৭ ডিসেম্বর ২০১৯, শনিবার, ১১:৫০

রাজধানীতে বদ্ধ ভবনে স্কুল বাধাগ্রস্ত শিশু বিকাশ

রাজধানীর বেশির ভাগ শিশু বাসার চার দেয়ালে বন্দী জীবনযাপন করছে। খেলার মাঠ তো দূরের কথা অনেক এলাকায় নেই কোনো উন্মুক্ত স্থান, যেখানে তারা একটু মুক্ত পরিবেশে বিচরণ করতে পারে। ফলে অনেক শিশু দীর্ঘ দিন ধরে বাসায় এক প্রকার বন্দী জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবা দুইজনই ব্যস্ত থাকায় তাদের নিয়ে কেউ বাসা থেকে বাইরে বেরই হয় না।

এ অবস্থায় অনেক শিশুর ক্ষেত্রে বাসার চার দেয়ালের বন্দিত্ব থেকে কিছুটা মুক্তি মেলে স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় স্কুলও বাসার মতোই এক ধরনের বন্দিশালা। কারণ হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া রাজধানীর প্রায় সব বেসরকারি প্রাথমিক স্কুল এমনকি অনেক মাধ্যমিক স্কুল-কলেজও পরিচালনা করা হচ্ছে আবাসিক ভবনে। আবাসিক ভবনের বেডরুমে নেয়া হচ্ছে ক্লাস। স্কুলগুলো আবাসিক ভবন হওয়ায় সেখানে নেই কোনো খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান। ফলে বাসা-স্কুল এ দুই বদ্ধ পরিবেশেই বিচরণ করতে হয় অনেক শিশুকে। এভাবেই কাটে এ নগরীর লাখ লাখ শিশুর শৈশব-কৈশোর। খেলাধুলার যেমন কোনো সুযোগ তারা পায় না তেমনি পায় না মুক্ত পরিবেশে সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে মেলামেশা বা দেখা-সাক্ষাতের কোনো পরিবেশ। এর ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের সঠিক মানসিক বিকাশ। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সামাজিকীকরণও। বদ্ধ বাসায় টেলিভিশন ও মোবাইলই তাদের সময় কাটানোর মাধ্যম এবং এগুলোর নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে আতঙ্কিত অভিভাবকেরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বদ্ধ ঘরে বসে মোটা মোটা বই মুখস্থ করানো আর ভালো রেজাল্ট করাই শিক্ষা ও স্কুলের মূল উদ্দেশ্য নয়। শিশুর সামাজিক, মানসিক বিকাশ এবং সুস্থভাবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে স্কুলের গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু শহরের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সে পরিবেশ না থাকায় মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছে শিশুরা। ভবিষ্যতে দেশ ও জাতির জন্য এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেকে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন শিশুদের সুস্থ বিকাশের যেসব শর্ত রয়েছে তা পূরণ করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণের।

রাজধানীতে অনেক এলাকা রয়েছে যেখানে স্কুল, বাসার আশপাশে কোথাও যেমন কোনো খোলা স্থান নেই, তেমনি নেই রাস্তায় হাঁটাচলার ন্যূনতম কোনো পরিবেশ। পরিবার-পরিজন নিয়ে একমাত্র ঢাকার বাইরে বের হওয়া অথবা দূরের কোনো এলাকায় যাওয়া ছাড়া তারা মুক্ত কোনো পরিবেশের দেখা পায় না দিনের পর দিন। কিন্তু আর্থিকসহ নানা সমস্যার কারণে অনেকের সে সুযোগও সীমিত। চাইলেও অনেকে পরিবার নিয়ে যেতে পারে না দূরে কোথাও বেড়াতে। রাজধানী শহরে থাকলেও অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

রামপুরা টেলিভিশন ভবনের পেছনে বসবাসকারী অভিভাবক মোতালেব বলেন, তার দুই ছেলেমেয়ে বেসরকারি একটি স্কুলে প্রাথমিক শাখায় পড়ে। তাদের বাইরের জগৎ বলতে বাসা থেকে স্কুলে যাওয়া আসার পথে যতটুকু সময় রাস্তায় থাকে ততটুকু। যে স্কুলে তারা পড়ে সেটিও ভাড়া করা আবাসিক ভবন। স্কুলের নিচের গ্যারেজ ছাড়া সেখানে আর কোনো খোলা জায়গা নেই। স্কুল ভবন থেকে বাইরে পা রাখলেই রাস্তা। আর রাস্তায় সব সময় ছুটে চলছে দ্রুতবেগে গাড়ি। মোতালেব বলেন, বাসায় যেমন তারা বন্দী, তেমন স্কুলেও বন্দী। স্কুলের ক্লাসরুমগুলোই বাসার বেডরুমের মতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী মোতালেব মনে করেন, সত্যিকার অর্থে স্কুল বলতে যা বোঝায়, এগুলো তা নয়। বদ্ধ একটি ঘরে কিছু পাঠদান করলেই স্কুল হয় না। স্কুল শুধু পাঠ্যবইয়ের কিছু বিষয় শেখার মাধ্যম নয়। ছেলেমেয়েদের সামাজিকীকরণ, মানসিক বিকাশসহ অনেক কিছুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক ভূমিকা আছে। কিন্তু তার কোনো কিছুই পায় না রাজধানী ঢাকার অনেক শিশু। কিন্তু এসব স্কুলে পড়ানো ছাড়া তাদের জন্য আর কোনো বিকল্পও নেই।

