৭ ডিসেম্বর ২০১৯, শনিবার, ১১:৫৬

পেঁয়াজের দাম বাড়ছেই

একদিনেই কেজিতে বাড়ল ১০ টাকা: দেশি পেঁয়াজের কেজি ২৬০ টাকা * পেঁয়াজের দাম নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার-কৃষিমন্ত্রী * চট্টগ্রামে থানায় বিক্রি হবে পেঁয়াজ * মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি ৫০ হাজার টন ছাড়াল

হু-হু করে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। একাধিক দেশ থেকে আমদানি করে সরবরাহ বাড়ানোর পরও দফায় দফায় দাম বাড়ছে। এছাড়া বাজারে নতুন পেঁয়াজ এলেও দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই।

রাজধানীর খুচরা বাজারে বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ সর্বোচ্চ ২৫০ টাকায় বিক্রি হলেও শুক্রবার তা বিক্রি হয়েছে ২৬০ টাকায়। এছাড়া আমদানি করা মিয়ানমারের পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। ফলে বাজারে আসা ভোক্তাদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।

এ দিন রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২৫০-২৬০ টাকা। আর পাইকারি বাজারে বিক্রি হয়েছে ২৪০-২৫০ টাকা। এছাড়া খুচরা পর্যায়ে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ১৩০-২২০ টাকা ও পাইকারিতে ১১০-১৯০ টাকা।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক বাজার মূল্য তালিকায় দেখা গেছে- এক মাস ধরে এই পণ্যটি ৪১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।

আর গত বছর এই সময় এক কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২০-৩৫ টাকা।

রাজধানীতে শুক্রবার কৃষকের বাজার উদ্বোধনকালে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, পেঁয়াজের দাম নিয়ে সরকার এখন উদ্বিগ্ন। বিভিন্নভাবে সরকারের পক্ষ থেকে দাম নিয়ন্ত্রণে কাজ করা হচ্ছে। শঙ্কার আরও একটা বিষয় হচ্ছে- বাজারে পেঁয়াজের দাম বেশি থাকায় কৃষক ছোট অপরিপক্ব পেঁয়াজ জমি থেকে উঠিয়ে বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে আসছেন।

যা আরও বড় হওয়া দরকার। কারণ এখন অপরিপক্ব পেঁয়াজ বিক্রি করলে উপযুক্ত সময় দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ একবারেই থাকবে না। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, নয়াবাজার, শান্তিনগর কাঁচাবাজার ও রামপুরা বাজার ঘুরে খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এদিন আমদানি করা পেঁয়াজের মধ্যে মিয়ানমারের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২২০ টাকা কেজি। যা বৃহস্পতিবার বিক্রি হয় ২০০-২১০ টাকায়। মিসরের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৫০-১৬০ টাকা কেজি। আর চীন থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকা কেজি। এছাড়া বাজারে প্রতি কেজি দেশি নতুন পেঁয়াজ (মুড়িকাটা) বিক্রি হয়েছে ১৫০-১৮০ টাকায়।

নয়াবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা মো. খোকন বলেন, প্রতিদিনই পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। এটা কি করে হয়! বিক্রেতারা বলছেন, ঘাটতি আছে। কিন্তু বাজারে বেশি দাম দিলে চাহিদামতোই কিনতে পারছি। ব্যবসায়ীদের কাছে আমাদের জিম্মিদশা থেকে বের করার মতো কেউ নেই।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, পেঁয়াজের দাম বাড়ছেই। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা এই পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। এতে পণ্যটি কিনতে ভোক্তার নাভিশ্বাস উঠেছে। তাই সরকারের উচিত সরবরাহ বাড়িয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে আনা। আর মোকাম থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে মূল্য তদারকি করা। কোনো ধরনের অনিয়ম পেলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা।

