২১ অক্টোবর ২০১৯, সোমবার, ১২:০১

ব্যাংকগুলোতে ৪ হাজার ঋণখেলাপির আবেদন: বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিল

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে বিশেষ সুবিধার আওতায় ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন করেছেন প্রায় ৪ হাজার ঋণখেলাপি। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে এক হাজার ৫০০, জনতা ব্যাংকে ৮০০, বেসিক ব্যাংকে ৫৫০, অগ্রণী ব্যাংকে ৪০০, রূপালী ব্যাংকে ২৫০ এবং বিডিবিএলে ২৫০ জনের আবেদন জমা পড়েছে। বাকি ২৫০টি আবেদন বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকে করা হয়েছে। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এ সুবিধা দিতে খুব বেশি আগ্রহী নয়। সে কারণে আবেদন কম গ্রহণ করা হয়েছে এবং তাও যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে দেয়া হবে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, বেসরকারি ব্যাংকগুলো ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ সুবিধা দিতে রাজি নয়। এ কারণে ঋণখেলাপিরা উচ্চ আদালতে রিট করছেন। রিট আবেদন বিবেচনায় নিয়ে আদালত বিষয়টি সমাধানের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশনা দেন। এ ধরনের বেশকিছু ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটেছে। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ উচ্চ আদালতে রিট করছেন বেসরকারি ব্যাংকের বিরুদ্ধে। সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগও দিচ্ছেন অনেকেই। বেসরকারি ব্যাংকে এ রকম চিত্র থাকলেও ঠিক বিপরীত চিত্র সরকারি ব্যাংকগুলোতে। ডেকে ডেকে আবেদন করাচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলো। রোববার পর্যন্ত সরকারি ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকে সাড়ে তিন হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়েছে। আবেদনের মেয়াদ আরও এক মাস বাড়ানো হতে পারে বলে জানা গেছে।

বিভিন্ন পক্ষের বিরোধিতা ও সমালোচনার পরও খেলাপি ঋণ কমাতে অর্থমন্ত্রীর সুপারিশে ১৬ মে ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট-সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দমানে খেলাপি ঋণ মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের বিপরীতে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুবিধা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহারের সীমা ঠিক করে দেয়া হয় ৯ শতাংশ। পুনঃতফসিলের আগে গ্রাহককে সুদ মওকুফ সুবিধাও দেয়া যাবে। সার্কুলার জারির তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে এ সুবিধার জন্য আবেদন করতে বলা হয়। সার্কুলারের ওপর উচ্চ আদালতের দু’দফা স্থগিতাদেশের কারণে আবেদন কার্যক্রম অনেক দিন বন্ধ ছিল। পরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে সময় বাড়িয়ে আবেদনের শেষ দিন নির্ধারণ করা হয় ২০ অক্টোবর।

জানা যায়, বিশেষ নীতিমালায় ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক সুবিধা দিতে নারাজ। সেজন্য অনেক ব্যাংক নানা উপায়ে গ্রাহককে ঘুরাচ্ছে বলে অভিযোগ পাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে কোনো কোনো ব্যাংক আবেদনে বিভিন্ন ভুল ধরে সময়ক্ষেপণ করছে। কোনো ব্যাংক আবার সরাসরি বলে দিচ্ছে আপনার আবেদন বিবেচনার যোগ্য নয়। তবে সার্কুলারে যেহেতু ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে সুবিধা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কোনো ব্যাংক সুবিধা না দিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ কিছু বলার নেই। যদিও সরকারি ব্যাংকগুলোতে ভিন্নচিত্র। অধিকাংশ সরকারি ব্যাংক গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আবেদন নিয়েছে।

জানতে চাইলে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘যেটা না দিলে নয় শুধু এমন আবেদন গ্রহণ করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘বেসরকারি ব্যাংকে এ ধরনের আবেদন বেশি আসবে না।’

এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি আনিস এ খান বলেন, ‘খুব বেশি আবেদন আসেনি। কয়েকটি আবেদন এসেছে। এর মধ্যে বেছে বেছে দু-একটি আবেদন বিবেচনায় নেয়া হবে।’ পূবালী ব্যাংকের এমডি আবদুল হালিম চৌধুরী বলেন, ‘কিছু আবেদন জমা পড়েছে। ইতিমধ্যে বোর্ডে কয়েকটি উপস্থাপন করা হয়েছে। মোটে না পাওয়ার চেয়ে কিছু পাওয়াও ভালো। সে বিবেচনায় এসব আবেদন নেয়া হয়েছে।’

সবচেয়ে বেশি আবেদন পেয়েছে সোনালী, জনতা ও বেসিক ব্যাংক। নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির প্রভাবে খেলাপি ঋণের দিক দিয়েও শীর্ষে রয়েছে এই ব্যাংকগুলো। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্বোচ্চ ২০ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে জনতা ব্যাংকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে সোনালী ব্যাংকে। আর বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ রয়েছে ৯ হাজার ১১৪ কোটি টাকা।

জানা গেছে, পুনঃতফসিলের জন্য জনতা ব্যাংকে আবেদন করেছে একক গ্রাহকের ঋণসীমা অতিক্রম করে কয়েকগুণ ঋণসহ বিভিন্ন অনিয়মের কারণে আলোচিত অ্যাননটেক্স গ্রুপসহ ৮০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি।

জনতা ব্যাংকে অ্যাননটেক্স গ্রুপের বর্তমান খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দমানে খেলাপি প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বিশেষ সুবিধায় পুনঃতফসিলের জন্য আবেদন করা হয়েছে। অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন জালিয়াতিতে অভিযুক্ত চামড়া খাতের ক্রিসেন্ট গ্রুপ এবং অর্থ পাচার করে পলাতক বিসমিল্লাহ গ্রুপ এ সুবিধার জন্য ব্যাংকের সঙ্গে আলাপ করেছে। এদের মধ্যে বিসমিল্লাহ গ্রুপ আবেদন করলেও তাতে সাড়া দিচ্ছে না ব্যাংক।

এছাড়া বেসিক ব্যাংকের ৯০৯ জন ঋণখেলাপি এ সুবিধা পাবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আবেদন করেছেন সাড়ে পাঁচশ’ ঋণখেলাপি। এসব আবেদনকারীর কাছে আটকে আছে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি।

জানতে চাইলে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, ‘বিশেষ নীতিমালায় ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধার ২৫০ জন আবেদন করেছেন। যাচাই-বাছাই করে এসব আবেদন নিষ্পত্তি করা হবে। তিনি বলেন, রূপালী ব্যাংকে খেলাপি কম, তাই আবেদনও কম পড়ছে।’

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/234503/