৩০ নভেম্বর ২০১৯, শনিবার, ১০:৪৪

ই-টেন্ডারিংয়েও জালিয়াতি: দীর্ঘ হচ্ছে ঠিকাদারদের কালো তালিকা

কালো তালিকায় ৩০৩ ঠিকাদার ও প্রতিষ্ঠান * তালিকার কোনো ঠিকাদার যাতে কাজ না পান সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি করা হবে-পরিকল্পনামন্ত্রী * তালিকা ধরে দুদক তদন্ত করতে পারে -ইফতেখারুজ্জামান

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ই-টেন্ডারিং (ই-জিপিতে) পদ্ধতি চালু করা হলেও সেখানেও ঢুকে পড়েছে জালিয়াতি ও দুর্নীতি। সরকারি কেনাকাটায় ক্রমেই ঠিকাদারদের জালিয়াতি ও অনিয়ম, চুক্তিভঙ্গ এবং দুর্নীতি বেড়ে চলছে। অপচয় হচ্ছে সরকারি অর্থের।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা ঠিকাদারদের এ অনিয়মে লাগাম পরাতে দীর্ঘ হচ্ছে তাদের কালো তালিকা। এখন পর্যন্ত এরকম ৩০৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে কলোতালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

শাস্তি হিসেবে সরকারি প্রতিষ্ঠানে এদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে কাজ দেয়া হচ্ছে না। কালো তালিকাটি সংরক্ষণ ও তদারকি করছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ)।

বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) আওতায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে সিপিটিইউ। তবে দুর্নীতি ও অনিয়মের শাস্তি শুধু ঠিকাদারদের কালো তালিকায় রেখে কাজ থেকে দূরে রাখাটাই যথেষ্ট শাস্তি নয় বলে মনে করছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ যুক্ত করা, ভুয়া প্রশংসাপত্র দেয়া, ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়া, চুক্তির মৌলিক শর্ত ভঙ্গ, চুক্তি অনুযায়ী কাজ শেষ না করা, সরকারি ক্রয় আইন ও বিধি ভঙ্গ করার কারণেই এ তালিকা করা হয়েছে। অপরাধের ধরন অনুযায়ী ঠিকাদারদের শাস্তি দেয়া হবে।

যে মেয়াদের জন্য তারা তালিকাভুক্ত হবেন সেই মেয়াদে সরকারি দফতরের দরপত্রেই অংশ নিতে পারবেন না। আবার যে সংস্থা যে ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে ওই ঠিকাদার শুধু ওই সংস্থার দরপত্রে অংশ নিতে পারবেন না। অপরাধের মাত্রাই ঠিক করে দেবে কোন ঠিকাদার কতদিন কাজ থেকে বিরত থাকবেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, জালিয়াত আছে, এটা আমরা স্বীকার করি। কিন্তু সরকার এ রকম জালিয়াতদের পক্ষে নয়। ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন, সে অনুযায়ী সরকারি ক্রয় আইন ও বিধি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়ছে। যাতে জালিয়াতি বন্ধ করা যায়। ই-জিপিতেও জালিয়াতি হচ্ছে। জালিয়াতির বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কালো তালিকার কোনো ঠিকাদার যাতে কাজ না পায় সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি করা হবে। বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখব। ইতিমধ্যেই নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।

তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চট্টগ্রামের রাউজানের এম/এস জিলানী ট্রেডার্স যে কাজের অভিজ্ঞতার সনদ জমা দিয়েছে তা নকল প্রমাণিত হয়েছে। পরে ওই প্রতিষ্ঠানকে ২৫ অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৩ বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া অভিজ্ঞতার ভুয়া সনদ জমা দেয়ায় কুমিল্লার ইরাদা ইন্টারন্যাশনালকে ২৮ এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত কালো তালিকাভুক্ত করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর।

চুক্তির মৌলিক শর্ত ভঙ্গ করায় রাজশাহীর এম/এস হৃদয় ইলেকট্রনিক্সকে ২৩ জুন থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তালিকাভুক্ত করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর।

ই-টেন্ডারিংয়ে দরপত্রের সঙ্গে ভুয়া কাজের প্রশংসাপত্র জমা দেয়ায় ময়মনসিংহের এম/এস ফ্লোরা এন্টারপ্রাইজকে ৩ জুন থেকে ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এলজিইডি থেকে ঠিকাদার সংস্থাটিকে বলা হয় এটা প্রতারণামূলক অনুশীলন হওয়ায় ৭ কার্য দিবসের মধ্যেই ব্যাখ্যা দিতে হবে।

এছাড়া ঢাকার পিটিএসএল-মৈত্রী (প্রা.) লিমিটেডকে পারফরম্যান্স সুরক্ষা হিসেবে ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টি দাখিল করায় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের ২৮ আগস্ট পর্যন্ত কালো তালিকাভুক্ত করে এলজিইডি।

জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেছেন, কালো তালিকায় থাকা কোম্পানিগুলো যাতে কোনো ভাবেই অন্য নামে বা অন্য কোনো ভাবে শাস্তিকালীন সময় আবারও কাজ না পায় সেজন্য কঠোর নজরদারি করতে হবে। এ বিষয়ে সিপিটিইউকে আরও তৎপর হতে হবে। তাছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বপ্রণোদিত হয়ে এবং সরকারের অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ তালিকা ধরে দুর্নীতির মাত্রা অনুযায়ী তদন্ত করতে পারে। কেননা সরকারি প্রকিউরমেন্টের (কেনাকাটা) যেসব অভিযোগ উঠে থাকে সেগুলো মূল ভূমিকায় দেখা যায় এরকম ঠিকাদাররাই থাকেন। তাই তাদের অনিয়ম, দুর্নীতি ধরা পড়লে শুধু কালো তালিকায় রাখাই যথেষ্ট নয়। অন্য শাস্তিও নিশ্চিত করা উচিত।

কালো তালিকায় থাকা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে- গাইবান্ধার মান্নান এন্টারপ্রাইজ, ঢাকার ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি, কক্সবাজারের এম/এস নজরুল কনস্ট্রাকশন, এম/এস এফ কে কনস্ট্রাকশন, নাটোরের এম/এস রহমান কনস্ট্রাকশন, ঝিনাইদহের মধুবন কনস্ট্রাকশন, কুমিল্লার এম/এস আহমেদ মজুমদার এবং পাবনার এম/এস অরণ্য ট্রেডার্স ইত্যাদি।

আইএমইডির সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ বলেন, এখন ই-টেন্ডারিংয়ে জালিয়াতি, অনিয়ম এবং দুর্নীতির চেষ্টা হচ্ছে। যেমন কোনো কোনো এলাকার কাজে সিঙ্গেল দরপত্র পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে হচ্ছে ওই এলাকার প্রভাবশালী কোনো ঠিকাদার অন্য ঠিকাদারদের দরপত্রে অংশ নিতে হুমকি দিয়ে থাকতে পারে। ইদানীং মাঝে মাঝেই সিঙ্গেল দরপত্র পাওয়া যায়। এটি কিভাবে রোধ করা যায় সে বিষয়ে আমরা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বসেছি। প্রক্রিয়া বের করার কার্যক্রম চলছে।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কালো তালিকার সংখ্যা বাড়ছে। আমরা এ তালিকা মনিটরিং করছি। শাস্তির মেয়াদে যাতে কোনো প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদার অন্য কোনো ভাবে যাতে অন্য কোনো দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে না পারে। সেজন্য দরপত্র যাচাই-বাছাইয়ের সময় কালো তালিকাও পরীক্ষা করে দেখা হয় বলে জানান তিনি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/249768/