রাজধানীর পাইকারি আড়ত শ্যামবাজার ও কারওয়ান বাজারের বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাইকারি প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২৪০-২৫০ টাকায়। যা একদিন আগে বৃহস্পতিবার বিক্রি হয়েছে ২৩৫-২৪০ টাকায়। মিয়ানমার ও পাকিস্তান থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ ১৭০-১৮০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। চীন থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ১১০ টাকা।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার পর আমরা হাহাকার শুরু করেছি। যেহেতু এটা একটা প্রতিযোগিতামূলক বাজার। এখানে অনেক অংশীদার থাকবে। তবে আমরা ভুলে যাই- সরবরাহের ঘাটতি পড়লেই দামও বাড়তে থাকে। তাই এই দাম যাতে না বাড়ে এজন্য সুদূরপ্রসারী বাজার ব্যবস্থাপনার ছক হাতে নিয়ে সংশ্লিষ্টদের এগোতে হবে।

চট্টগ্রামে পেঁয়াজ বিক্রি হবে থানায় : চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, পেঁয়াজের দামের লাগাম টানতে এবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) পেঁয়াজ বিক্রি করবে। থানা প্রাঙ্গণে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৪৫ টাকা দরে বিক্রি করা হবে। আজ শনিবার সকাল ১০টা থেকে পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতির উদ্যোগে কোতোয়ালি, খুলশী, পাহাড়তলী, চান্দগাঁও ও ইপিজেড- এই পাঁচ থানায় পেঁয়াজ বিক্রি করা হবে। পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনে মানুষের কাছে বিক্রি করবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

সিএমপি কমিশনার মো. মাহাবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমাতে ও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া পেঁয়াজের দামের লাগাম টানতে পুলিশের পক্ষ থেকে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পুলিশ পরিবারের সংগঠন পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি এসব পেঁয়াজ সংগ্রহ করে সাধারণ মানুষের কাছে নামমাত্র মূল্যে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্যোগ টানা এক সপ্তাহ চলবে।

এদিকে নগরীতে কমতে শুরু করেছে শীতকালীন সবজির দাম। ফুলকপি ও শিমের দাম কেজিপ্রতি ২০ টাকা কমেছে। এছাড়া বাঁধাকপি ও মুলায় ১০ টাকা কমেছে। নগরীর কয়েকটি কাঁচাবাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি ৫০ হাজার টন ছাড়াল : টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পেঁয়াজের পরিমাণ ৫০ হাজার টন ছাড়িয়েছে। দেশে পেঁয়াজ সংকট শুরুর পর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে ৫০ হাজার ৬২৪.৯১০ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে এসব পেঁয়াজ আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা। টেকনাফ স্থলবন্দর শুল্ক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত নভেম্বরে আমদানি হয়েছে ২১ হাজার ৫৬০.৪৫২ টন, অক্টোবরে আমদানি হয়েছে ২০ হাজার ৮৪৩.০২৭ টন, সেপ্টেম্বরে আমদানি হয়েছিল ৩ হাজার ৫৭৩.১৪১ টন, আগস্ট মাসে ৮৪.১৩২ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। এছাড়া চলতি ডিসেম্বর মাসের প্রথম ৫ দিনে আমদানি হয়েছে ৪ হাজার ৫৬৪.১৫৮ টন পেঁয়াজ। এসব পেঁয়াজের আমদানি মূল্য ২২০ কোটি ৫৯ লাখ ৯৭ হাজার ১০৪ টাকা।

টেকনাফ স্থলবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা মো. আবছার উদ্দিন বলেন, বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) সর্বশেষ ৯৬৫.০৩৭ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। আমদানি করা পেঁয়াজে কোনো শুল্ক দিতে হয় না।

এদিকে মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ ঠিকমতো বাজারে সরবরাহ হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে তদন্ত টিম শুক্রবার টেকনাফ স্থলবন্দরের আমদানি হওয়া পেঁয়াজ ও বাজারে সরবরাহের তথ্য যাচাই করে দেখছেন। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহজাহান আলীর নেতৃত্বে ৩ সদস্যের টিম শুক্রবার বন্দরের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তদন্ত টিমকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সাইফ জানান, তদন্ত টিম কাজগপত্র যাচাই করে দেখছে।

এর আগে বৃহস্পতিবার টেকনাফ থানা পুলিশের পরিদর্শক (অপারেশন) রাকিবুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি টিম বন্দরে আমদানি করা পণ্যের কাগজপত্র যাচাই করে দেখে। এ ব্যাপারে জেলা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন জানিয়েছেন, পেঁয়াজ আমদানিতে সিন্ডিকেটের কারসাজি রয়েছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ অভিযান চালিয়েছিল। একই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/252534