২৭ নভেম্বর ২০১৯, বুধবার, ৬:৩৩

উল্লাপাড়ায় ৪ বগিতে আগুন: তদন্ত প্রতিবেদনে রেলের বিশৃঙ্খলার ‘ভয়ংকর রূপ’

দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না -রেলপথ সচিব

প্রতিটি রেল দুর্ঘটনার পরই গঠিত হয় একাধিক তদন্ত কমিটি। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে দায়ীদের চিহ্নিতও করে। কিন্তু একপর্যায়ে দায়ী পদস্থ কর্মকর্তারা পার পেয়ে যান। তবে বেশিরভাগ সময় সতর্ক আর তিরস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও কখনও কখনও নামকাওয়াস্তে নিুস্তরের দু-একজনকে শাস্তি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করা হয়।

তবে সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ট্রেনের ৪টি বগিতে আগুন ধরে যাওয়ার পর গঠিত বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও পাল্টা প্রতিবেদনে রেলের বিশৃঙ্খলার ‘ভয়ংকর রূপ’ ফুটে উঠেছে। দুটি প্রতিবেদনই যুগান্তরের হাতে এসেছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে কমিটির রিপোর্টে রেলপথ যে ‘মৃত্যুফাঁদ’ সেটাই ফুটে উঠেছে। বলা হয়েছে, রেললাইনের প্যাকিং (পাথর, বল্টুসহ অন্যান্য সামগ্রী) যথাযথ ছিল না।

তদন্তের সময় ট্রেনের ইঞ্জিন চালিয়ে এটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। ফেঁসে যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে ওই তদন্ত কমিটির সদস্য প্রধান প্রকৌশলী আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান কমিটি থেকে বেরিয়ে পাল্টা একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে তিনি দুর্ঘটনার জন্য সিগন্যালিং ব্যবস্থার ত্রুটিকে দায়ী করেছেন। বলেছেন, সিগন্যালিং সিস্টেম ২০০৩ সালের, অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সঠিকভাবে সেটি সেট না হয়ে লক হয়েছে, কিন্তু অল গ্রিন সিগন্যাল প্রদর্শন করেছে। যার কারণেই দুর্ঘটনায় ৪টি বগিতে আগুন ধরে যায় এবং ৭টি লাইনচ্যুত হয়।

জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাপরিচালক শামসুজ্জামান জানান, উল্লাপাড়া ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রতিবেদন রেলপথ সচিবের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে আরেক প্রতিবেদনও এসেছে। তবে দ্বৈত প্রতিবেদন আমলে নেয়ার সুযোগ নেই। ভিন্নমত পোষণ করে দেয়া প্রতিবেদনে যথাযথ যুক্তি তুলে ধরা হয়নি বলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি দিচ্ছি, তবে লোকবলের অভাব থাকায় যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

রেলপথ সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন জানান, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। একই সঙ্গে প্রতিবেদনে উঠে আসা সুপারিশগুলোও যথাযথ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে থাকা কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ইতিমধ্যে নেয়া হয়েছে।

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় রংপুর এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার পর পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে বিভাগীয় প্রধান কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন মঙ্গলবার জমা দেয়া হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট মো. শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে কমিটির সদস্যরা রেলপথ সচিবের কাছে এটি জমা দেন।

কমিটির অপর সদস্যরা হচ্ছেন : ওই অঞ্চলের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী মৃণাল কান্তি বণিক, প্রধান প্রকৌশলী আল ফাত্তাহ মাসউদুর রহমান ও প্রধান টেলিকমিউনিকেশন প্রকৌশলী সুশীল কুমার হালদার। তবে তদন্তের গতি-প্রকৃতি বুঝতে পেরে মাঝখান থেকে আল ফাত্তাহ মাসউদুর রহমান কমিটি থেকে বের হয়ে নিজেই আরেকটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। সেটিও তিনি এদিন জমা দিয়েছেন।

তবে শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে জমা দেয়া প্রতিবেদনে রেলপথে নানা ত্রুটির বিষয়টি উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার সময় রংপুর এক্সপ্রেস নির্ধারিত গতির মধ্যে ঘণ্টায় ৬৮ কিমি. বেগেই চলছিল। যথাযথ সিগন্যালের মাধ্যমে ট্রেন উল্লাপাড়া স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল।

তবে দুর্ঘটনাস্থলের এক জায়গায় গভীর সিংকেজ টু ট্র্যাক ও রেললাইনের অ্যালাইনমেন্টে ত্রুটি ধরা পড়ে। লাইন সারফেস ২০ এমএম অসম (আন ইভেন) পাওয়া যায়। যা গ্রহণযোগ্য সীমার অনেক বেশি। দুর্ঘটনার স্থানে রেললাইনের প্যাকিং যথাযথ ছিল না। দুর্ঘটনার পর রেলের ইঞ্জিন চালিয়ে প্যাকিং ত্রুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

