২১ ডিসেম্বর ২০১৯, শনিবার, ১২:০০

শীতে বিপর্যস্ত জনজীবন কষ্ট আরও এক-দু’দিন

আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ ৯ * গরম কাপড় কেনার ধুম

দেশের কয়েকটি এলাকার উপর দিয়ে বয়ে চলা মৃদু শৈত্যপ্রবাহ শুক্রবারও অব্যাহত ছিল। এদিন অবশ্য সর্বনিম্ন তাপমাত্রায় সামান্য উন্নতি হয়েছে। তবে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পার্থক্য কম থাকা, শীতল বায়ু আর মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশায় শুক্রবারও সারা দেশের মানুষ অনেক কষ্ট পেয়েছেন। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আরও এক-দু’দিন সময় লাগবে।

শুক্রবারও দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায়, ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন সেখানে তা ছিল ৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি। এছাড়া শুক্রবার যশোরে ৯ ডিগ্রি, রাজশাহীতে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি, তেঁতুলিয়ায় ১০ দশমিক ১ ডিগ্রি, ঈশ্বরদী, বদলগাছী ও রংপুরে ১০ দশমিক ৩ ডিগ্রি এবং দিনাজপুরে ১০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। তবে এর বাইরেও অধিকাংশ স্থানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রির মধ্যেই ছিল। এসব স্থানে শুক্রবার প্রায় সারা দিনই সূর্যের মুখ দেখা যায়নি।

শীতের কারণে সাধারণ মানুষের জবুথবু অবস্থা। বিশেষ করে বস্ত্রহীন ও গরিব-দুঃখী মানুষ ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়েছেন। শীত নিবারণ করতে আগুন পোহাতে গিয়ে বুধবার রাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় শীতজনিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত মানুষ ছুটছেন চিকিৎসকের কাছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হাসপাতালে শীতজনিত রোগে ভর্তি বেড়েছে।

দেশের দুটি স্থানে শীতের পোশাক বিতরণের তথ্য দিয়েছেন যুগান্তর প্রতিনিধিরা। তবে তারাই বলেছেন, এটি ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। শীতের কারণে ঢাকাসহ সারা দেশেই গরম কাপড়ের বিক্রি বেড়েছে। শুক্রবার ঢাকার বঙ্গবাজার, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, নিউ মার্কেট, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে গরম পোশাকের অস্থায়ী দোকানের সামনে স্বল্প আয়ের মানুষের ভিড় দেখা গেছে। যমুনা ফিউচার পার্কসহ অভিজাত মার্কেটগুলোতেও শীতের পোশাক বিক্রি বেড়েছে।

বেলা ১১টায় মার্কেট খোলার পরই যমুনা ফিউচার পার্কের বিভিন্ন ফ্লোরে নামি ও বিখ্যাত ব্র্যান্ডের দোকানগুলোতে সপরিবারে ক্রেতাদের শীতের দেশি-বিদেশি পোশাক কেনাকাটা করতে দেখা গেছে। রাতে বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত নানা বয়সের মানুষের ভিড় ছিল দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এ মার্কেটে।

কুয়াশার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ। বিশেষ বার্তা প্রকাশ করে তারা সড়কপথে যানবাহন চলাচলে সাবধানতা অবলম্বন করতে চালকদের অনুরোধ জানিয়েছে। প্রয়োজনে দিনেও হেডলাইট জ্বালানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। নৌপথে জাহাজ চলাচলেও সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগের কর্মকর্তারা শুক্রবার বিকালে জানান, বৃহস্পতিবারের তুলনায় শুক্রবার তাপমাত্রা সার্বিকভাবে কমেছে। তবে শীতের অনুভূতি ছিল গত কয়েকদিনের মতোই। শুক্রবার ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দিন ও রাতের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে।

