বায়োমেট্রিক হাজিরা। ছবি: সংগৃহীত
২২ অক্টোবর ২০১৯, মঙ্গলবার, ৬:০১

বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন ক্রয়: লুটপাটের আয়োজন শতকোটি টাকার

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : ১৩ হাজার টাকার মেশিন ৩৩ হাজার টাকায় কেনার চাপ * কোনো কোম্পানিকে সিলেক্ট করা হয়নি। কেউ আমার নাম ভাঙিয়ে থাকলে সেটি খতিয়ে দেখা হবে -প্রতিমন্ত্রী

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কেনায় শতকোটি টাকা লুটপাটের আয়োজন করা হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে ১৩ হাজার টাকার মেশিন ৩৩ হাজার টাকায় কিনতে মৌখিক নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

যদিও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ‘স্পেসিফিকেশন’ (বিস্তারিত বিবরণ) নির্ধারণ করে এ মেশিন কিনতে স্কুল কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাজারদর অনুযায়ী স্পেসিফিকেশন অনুসরণ করে কেনার নির্দেশ উপেক্ষা করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের একটি অসাধু চক্র অতিরিক্ত দামে ওই মেশিন কিনতে তৎপর। প্রতিমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে প্রতিটি মেশিন ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা বেশি দামে কিনতে ‘বাধ্য’ করছে সংশ্লিষ্টদের।

ইতিমধ্যে অতিরিক্ত দামে বেশ কয়েকটি স্কুলে এ মেশিন কেনা হয়েছে। দেশের ৬৫ হাজার ৫৯৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। প্রতিটি মেশিনে কমবেশি ১৮ হাজার টাকার ‘বাণিজ্য’ হলে ওই চক্রটি ১১৮ কোটি ৬ লাখ ৭৪ হাজার টাকা হাতিয়ে নেবে। এ চক্রের নেতৃত্ব রয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের ঢাকা বিভাগের একজন উপ-পরিচালক।

তার নাম উল্লেখ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের অনেকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে- বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কেনার জন্য কোনো বিশেষ কোম্পানিকে সিলেক্ট করা হয়নি। স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী স্কুল কর্তৃপক্ষ বাজার থেকে যাচাই করে নিজেদের পছন্দমতো মেশিন কিনতে পারে। এটি তাদের স্বাধীনতা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কেনার জন্য আমরা শুধু স্পেসিফিকেশন নির্ধারণ করে দিয়েছি। কোনো কোম্পানিকে সিলেক্ট করা হয়নি। যদি কেউ আমার নাম ভাঙিয়ে থাকে তার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’

জানা গেছে, চলতি বছর থেকে সারা দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের জন্য বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন ক্রয়ের নির্দেশনা দেয় সরকার। সেই অনুযায়ী গত বছরের ২৮ এপ্রিল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে সব জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারদের (ডিপিও) চিঠি দেয়া হয়।

এতে বলা হয়- চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪) এর শ্লিপ ফান্ড থেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদের বায়োমেট্রিক হাজিরা নিশ্চিত করতে ডিভাইস (মেশিন) কিনতে বলা হয়। এ ফান্ডে প্রতি বছর স্কুলগুলোকে ৫০ হাজার থেকে স্কুল ভেদে এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় মন্ত্রণালয় থেকে।

সেখান থেকেই মূলত ওই মেশিন কিনতে বলা হয়। সম্প্রতি স্পেসিফিকেশন অনুমোদন করে সংশ্লিষ্ট স্কুল কর্তৃপক্ষেকে বাজার থেকে যাচাই-বাছাই করে ওই মেশিন কেনার নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়।

কিন্তু বিভিন্ন জেলায় স্কুল কর্তৃপক্ষকে মেশিন কেনায় নিরুৎসাহিত করে বলা হয়- ওই মেশিন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করবে। স্কুল কমিটি প্রয়োজনীয় টাকা দিয়ে মেশিন ছাড় করবে। সেখানে মেশিনের বাজার মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ধরা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।

সম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আকরাম আল হোসেনের কাছে সামাজিক যোগাযোগ (ফেসবুক) ও বিভিন্ন মাধ্যমে বেশকিছু কর্মকর্তা ও শিক্ষক অভিযোগ করেন। অভিযোগে বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের ঢাকার বিভাগীয় উপ-পরিচালক ইফতেখার হোসেন ভূঁইয়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের বরাত দিয়ে ‘প্রত্যাশা’ নামক কোম্পানির কাছ থেকে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কিনতে মৌখিক নির্দেশ দিয়েছেন।

বাজারে ওই মেশিন ১৩ হাজার টাকায় পাওয়া গেলেও ওই কোম্পানি মেশিনের দাম নিচ্ছে ৩৩ হাজার টাকা। একাধিক কর্মকর্তা-শিক্ষকদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম আল হোসেন ১৮ অক্টোবর দুপুর ২টা ৪৭ মিনিটে নিজ ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ঘোষণা দেন- ‘বায়োমেট্রিক’ হাজিরা মেশিন কেনার জন্য কোনো বিশেষ কোম্পানিকে সিলেক্ট করা হয়নি। প্রাগম (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়) শুধু স্পেসিফিকেশন অনুমোদন করেছে।

এ স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী স্কুল কর্তৃপক্ষ বাজার থেকে যাচাই করে সর্বোত্তম দামে নিজেদের পছন্দমতো বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কিনে স্কুলে লাগাতে পারে। এটি তাদের স্বাধীনতা। আশা করি এটা নিয়ে ‘ম্যানিপুলেশন’ করার কোনো সুযোগ নেই। অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজটি সবাই সম্পাদন করবেন এটিই আমার প্রত্যাশা। স্কুল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন।’

