১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, শনিবার, ১১:৪৩

দাবি আদায়ে অনড় পাটকল শ্রমিকরা

কফিনের সামনে শপথ * চার দিনে তিন শতাধিক অসুস্থ * ঢাকায় কালো পতাকা মিছিল

মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ ১১ দফা দাবিতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকরা অনড় অবস্থান নিয়েছেন। চার দিন ধরে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালনকালে খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তিন শতাধিক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অনশন পালনকালে খুলনায় এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার সকাল ১০টায় খুলনার প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলের সামনে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় কফিনের সামনে সহকর্মীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। কফিনের সামনে তারা আমরণ অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার শপথ নেন।

এদিকে রাজশাহী ও নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একই দাবিতে পাটকল শ্রমিকরা অনশন কর্মসূচি পালন করছেন। এসব জায়গায় গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শ্রমিকের মৃত্যুর প্রতিবাদে ঢাকায় কালো পতাকা মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে। এ সম্পর্কে ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

খুলনা : রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের আমরণ অনশন কর্মসূচির চতুর্থ দিন শুক্রবার রাত ১০টা পর্যন্ত খুলনায় দুই শতাধিক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে তাদের ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া অনশনস্থলে অসুস্থ শ্রমিকদের স্যালাইন দেয়া হয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে খালিশপুর শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।

প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলের তাঁত বিভাগের শ্রমিক আবদুস সাত্তারের জানাজা সকাল ১০টায় মিলের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে খুলনা বিভাগীয় শ্রম কর্মকর্তা মিজানুর রহমান তার পরিবারের কাছে নগদ ৫০ হাজার টাকা হস্তান্তর করেন। তার লাশ পটুয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়েন। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ওই দিন সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে তার মৃত্যু হয়। শ্রমিকরা জানান, এবার আর কোনো প্রতিশ্রুতি নয়, মজুরি কমিশন না নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরে যাব না। রাজপথে শ্রমিকরা জুমার নামাজ আদায় করেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের আন্দোলন সম্পর্কে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান সাংবাদিকদের বলেন, শ্রমিকদের মজুরি কমিশনের বিষয়ে রোববার বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের আহ্বানে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে আলোচনা হবে। আশা করা হচ্ছে, মজুরি কমিশনের বিষয়টি সমাধান হবে। তিনি আরও বলেন, মানবতার মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির বিষয়ে আন্তরিক। বৃহস্পতিবার রাতে খুলনার যুগ্ম-শ্রম অধিদফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মন্নুজান সুফিয়ান এ মন্তব্য করেন।

প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলের সিবিএর সভাপতি শাহানা শারমিন বলেন, পাটকলের মালিক পরিষদের কতিপয় ষড়যন্ত্রকারীর চক্রান্তের শিকার রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকরা। এ কারণে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। তিনি বলেন, শ্রমিকরা কাঁথা-কম্বল নিয়ে অনশনে নেমেছেন। যদি মরতে হয় তবুও মরব কিন্তু দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাব।

এদিকে খুলনায় অনশনরত প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিক আবদুস সাত্তারের মৃত্যুর প্রতিবাদে ঢাকায় কালো পতাকা মিছিল ও সমাবেশ করেছে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন। শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক সমাবেশে বক্তারা বলেন, এ সরকার নিজেকে শ্রমিকবান্ধব দাবি করলেও পাটকল শ্রমিকদের মজুরি বাকি। মজুরি না পাওয়ায় পাটকল শ্রমিকরা মনবেতর জীবনযাপন করছেন। ২০১৫ সালে সরকারি কর্মচারীদের পে-স্কেল বাস্তবায়ন হয়েছে। এমনকি চিনি, খাদ্যশিল্পসহ অন্য সব খাতে মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন করা হলেও পাটকল শ্রমিকদের মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। অবিলম্বে বকেয়া মজুরি পরিশোধ, মজুরি কমিশনের রোয়েদাদ বাস্তবায়নসহ ১১ দফা কার্যকর করার দাবি জানান তারা।

সমাবেশে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আমিরুল হক আমিন বলেন, সাত্তারের মৃত্যুর দায়ভার সরকার এড়াতে পারে না। সমাবেশে সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, কেন্দ্রীয় নেতা মো. আনোয়ার আলী, সাফিয়া পারভিন, গোলাম ফারুক প্রমুখ বক্তব্য দেন। সমাবেশে সংহতি জানান ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা কাজী মাহমুদুল হক সেনা।

রাজশাহী : অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের পিএফ গ্রাচ্যুইটির টাকাসহ ১১ দফা দাবি আদায়ে অনড় অবস্থানে রয়েছেন পাটকল শ্রমিকরা। মঙ্গলবার থেকে তারা নগরীর উপকণ্ঠ কাটাখালি এলাকায় পাটকলের প্রধান ফটকে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করছেন। আন্দোলনের তৃতীয় দিন বৃহস্পতিবার নয়জন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে দুইজন বাড়ি ফিরেছেন। সাতজন এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

পাটকলের সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি জিল্লুর রহমান জানান, রাজশাহী পাটকলে প্রায় এক হাজার কর্মচারী-শ্রমিক রয়েছেন। কর্মচারীদের তিন মাসের ও শ্রমিকদের ১১ সপ্তাহের বেতন বকেয়া রয়েছে। বেতন-ভাতা না পেয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ঢাকায় শ্রমিক নেতারা আলোচনায় বসলেও কোনো সমাধান হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে তারা আন্দোলনে নেমেছেন। এবার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলেও জানান তিনি।

নরসিংদী : শীত ও কুয়াশা উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছেন অনশনরত পাটকর শ্রমিকরা। বেশ কয়েকজন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। শ্রমিক সাত্তারের মৃত্যুতে নরসিংদীতে কালো ব্যাচ ধারণ, গায়েবানা জানাজা ও দোয়াসহ বেশ কয়েকটি কর্মসূচি পালিত হয়।

শ্রমিকদের ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবি আদায়ে শ্রমিকদের খোঁজ খবর নিয়ে পাশে দাঁড়াচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। সকাল ১০টার দিকে বাংলাদেশ ইসলামী শ্রমিক আন্দোলন (চরমোনাই অনুসারী) নরসিংদী জেলা শাখার নেতারা ইউএমসি পাটকল শ্রমিকদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয়ার জন্য সরকারের কাছে তারা অনুরোধ জানান। এর আগে শ্রমিকদের সমবেদনা জানিয়ে সংহতি প্রকাশ করেন- জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মো. শফিকুল ইসলাম, জেলা মানবাধিকার কমিশনের নরসিংদী জেলা কমিটির সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুর এলাহী, প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল পারভেজ।

ইউএমসি জুট মিলের মো. আনোয়ারুল হক সোহাগ বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শ্রমিক বিল্লালের অবস্থা গুরুতর।

নন-সিবিএর সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক শামসুল আরেফিন বলেন, চার দিন ধরে অনশন চলছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে কেউ আসেননি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/news/255322/