১৪ নভেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১০:৫২

বাজারে নকল-মানহীন ইনসুলিন ঝুঁকিতে ডায়াবেটিস রোগীরা

রাজধানীর পল্লবীর বাসিন্দা জেসমিন আক্তার। ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ায় তিনি দীর্ঘদিন ধরে ইনসুলিন ব্যবহার করছেন। এর আগে একটি বিদেশি কোম্পানির ইনসুলিন ব্যবহার করতেন।

কিন্তু সেই কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ায় বর্তমানে দেশি একটি কোম্পানির ইনসুলিন ব্যবহার করছেন। কিন্তু সেই ইনসুলিনে তিনি কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না। বেশির ভাগ সময় ব্লাড সুগার থেকে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

এ ঘটনা শুধু জেসমিনের ক্ষেত্রে নয়, দেশের অসংখ্য ডায়াবেটিস রোগী এখন এই সমস্যায় ভুগছেন। ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসার অন্যতম অনুষঙ্গ ইনসুলিন। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে একজন ডায়াবেটিস রোগীকে অন্যান্য নিয়ম পালনের পাশাপাশি নিয়মিত ইনসুলিন নিতে হয়।

টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের বেঁচে থাকার জন্য খাবারের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইনসুলিন। সেই ইনসুলিন যদি নকল হয় বা মানহীন হয় তাহলে রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ঝুঁকিতে পড়ে।

ইনসেপ্টার বাজারজাতকৃত একটি ইনসুলিন অ্যাম্পুল যুগান্তরের কাছে রয়েছে। যেটি ব্যবহার করে জেসমিন আক্তার ব্লাড সুগারের ক্ষেত্রে কোনো উপকার পাননি। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ইনসুলিন ব্যবহার করছি।

নাভির পাশে ইনসুলিন পুশ করার সময় বিশেষ ধরনের অনুভূতি হয়। কিন্তু এ ইনসুলিন ব্যবহার করে কোনো অনুভূতি পাইনি। এমনকি ব্লাড সুগার ২০ থেকে ২২-এ স্থির হয়ে থাকে।

জানতে চাইলে ইনসেপ্টা ফার্মাসিটিউক্যালের এক্সিউটিভ অফিসার (ডিস্ট্রিবিউশন) আবু বকর যুগান্তরকে বলেন, আমাদের ইনসুলিন নকল হয়েছে এমন কোনো তথ্য নেই। তবে বিক্রেতা যদি সঠিক তাপমাত্রায় না রাখে তাহলে সেটির গুণগত মানে পরিবর্তন আসতে পারে। দেশে তাদের ইনসুলিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো পরীক্ষা বা গবেষণা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলতে পারেননি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উন্নত প্রযুক্তিতে প্রস্তুত ইনসুলিনের দাম কিছুটা বেশি। তাই কিছু বিদেশি কোম্পানির ইনসুলিনের নকল বাজারে পাওয়া যায়। তাছাড়া এসব ইনসুলিনের চাহিদা বেশি থাকায় এবং লাভ বেশি হওয়ায় অনেকে বিদেশ থেকে অবৈধভাবে লাগেজে করে ইনসুলিন নিয়ে আসে।

কিন্তু ইনসুলিন নির্দিষ্ট তামপাত্রায় (কোল্ড চেইন) সংরক্ষণ করা না হলে এটি দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এটি হয়ে পড়ে মানহীন ও অকার্যকর। আবার বেশির ভাগ দোকানে ইনসুলিন নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় রাখা হয় না। অনেক দোকানে ফ্রিজ থাকে নষ্ট। ফলে সেখানকার ইনসুলিনগুলোও মানহীন হয়ে পড়ে। তাই এসব ইনসুলিন ব্যবহার করে রোগীরা কোনো সুফল পান না।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ জানান, বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি ইনসুলিন বাজারজাত করছে। কিন্তু এসব ইনসুলিনের কোনো ‘বায়োইকুইভেলেন্স’ (যে কোনো নতুন ওষুধ মানবদেহে নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষা) পরীক্ষা নেই।

এমনকি এটি কত মাত্রায় ব্যবহার করা হলে ব্লাড সুগার কতটা নিয়ন্ত্রণ হবে সে বিষয়েও কোনো গবেষণা নেই। আবার এসব কোম্পানি বিভিন্ন কৌশলে চিকিৎসকদের তাদের ইনসুলিন ব্যবস্থাপত্রে লিখতে বাধ্য করছে। এমনকি তারাই বিভিন্ন অপকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে এ দেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য করছে। ফলে দুর্ভোগে পড়ছেন সাধারণ ডায়াবেটিস রোগীরা।

বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশি কোম্পানি ইনসেপ্টা, স্কয়ার ও বেক্সিমকো ফার্মা ইনসুলিন বাজারজাত করছে। এর আগে দেশের ডায়াবেটিস রোগীরা আন্তর্জাতিক ওষুধ কোম্পানি নভোনর্ডিক্স ও সানোফি অ্যাভেন্টিসের আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ইনসুলিন ব্যবহার করতেন। তবে সানোফি সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে কোনো কোম্পানিই ইনসুলিন তৈরি করে না। তারা মূলত বিদেশ থেকে ইনসুলিন ক্রিস্টাল করে নিয়ে আসে। দেশে এনে সেগুলো অ্যাম্পুলে ভরে বিক্রি করে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সব ধরনের নিয়ম মানা হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহাজাদা সেলিম যুগান্তরকে বলেন, বিদেশি কোম্পানির মডার্ন ইনসুলিনগুলোর নকল পাওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে সেটি নির্ণয়েরও ব্যবস্থা রয়েছে। কারণ ওইসব কোম্পানি একেক দেশের জন্য একেকটি নির্দিষ্ট ব্যাচ তৈরি করে। লাগেজে করে যেসব ইনসুলিন আনা হয়, সেগুলো বিক্রির আগেই কোল্ড চেইন না মানায় নষ্ট হয়ে যায়। আর দেশি কোম্পানির ইনসুলিনের বিষয়ে তিনি বলেন, দেশি কোম্পানির ইনসুলিনের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। এসব ইনসুলিন নিয়ে আরও গবেষণা করা প্রয়োজন।

এ ধরনের ইনসুলিন ব্যবহারে রোগীদের কি ধরনের ক্ষতি হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইনসুলিন নকল বা মানহীন হলে টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের মৃত্যুর শঙ্কা রয়েছে। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে শরীরে অ্যালার্জির প্রভাব বাড়তে পারে, চুলকানি, ইনফেকশন দেখা দিতে পারে। এমনকি নানা ধরনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা জানান, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট উদ্যোগী ও বিভিন্ন মাত্রায় সফল। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। অর্থাৎ বাংলাদেশের ডায়াবেটিস রোগীরা তুলানমূলক খারাপ অবস্থায় জীবনযাপন করছে।

এযাবৎকালে প্রকাশিত দুটি গবেষণালব্ধ প্রবন্ধে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের বিশ শতাংশের কম রোগী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সফল। এটি বর্তমান বিশ্বে যে কোনো দেশের ডায়াবেটিস রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের তুলনায় খুবই কম। ডায়াবেটিসের দীর্ঘকালীন জটিলতাগুলোতেও বাংলাদেশি রোগীরা বেশি ভুগছে।

বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক পরিস্থিতি হল, এখানে অতি অল্প বয়সে মানুষ (ছেলেমেয়েরা) টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি কিশোর-কিশোরী ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে বসবাস করছে।

বাংলাদেশের আরও একটি বড় ঝুঁকি হল- বিপুলসংখ্যক গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রোগী, পৃথিবীতে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের হার বাংলাদেশে তুলনামূলক বেশি। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৪২ কোটিরও বেশি।

ডায়াবেটিস যেহেতু বহুলাংশেই (৮০ ভাগ পর্যন্ত) প্রতিরোধযোগ্য, ফলে এখনই যদি এ রোগের প্রতিরোধ না করা যায়, তাহলে এ সংখ্যা ২০৪০ সাল নাগাদ প্রায় ৬৪ কোটিতে পৌঁছানোর আশঙ্কা করছে সংস্থাটির। আইডিএফের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে ৭৩ লাখেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। যাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই মহিলা। তা ছাড়া, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এমন অর্ধেকেরও বেশি লোক জানেই না যে তাদের ডায়াবেটিস আছে।

লাগেজে আমদানিকৃত ইনসুলিন, কোল্ড চেইন না মানা ও বায়োইকুভ্যালেন্স না করার বিষয়ে জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান (ডিপিএইচ, এমসিপিএইচ, এমএমইডি) যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি জানলাম। আমলে নিলাম। পরে খোঁজখবর নিয়ে দেখব কোথাও কোনো সমস্যা আছে কিনা।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/243560