দুই শিশুকে নিয়ে চিন্তিত মোতালেব বলেন, আমার এক ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে আরেক ছেলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। আমি লক্ষ্য করেছি তাদের মধ্যে অনেক সমস্যা আছে। তাদের অনেক আচার-আচরণ আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। রাজধানী শহরে বড় হলেও তারা অনেক ক্ষেত্রে গ্রামের অনেক ছেলেমেয়েদের থেকেও পেছনে আছে। আমি বুঝতে পারি, এটার একমাত্র কারণ হলো তারা কখনও তাদের বয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে খেলাধুলা, মেলামেশার সুযোগ পায়নি। ফলে তাদের অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বিকাশ হয়নি।

মোতালেব বলেন, যেহেতু তারা বাসা আর স্কুল কোথাও খোলা জায়গা পায় না তাই আমি অনেক সময় স্কুল ছুটি হলে একটু দেরিতে আনতে যাই। এ সুযোগে তারা স্কুলের নিচে গ্যারেজের মধ্যে ছেলেদের সাথে কিছুটা ছোটাছুটির সুযোগ পায়। অনেক সময় চেষ্টা করি তাদের নিয়ে মুক্ত পরিবেশে যেতে। তিনি আফসোস করে বলেন, রাজধানীর শিশুদের দুরবস্থা দেখলে মনটা সত্যি খারাপ হয়ে যায়। তারা অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত।

রাজধানীর সিপাহীবাগের বাসিন্দা আনিসুর রহমান বলেন, ঢাকা তো বসবাসের যোগ্য নয়। শিশুদের জন্য তো আরও ভয়াবহ এখানকার পরিবেশ। আনিসুর রহমান বলেন, তার এক ছেলে বেসরকারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। আরেক ছেলের বয়স পাঁচ বছর। তাকে এখনো স্কুলে ভর্তি করানো হয়নি। দুই ছেলেকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে বের হওয়া আনিস বলেন, বাসা বা স্কুলের আশপাশে কোথাও কোনো খোলা জায়গা নেই। রাস্তায়ও হাঁটার পরিবেশ নেই। এই এলাকার রাস্তায় যেমন নেই কোনো ফুটপাথ, তেমনি সারা রাস্তা ধুলাবালিতে ভরা আর অনেক রাস্তা নোংরা। এ অবস্থায় আমরা শিশুদের নিয়ে কোথায় যাব? বাসা ও স্কুল- এই তাদের জীবন। বাসায় টেলিভিশনই তাদের একমাত্র বিনোদন। কিন্তু সেটাই বা কতক্ষণ দেখা যায়। তাই বাধ্য হয়েই রাস্তায় বের হই তাদের নিয়ে মাঝেমধ্যে। কিন্তু রাস্তায় বের হলে আবার ধুলায় গোসল করতে হয়।

রাজধানীর অনেক এলাকার পরিস্থিতি এরকমই। আবাসিক ভবনে পরিচালিত কিছু কিছু স্কুলে শিশুদের জন্য গ্যারেজে খেলনা, বিভিন্ন ধরনের রাইড সাজিয়ে রাখতে দেখা যায়। কোনো কোনো স্কুলের সামনে ছোট আকারে খোলা জায়গা রাখা হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় রয়েছে সীমিত কিছু খেলার মাঠ। কিন্তু ভাড়াটিয়া অনেক পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের নানা কারণে সেসব মাঠে তাদের সন্তানদের পাঠাতে সাহস করেন না। অনেকের জন্য তাই বাসার আশপাশে রাস্তায় ছেলেমেয়ে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। অনেক এলাকায় নেই সে পরিবেশও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের প্রফেসর ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, সুষম খাবার না পেলে দেহ যেমন ঠিকমতো বেড়ে ওঠে না, পুষ্টিহীনতায় ভোগে তেমনি শিশুরা লেখাপড়ার পাশাপাশি যদি সামাজিক ও মানসিক বিকাশের সঠিক পরিবেশ না পায়, তাহলে তারা সঠিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে না। তারা সঠিক আচরণ করতে পারবে না, সঠিক দায়িত্ববান হতে পারবে না এবং সত্যিকার অর্থে মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না। তারা অসংলগ্ন আচরণ করবে। মানসিক, শারীরিকসহ সব দিক দিয়ে তারা দুর্বল প্রকৃতির হবে। অনেক কিছুতে বড় বড় ঘাটতি নিয়ে তারা বেড়ে উঠবে।

তিনি বলেন, শিশু বিকাশের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় শিক্ষার যে প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তা ব্যাহত হচ্ছে। শুধু পড়া মুখস্থ করা আর ভালো রেজাল্ট করা দিয়ে সব কিছু হিসাব করলে ভুল হবে। শিশু বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় তাদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। শিশু বিকাশের যে শর্ত রয়েছে তা পূরণ করার জন্য অবিলম্বে উদ্যোগ নেয়া উচিত সরকারের।

প্রফেসর মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, সারা দেশটাকে ঢাকার মধ্যে ঢুকিয়ে না দিয়ে ঢাকা থেকে আমাদের বের হয়ে পড়া উচিত। শুধু মাত্র ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন না করে ৬৪টি জেলায় উন্নয়ন ছড়িয়ে দিতে পারলে ঢাকা বাঁচবে। ঢাকা তো এখনেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। এর ওপর আর কোনো চাপ সৃষ্টি না করে এখান থেকে বের হওয়ার পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/462203/