২০ অক্টোবর ২০১৯, রবিবার, ২:৫৭

ভয়াবহ দূষণের কবলে মৃতপ্রায় শীতলক্ষ্যা

ভয়াবহ দূষণের কবলে এককালের স্রোতস্বিনী শীতলক্ষ্যা। নারায়ণগঞ্জের প্রাণ শীতলক্ষ্যা এখন মৃতপ্রায়। দূষণের মাত্রা এতটাই যে, পানির দুর্গন্ধের কারণে নদীর ধারে-কাছেও যাওয়া যায় না। শীতের আগেই নদীর পানি একেবারে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। গত কয়েক দিনে সরেজমিন শীতলক্ষ্যা দূষণের এমন ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে।

নারায়ণগঞ্জ সেন্ট্রাল খেয়াঘাট সংলগ্ন ওয়াকওয়ের নিচে বিশালাকৃতির ড্রেন দিয়ে রঙ ও দুর্গন্ধযুক্ত পানির ধারা সরাসরি শীতলক্ষ্যায় পড়ছে। একই সঙ্গে পলিথিন ও গৃহস্থালির বর্জ্যও পড়ছে। শীতলক্ষ্যার ওই এলাকাজুড়ে পানির রং কালো ও বিদঘুটে গন্ধ। আশপাশের মানুষ এ উৎকট গন্ধে সেখানে দাঁড়াতেও পারছিলেন না। একটু এগিয়ে সেন্ট্রাল খেয়াঘাট থেকে টানবাজারের দিকে যেতে নজরে আসে আরও কয়েকটি ড্রেন। সেখানেও একই পন্থায় দূষিত পানি বের হচ্ছে। নদীর তীর ঘেঁষে একটি নৌকায় করে সেন্ট্রাল খেয়াঘাট থেকে আরও একটু উত্তরে গেলে দেখা যায় একের পর এক ড্রেনের মুখ। শহর ও শহরতলীর ড্রেনগুলো এসব মুখে যুক্ত। শহরের প্রায় সব এলাকার পানি শীতলক্ষ্যায় পড়ে।

শহরের খানপুর বরফকল মাঠ এলাকায় গিয়ে ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়। সন্ধ্যার পর পাঁচটি মোটা পাইপের মাধ্যমে বিভিন্ন ডাইংয়ের দূষিত পানি নদীতে গিয়ে পড়ে। কারণ ডাইং কারখানাগুলো বর্জ্য ও দূষিত পানি ছেড়ে দেয়। এছাড়া অনেক ডাইং কারখানা বর্জ্য ফেলার পাইপগুলো পানির নিচ দিয়ে নিয়েছে; যাতে সেগুলো দৃশ্যমান না হয়। আরেকটু উত্তরে গেলে পাঠানটুলী এলাকার চিত্র আরও ভয়াবহ।

বরফকল ঘাটের নৌকার মাঝি সাইফুল জানান, দিনের বেলায় নাকে রুমাল চেপে নৌকা পারাপার করতে হয়। গন্ধে টিকা যায় না। আর সন্ধ্যার পর কালো পানি লাল হয়ে যায়। মনে হয় রক্তের বন্যা বইতে শুরু করেছে। শহরের ৫নং খেয়াঘাটের ইঞ্জিনচালিত নৌকার মাঝি সুমন মিয়া জানান, ইঞ্জিনের পাখা ঘুরলে দুর্গন্ধ অনেক বেড়ে যায়। প্রায়ই পলিথিন পাখায় আটকে যায়। সিদ্ধিরগঞ্জের চিত্তরঞ্জন খেয়াঘাটের মাঝি সোলেমান মিয়া বলেন, এখন কারখানা মালিকরা চালাক হয়ে গেছে। পাইপ এমনভাবে বসায় যেন কেউ দেখতে না পায়। কারখানাগুলো যখন বর্জ্যপানি ছাড়ে তখন নদীর তীরে বুদবুদ হয় এবং লাল ও কালো রঙের পানি বেরিয়ে আসতে থাকে। বিভিন্ন এলাকার লোকজন নদীতীরে বর্জ্য ফেলছে। আর সেগুলো ধীরে ধীরে নদীতে গিয়ে পড়ছে।

শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ও আশপাশে ২০০ শিল্প কারখানা রয়েছে। এছাড়া দূরবর্তী অনেক কারখানার পানিও ড্রেনের মাধ্যমে নদীতে ফেলা হচ্ছে। কারখানার বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই নদীতে পড়ে। এলাকার প্রবীণরা জানান, আগে এ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন অনেকে। কিন্তু ১৫-২০ বছর ধরে কেউই নদীতে মাছ ধরে না। নদীর যে অবস্থা তাতে মাছ থাকা অসম্ভব।

শীতলক্ষ্যা দূষণ রোধে নিয়মিত কর্মসূচি পালন করা পরিবেশবাদী সংগঠন নির্ভীকের প্রধান সমন্বয়ক এটিএম কামাল জানান, আমরা বহু বছর ধরে আন্দোলন করলেও কার্যত কোনো সুফল পাচ্ছি না। বরং দিন দিন দূষণ বাড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও কারখানা স্থাপনে এ দূষণ হচ্ছে। সভা-সেমিনার করে আমরা দূষণের কারণ বললেও এগুলো রোধে কোনো উদ্যোগ নেই।

পরিবেশ অধিদফতর নারায়ণগঞ্জ জোনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, অনেক কারখানার ইটিপি প্ল্যান্ট আছে। জরিমানা বা প্রশাসনিক ঝামেলা এড়াতে ইটিপি প্ল্যান্ট তৈরি করলেও সেটা ব্যবহার করে না। কারণ মালিকদের দাবি, এটা ব্যবহার করলে প্রতিদিন মোটা অংকের টাকা খরচ হয়। খরচ বাঁচাতেই বিকল্প পাইপ দিয়ে অনেক ডাইং ও শিল্প কারখানার কেমিক্যালযুক্ত পানি সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। আর রাতে এ কাজটি বেশি করায় সহজেই তাদের ধরা যাচ্ছে না। আমরা যখন দিনের বেলায় কারখানা পরিদর্শনে যাই, তখন দেখানো হয় ইটিপি প্ল্যান্ট আছে। প্ল্যান্টের পাশে বিশাল আকৃতির ট্যাংকি রাখা হয়। সেখানে দিনের বিষাক্ত পানি জমা হয়। রাতে তা নদীতে ফেলে দেয়া হয়।

পরিবেশ অধিদফতরের নারায়ণগঞ্জ জোনের উপ-পরিচালক মো. ফেরদৌস আলম জানান, এক বছরে নদী দূষণে অনেক কারখানাকে কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে শীতলক্ষ্যা নদী দূষণের কারণে এক বছরে ৬৪ লাখ ৬০ হাজার ২৮৮ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তিনি বলেন, লোকবল সংকটে সব সময় পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। এছাড়া ঢাকার অফিস থেকে অভিযানগুলো পরিচালনা করা হয়। সেখানেই কারখানা মালিকদের তলব করে শুনানি হয়। তখন দূষণের মাত্রা বুঝে অর্থদণ্ড করা হয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/234087/