ইঞ্জিন লাগোয়া ৫-১০নং কোচ ১নং রেললাইনের বাম দিকে (স্টেশনের দিকে) ৩-৬নং কোচ ২ নম্বর লাইনের পাশে লাইনচ্যুত হয়। এ সময় ফুয়েল ট্যাংকারে আঘাতের ফলে সেটি ছিদ্র হয়ে আগুন ধরে যায়। প্রতিবেদনে সিরাজগঞ্জ বাজার রেলওয়ের এসএসএই (ওয়ে) পলাশ হোসেন, ভারপ্রাপ্ত মেট আরিফুল ইসলাম ও মেট আবদুস সোবাহানকে জিআর ২০৩(গ) ধারা মোতাবেক সরাসরি দায়ী করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে, লাইনটির সিংকেজ, অসমতা ও প্যাকিং ত্রুটি না থাকত তাহলে ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পতিত হতো না। সুপারিশে বলা হয়েছে, দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করাসহ রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত কর্মচারীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষক দেয়া, সহকারী ও বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়মিত রেললাইন পরিদর্শন নিশ্চিত করা, নিয়মিত যৌথ নৈশসংকেত পরিদর্শন, ক্যাব রাইডিং, ট্রলিতে পরিদর্শনের মাধ্যমে রেললাইনের ত্রুটি চিহ্নিত করে সঙ্গে সঙ্গে মেরামত করতে হবে।

এদিকে ওই প্রতিবেদনের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে কমিটিরই সদস্য পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রধান প্রকৌশলী আল ফাত্তাহ ‘নারাজি প্রতিবেদন’ জমা দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, বিভাগীয় কমিটির সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উদ্ঘাটিত দুর্ঘটনার কারণ সঠিক নয়। তিনি বলেছেন, দুর্ঘটনাটি মূলত ২২নং স্টক রেল ও ট্যাংরেলের মধ্যে আগে থেকে বিদ্যমান ‘গ্যাপ’ দিয়ে লোকোমোটিভের হুইলের মুভমেন্টে টু-রুট হয়ে সংঘটিত হয়েছে। দুর্ঘটনাটি লাইনের ত্রুটির জন্য নয়, লাইনে পর্যাপ্ত পাথর এবং দুর্ঘটনাস্থলে প্যাকিং যথাযথ ছিল। আসলে ত্রুটিপূর্ণ সিগন্যালিং সিস্টেমের কারণেই দুর্ঘটনা হয়েছে।

ত্রুটিপূর্ণ সিগন্যালিং সিস্টেমের মাধ্যমে রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি টু রুট হয়ে লুপ লাইনে গমন করে। এখানকার সিগন্যালিং সিস্টেম ২০০৩ সালের, যা অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের কারণে সঠিকভাবে সেট না হয়ে লক হয়েছে, কিন্তু অল গ্রিন সিগন্যাল প্রদর্শন করেছে।

এতে বলা হয়েছে, সরকারি রেলওয়ে পরিদর্শক (জিআইবিআর) গত ২৫ জানুয়ারি ইশ্বরদী-বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম সেকশন পরিদর্শনকালে চাটমোহর স্টেশনে ২৪নং পয়েন্টে থ্রু অব সুইচ ৪.৫ ইঞ্চি পর্যবেক্ষণ করেন। ফিলার (বিশেষ যন্ত্র) গেজ দ্বারা পরীক্ষায় ১/৮ ইঞ্চির স্থলে ১/২ ইঞ্চি গ্যাপ থাকা সত্ত্বেও পয়েন্টটি লকড হয়, যা খুবই বিপজ্জনক বলে জিআইবিআর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন।

প্রধান প্রকৌশলী আল ফাত্তাহর এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা খণ্ডন করে আরেকটি প্রতিবেদন দিয়েছেন তদন্ত কমিটির প্রধান মো. শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, আল ফাত্তাহর যুক্তির পক্ষে যথার্থ প্রমাণ নেই। দায়ী ব্যক্তি পলাশ হোসেন, আরিফুল ইসলাম ও আবদুস সোবাহানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে তাদের জ্ঞানের অভাব আছে। রেললাইনের ভার্টিক্যাল অসমতার গ্রহণযোগ্য সীমা কত, তা তারা বলতে পারেনি।

রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটছে। এক কথায় রেললাইনে ত্রুটির কারণেই এ দুর্ঘটনা। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি দুর্ঘটনার পর এমন ভাঁওতাবাজির প্রতিবেদন আসে। এতে দুর্ঘটনার প্রধান কারণটিই অন্ধকারে চলে যায়। এসব কমিটির রিপোর্টে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। কেননা তাদের দিয়েই কমিটি গঠন করা হয়।

এ ছাড়া কমিটির প্রতিবেদন, দ্বিমত ও নারাজির প্রতিবেদনগুলো খুবই ভয়ানক। এসবের মধ্য দিয়ে রেলপথের ভয়ানক চিত্রই উঠে আসে। এসব প্রতিবেদন কখনোই আলোর মুখ দেখে না।

নামমাত্র শাস্তি : গত ১১ বছরে প্রায় ৮ হাজার তদন্ত কমিটি হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী শাস্তির কোনো আপডেট তথ্য-উপাত্ত নেই রেলে। তবে ২০১৩ এবং ২০১৪ সালের ১৬টি দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এসব ট্রেন দুর্ঘটনায় মাঠপর্যায়ের কর্মচারীদের সামান্যই শাস্তি হয়। এর মধ্যে ৮ জনকে তিরস্কার, ৩ জনকে সতর্ক, ১৮ জনের বিরুদ্ধে ৪৫০ থেকে ২ বছরের বেতন কর্তন করা হয়েছে। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়েছে কি না, তার কোনো তথ্য নেই রেলে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/248623/