তাপমাত্রা ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গেলে তাকে মাঝারি মাত্রার শৈত্যপ্রবাহ বলে। তাপমাত্রা যদি ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামে তবে তা তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। আর ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হলে তাকে বলে মৃদু শৈত?্যপ্রবাহ। সেই হিসাবে বর্তমানে দেশের চুয়াডাঙ্গা, যশোর, রাজশাহী ও দিনাজপুর অঞ্চলের উপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. একেএম সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, মৌসুমের শুরুতে এভাবে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার কথা নয়। বাংলার প্রবাদই হচ্ছে, ‘মাঘের শীত বাঘের গায়’। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবেই শুরুতে এ শৈত্যপ্রবাহ। তিনি বলেন, উত্তর মেরু থেকে শীতল বায়ু এবং পৃথিবীর নিম্নাঞ্চলের উষ্ণবায়ু প্রবাহ পরিস্থিতিসহ অন্যান্য কারণে আগামীতে এ ধরনের শৈত্যপ্রবাহ আরও বাড়বে। পাশাপাশি সার্বিক আবহাওয়া পরিস্থিতি বৈরী আচরণ করবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রাজেশ মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, শীতের সঙ্গে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশিসহ নির্দিষ্ট কিছু রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। শীতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় শিশু ও বয়স্করা। তবে শিশুরা প্রস্তুতি বোঝে না বলে তাদের প্রতি বাবা-মাকে বিশেষ যত্ন নিতে হবে। ঠাণ্ডা লাগলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নইলে তা নিউমোনিয়ায় সংক্রমণ ঘটতে পারে।

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যুগান্তরের প্রতিনিধিরা শীত পরিস্থিতির ওপর প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। নেত্রকোনা, চুয়াডাঙ্গা, চৌহালী (সিরাজগঞ্জ), নওগাঁ, পত্নীতলা (নওগাঁ), ডিমলা (নীলফামারী), শেরপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, রানীশংকৈল (ঠাকুরগাঁও), দেওয়ানগঞ্জ (সিরাজগঞ্জ), দিনাজপুর, জয়পুরহাট, আগৈলঝাড়া (বরিশাল), হবিগঞ্জ, দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি এবং বরিশাল ও রংপুর ব্যুরো এসব প্রতিবেদন পাঠায়।

প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, শহরাঞ্চলের বাইরে শীতের প্রকোপ ও অনুভূতি দুটিই বেশি। শীতের কারণে সাধারণ মানুষ বেজায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। উত্তরাঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশার কারণে লোকজন ঘর থেকে বের হচ্ছেন কম। অনেকেই প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছেন না, যাচ্ছেন না কাজে। এতে পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন দরিদ্র মানুষ। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন অনেকে। অসুস্থ হয়ে ছুটছেন হাসপাতালে।

রংপুর ব্যুরো জানিয়েছে, খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়ে ৪৮ ঘণ্টায় ৮ জন রংপুর মেডিকেল কলেজে হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন। ডা. সোহানুর রহমান শুভ জানান, অগ্নিদগ্ধদের মধ্যে রংপুরের ৪ জন, ঠাকুরগাঁওয়ের ২ জন এবং কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুরের একজন করে রয়েছেন। এর সাতজন হলেন- রংপুর সদরের পাশারিপাড়ার রোকেয়া বেগম (৩০), পীরগাছার অন্তঃসত্ত্বা ফরিদা বেগম (৩৫), পীরগঞ্জের হালিমা খাতুন (৩২), কাউনিয়ার মর্জিনা বেগম (৩৭), ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জের আলেমা বেগম (২৫), দিনাজপুরের খানসামার শামসুন্নাহার (৪০) ও কুড়িগ্রামের নুরনাহার (২৭)। বিভাগের প্রধান ডা. এমএ হামিদ জানান, এদের মধ্যে ৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কাউনিয়া উপজেলার মৃত ফজলার রহমানের স্ত্রী মর্জিনা বেগমের প্রায় ৭০ ভাগ পুড়ে গেছে।

ডিমলা (নীলফামারী) প্রতিনিধি জানান, আগুন পোহাতে গিয়ে বুধবার রাতে নীলফামারী সদরের চওড়া বড়গাছা ডাঙ্গাপাড়ায় এক শিশু দগ্ধ হয়। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ইতিমনি নামের ওই শিশুটির বাবার নাম একরামুল হক। ২ দিনে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৭৯ জন জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি জানান, ৩৪ হাজার কম্বল জেলার ৫ উপজেলায় বিতরণ করা হয়েছে। শেরপুর প্রতিনিধি জানান, জেলা প্রশাসক শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে কম্বল বিতরণ করেন। চৌহালী (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, যমুনা নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত চরাঞ্চলের মানুষ শীতে কাঁপছেন। ভিটেবাড়ি হারানো মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/257761/