১৪ নভেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:০২

ব্রাহ্মণবাড়িয়া ট্র্যাজেডি

তূর্ণার চালক তাসের কোথায়?

তূর্ণা-নিশীথার চালকের গাফিলতিতেই দুর্ঘটনা। এটি রেলপথমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই বলছেন। কিন্তু ঘটনার পর থেকেই খোঁজ নেই চালক তাসের উদ্দিন আর তার সহকারী চালক অপু বিশ্বাসের। তারা কোথায়? তাদের খোঁজ মিলছে না কারো কাছে। কেউ বলছেন, ঘটনার পরই ট্রেন থেকে নেমে পালিয়েছেন তারা। আবার কারো মতে আহত হওয়ার পর তারা কসবা বা আখাউড়া হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে সটকে পড়েছেন। মন্দবাগ রেলস্টেশনের মাস্টার জাকের হোসেন চৌধুরী জানান, তারা কোথায় আছে এ খবর পাইনি। তাদের নাম-ঠিকানা জানি না।

কোথায় আছে, কেমন আছে-কিছুই জানি না। ঘটনার পর তারা গাড়িতে ছিল না, নেমে ভেগে গেছে।

তারা আহত হয়েছে কিনা, মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে কিনা সেই খোঁজখবরও পাইনি। আখাউড়া জিআরপি থানার ওসি শ্যামল কান্তি দাশ বলেন, তূর্ণার চালক তাসের উদ্দিন আহত হয়েছেন। এখন শুনছি আখাউড়া এসে সে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে সহকারী চালক অপু বিশ্বাস মারাত্মক আহত হয়েছেন। কারণ অপু যেদিকে বসা ছিল ইঞ্জিনের ওই পাশটাই উদয়নের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে। ঘটনার পর থেকেই মন্দবাগ স্টেশন মাস্টার বলছেন- আউটার ও হোম সিগন্যাল অমান্য করে তূর্ণা এগিয়ে আসে। ইঞ্জিনটি উদয়নের ২টি বগির ভেতর ঢুকে পড়ে। এতে বগি দুটো সম্পূর্ণ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন দুর্ঘটনার জন্য তূর্ণা-নিশীথার সিগন্যাল অমান্য করাকেই দায়ী করেন। মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার জাকির হোসেন চৌধুরীও দুর্ঘটনার জন্য তূর্ণা- নিশীথার আউটার ও হোম সিগন্যাল অমান্য করার কথা জানান। এদিকে, মন্দবাগে ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনায় আখাউড়া জিআরপি থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে এই মামলাটি করেন মন্দবাগ রেলস্টেশন মাস্টার মো. জাকের হোসেন চৌধুরী। এতে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা তূর্ণা-নিশীথা হোম ও আউটার সিগন্যাল অমান্য করে চলায় দুর্ঘটনা ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়। মামলাটিতে আরো বলা হয়, এতে মেইন লাইন ব্লক হয়ে যায় এবং লোকজনের ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং কিছু সংখ্যক মারা যায়। আখাউড়া জিআরপি থানার ওসি শ্যামল কান্তি দাশ জানান, তারা এর তদন্ত শুরু করেছেন।

কাজ শুরু করেছে তদন্ত কমিটি: দুর্ঘটনায় গঠিত বিভিন্ন তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। গতকাল বিকালে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। ৪ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটির প্রধান রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন ও ভূমি) মো. রফিকুল ইসলাম। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন, রেলওয়ের প্রধান সংকেত এবং টেলিযোগাযোগ কর্মকর্তা মু. আবুল কালাম, যুগ্ম মহাপরিচালক (অপারেশন) মোসাম্মৎ রশিদা সুলতানা গণি ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আলমগীর হোসেন। তারা ঘটনার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন এবং স্টেশন মাস্টার মো. জাকের হোসেন চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং তার কক্ষে বিভিন্ন রেজিস্ট্রার দেখেন। কয়েকটি রেজিস্ট্রার সঙ্গে করে নিয়ে যান। এই কমিটি আগামী ৫ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের রিপোর্ট জমা দেবে। ওদিকে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি তাদের তদন্ত কাজ শুরু করেছে। ঘটনার পরপরই দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এই কমিটি তাদের কাজ শুরু করে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। প্রাথমিকভাবে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন তারা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিতু মরিয়মকে প্রধান করে এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির অন্য দুই সদস্য হচ্ছেন, কসবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা পুলিশের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। তবে এই তদন্ত কমিটির কোনো মেয়াদ নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। মঙ্গলবার ভোররাতে সংঘটিত দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং রেলপথ মন্ত্রণালয় আরো ৪টি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

আহতদের জন্য ১০ হাজার টাকা: মন্দবাগে ট্রেন দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা সহায়তা হিসেবে ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে রেলওয়ের পক্ষ থেকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি একজন আহতের কাছে বুধবার দুপুরে এই টাকা তুলে দেন রেলওয়ের ঢাকা বিভাগের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শওকত হোসেন মহসীন। এসময় তিনি জানান, আহত সবাই ১০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ পাবেন। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন, সহকারী বাণিজ্য কর্মকর্তা হামিদুল ইসলাম সাজ্জাদ। মঙ্গলবারের ওই ট্রেন দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত হন। শতাধিক যাত্রী আহত হন। আহতদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালে ৪৪ জন, কুমিলা হাসপাতালে ১৩ জন এবং কসবা ও আখাউড়া হাসপাতালে ২ জন করে ভর্তি হন। এর বাইরে অন্যান্য হাসপাতালে চিকিৎসা নেন আহতরা। ঘটনার পরপর স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে প্রথমে পিকআপ ভ্যানে করে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠান।

মৃত্যু আধিক্যে সিলেট ও চাঁদপুর: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ১৬ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের মৃতদেহ মঙ্গলবার রাত ৯টা পর্যন্ত স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। নিহতদের বেশির ভাগই সিলেট এলাকার। তারপরই নিহতের হিসাবে চাঁদপুর জেলার আধিক্য। নিহতরা হলেন- হবিগঞ্জ জেলার ভোল্লা সদরের ইয়াছিন আরাফাত (১২), সৈয়দাবাদ সদরের রিপন (৪৫), চুনারুঘাট তীরেরগাঁওয়ের সুজন আহম্মেদ (২৪), হবিগঞ্জ শহরের আনোয়ারপুরের আলী মোহাম্মদ ইউসুফ (৩২), চুনারুঘাটের আহম্মেদাবাদের পিয়ারা, বানিয়াচং বড়বাজারের আদিবা (২), মদনমুরকের মো. আল আমিন (৩০) এবং সিলেটের শ্রীমঙ্গলের গাজীপুরের জাহেদা খাতুন (৩০), চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জের পশ্চিম রাজাগাঁও গ্রামের মজিবুর রহমান (৫৫), তার স্ত্রী কুলসুম বেগম (৩০), হাইমচর দক্ষিণ তিরাশির কাকলি আক্তার (৩২), মরিয়ম (০৪), চাঁদপুর সদরের উত্তর বালিয়ার ফারজানা (১৫), ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের ছোঁয়া মণি (০৩), নোয়াখালী মাইজদীর রবি হরিজন (২৩) ও শরিয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ থানার দক্ষিণ তিরাশির আমাতুন বেগম (৪১)।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=199099