসিটিভির ফুটেজ রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন।

তিনি হামলাকারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘এটা নিয়ে গেলে আমার চাকরি থাকবে না।’ তখন হামলাকারীরা বলে, চাকরি না থাকলে আমরা দেখবো। এ বলে তারা আবুল কালামের ওপর চড়াও হলে তিনি নিরূপায় হয়ে চাবি দিয়ে দেন। পরক্ষণে হামলাকারীরা সিসিটিভির হার্ডডিক্স খুলে নিয়ে যায়। হামলাকারীদের একজন গায়ে পরিহিত জ্যাকেটের ভেতরে ঢুকিয়ে হার্ডডিক্স বাইরে নিয়ে যায় বলে জানা গেছে। এদিকে কারা ফুটেজ নিয়ে গেছে এ বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে। তবে প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, আমরা ধারণা করছি, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন জানেন কারা ফুটেজ গায়েব করেছে। একই কথা বলছেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতারাও। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের এক নেতা বলেন, ঘটনার সময় আমাদের থেকে সনজিত এবং সাদ্দামের অনুসারীরা বেশী মারমুখী ছিল। আর সিসি ফুটেজ যারা নিয়েছে তারাও সনজিত-সাদ্দামের অনুসারী। এ দুই নেতা ভালো করেই জানেন কারা সিসি ফুটেজ গায়েব করেছে। তারা চাইলে সেটি বের করা কোন ব্যাপার না। প্রত্যক্ষদর্শী একজন বলেন, যারা ফুটেজ গায়েবে ডাকসু কর্মকর্তাকে জোর করেছে তারা বিভিন্ন হলের ছাত্রলীগের জুনিয়র কর্মী। তবে তাদের কাউকে চিহ্নিত করা যায়নি। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম সনেট মাহমুদ বলেন, হামলায় কারা অংশ নিয়েছে সিসি ফুটেজ দেখলেই বুঝা যাবে।

এসব ভিডিওই আমাদের শক্তি। তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে একটি গোষ্ঠী আমাদের ও কোটাদের মধ্যে কথাকাটাকাটির সুবিধা নিয়েছে। সব ফুটেজ বের করলেই আসল হামলাকারী কারা তা বের হয়ে যাবে। এদিকে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা বলছেন, কারা সিসি ফুটেজ গায়েব করেছে তা সনজিত-সাদ্দামকে আটক করলেই বের হয়ে আসবে। এদের দু’জনের নির্দেশেই হামলা হয়েছে। আবার এরাই সিসি ফুটেজ গায়েব করেছে। তারা বলেন, যারা হামলায় অংশ নিয়েছে তারাও এ দুই নেতার অনুসারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান জানিয়েছেন, তারা সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধারে পুলিশের সহায়তা চেয়েছেন। প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী বলেন, তদন্ত কমিটি সব খুঁজে বের করে অপরাধীদের সনাক্ত করবে। গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুরের ওপর হামলা ও ডাকসু ভবন ভাঙচুরের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, এই হামলার বিষয়ে তদন্ত চলছে। ভিপি নুরের মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মারমুখী অবস্থায় দেখা যাওয়া আর মারামারিতে অংশ নেয়া দুটো এক বিষয় নয়।

এদিকে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের করা মামলার আবেদনে যে ৩৭ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তাদের একজন ডাকসুর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী। তিনি এ মামলার ১৩ নম্বর অভিযুক্ত। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, ভুক্তভোগী অনেকে দেখেছেন সাদ বিন কাদের হামলার সময় ডাকসু ভবনের ছাদে ছিলেন। যদিও সাদ বিন কাদেরের আবাসিক হল শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়- ঘটনা শেষ হওয়ার প্রায় ১৫ মিনিট পর তিনি হল থেকে ক্যাম্পাসের উদ্দেশে বের হয়েছেন। ওইদিন ডাকসু ভিপি ও তার অনুসারীদের ওপর হামলা শুরু হয়েছে দুপুর সাড়ে ১২টায়। যেটি চলে প্রায় দেড়টা পর্যন্ত। এরপর আহতরা ডাকসু ভবনে ভিপি নুরের কক্ষে দরজা বন্ধ করে পড়ে থাকে। বেলা দুইটার দিকে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যায় প্রক্টরিয়াল বডি। অথচ শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, সাদ বিন কাদের হল থেকে বের হন বেলা ১টা ৫০ মিনিটে। এরপর তিনি হেঁটে হেঁটে ডাকসুর উদ্দেশে যান। সাদ বিন কাদের বলেন, আমি হলে ব্যক্তিগত কিছু কাজে ব্যস্ত ছিলাম। গোসল শেষে বেলা দেড়টায় রুমে এসে জানতে পারি ডাকসুতে ভিপি নুরের ওপর হামলা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি চাই হামলাকারীদের বিচার হোক, তবে কেউ যেন ষড়যন্ত্রের শিকার না হয়। ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন বলেন, সাদ বিন কাদেরের নাম কিভাবে এসেছে তা তিনি জানেন না। এটা নুরুল হক নুরের করা। তিনি বলেন, তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন।

https://www.mzamin.com/article.php?mzamin=205469