এ পোস্ট দেয়ার পর অনেকেই সচিবকে ফেসবুকের মাধ্যমে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। সেখানে একজন কর্মকর্তা লিখেছেন- ‘ধন্যবাদ স্যার। বায়োমেট্রিক হাজিরা নিয়ে যে অস্বস্তিকর অবস্থায় ছিলাম সেটা থেকে অনেকটা মুক্তি পেয়েছি স্যার। আপনার সততা, স্বচ্ছতা, উদ্যোগ আমাদের আগামীদিনের পথ চলার পাথেয় স্যার।

কিন্তু বিবেকের তাড়নায় কিছু কথা না বলে পারছি না। ডিডি ঢাকা মহোদয় প্রকাশ্য বিভিন্ন সভায় মন্ত্রী মহোদয় তথা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বলছেন, প্রত্যাশা থেকে নিতে বাধ্য করছেন। বিভিন্ন থানায় গিয়ে গিয়ে উদ্বোধন করছেন।

সাধারণ শিক্ষকরা অসহায় বোধ করছেন। কারণ যে মেশিন দেয়া হচ্ছে তার বাজারদর ১২-১৫ হাজার টাকার বেশি নয়। কিন্তু রাখা হচ্ছে ৩৩ হাজার টাকা। ঢাকা বিভাগে মোট বিদ্যালয় ১০ হাজার ৮৯০টি। টার্গেট সব বিদ্যালয়ে বাস্তবায়ন। কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। মুষ্টিমেয় খারাপ লোকের প্রচণ্ড উত্থান হয়েছে।’

বিষয়টি নিয়ে যুগান্তরের পক্ষ থেকে ঢাকা বিভাগের একাধিক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, বাজারে এসব মেশিন কোম্পানি ভেদে সাড়ে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু দেশের অধিকাংশ এলাকায় এ মেশিন কেনা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা থেকে ৩৩ হাজার টাকা পর্যন্ত।

স্কুল কমিটিকে দেখেশুনে বাজার যাচাই করে মেশিন কিনতে নির্দেশনা দেয়া হলেও দেশের অধিকাংশ স্কুলে এ মেশিন কিনে দিচ্ছেন সহকারী উপজেলা অফিসার (এটিও), উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিও) বা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসাররা (ডিপিও)।

ফলে অনেকে বাধ্য হয়েই দ্বিগুণেরও বেশি দামে ওই মেশিন কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে কেউই নাম প্রকাশ করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তাদের প্রায় অভিন্ন বক্তব্য, ‘আপনারা পারলে প্রতিমন্ত্রী মহোদয় ও বিভাগীয় ডিডি স্যারকে বলেন।

স্কুল কমিটিকে মেশিন কেনার স্বাধীনতা দেয়া হলেও প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের নাম বলায় বিষয়টি নিয়ে আমরা ভয়ের মধ্যে আছি।’ এটি শুধু ঢাকা বিভাগে নয়, সারা দেশেই এ মেশিন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় কেনা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

তবে এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের ঢাকার বিভাগীয় উপ-পরিচালক ইফতেখার হোসেন ভূঁইয়া। তিনি সোমবার সকালে মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘এসবই মিথ্যা অপপ্রচার মাত্র।

তিনি শুধু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মেশিন কিনতে বলেছেন। প্রত্যাশা নামের কোনো কোম্পানি আছে বলে তার জানা নেই। তিনি প্রতিমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে কাউকে কোনো নির্দেশনা দেননি বলেও জানান।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রভাবশালী শিক্ষক-শিক্ষিকারা স্কুলে নিয়মিত যান না। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের আত্মীয়-স্বজনরাই এ বিষয়ে এগিয়ে রয়েছেন।

বিশেষ করে ক্লাসের সময়েও দেশের চরাঞ্চল, হাওরপ্রবণ দুর্গম পাহাড়ি এলাকার অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তালাবদ্ধ থাকে। এসব এলাকার স্কুলে দিনের পর দিন ক্লাস হয় না। কোনো কোনো স্কুলে স্বল্প বেতনে ‘প্রক্সি শিক্ষক’ বা ‘প্যারা শিক্ষক’ দিয়ে ক্লাস করানো হয়।

প্রকৃত শিক্ষকরা মাসে দু-এক দিন স্কুলে হাজির হয়ে হাজিরা খাতায় সই করেই ঘণ্টাখানেক পর ‘হাওয়া’ হয়ে যান। যার খোঁজখবর রাখে না সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি (এসএমসি)।

এমনকি এসব স্কুলে পরিদর্শনে যান না সংশ্লিষ্ট সহকারী উপজেলা অফিসার (এটিও), উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিও) বা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (ডিপিও)। ৬ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার পদ্মার চরের সাতটি স্কুলে ঝটিকা সফরে যান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আকরাম আল হোসেন।

সেখানে সাতটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে ছয়টিই বন্ধ পান তিনি। এমনকি স্কুলগুলোর ২৩ শিক্ষকের মধ্যে ২০ জনই ছিলেন অনুপস্থিত। শুধু মানিকগঞ্জেই নয়, সারা দেশেই প্রায় একই চিত্র। এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে চলতি বছর থেকে সারা দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের জন্য বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন ক্রয়ের নির্দেশনা দেয় সরকার।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/234896/