রাজধানীর শেরেবাংলানগর থানার পাশে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তৈরি অট্টালিকাটি অযথা পড়ে আছে। ছবি : কালের কণ্ঠ
১৭ অক্টোবর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৪:৪২

জনগণের টাকায় প্রকল্প নিয়ে ছিনিমিনি

জনগণের টাকায় প্রকল্পের পর প্রকল্প নিয়ে সরকারি কর্মকর্তারা কিভাবে ছিনিমিনি খেলছেন, লুটপাট করছেন; সরকারের তথা জনগণের সম্পদ কিভাবে নষ্ট করছেন—এসব স্বচক্ষে দেখতে বেশি দূরে যেতে হলো না। রাজধানীর শেরেবাংলানগর থানার পাশে নির্মাণ করা সুদৃশ্য ১২ তলা ভবনটিই সব জানান দিল। রোগীদের রক্ত, কফ, মল-মূত্রসহ সব ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম খরচে, কম সময়ে করা এবং পরীক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আড়াই বছর আগে এই ভবন নির্মাণ করা হয়েছে; ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার জন্য। প্যাথলজি সেবা নিতে রোগীদের এখানে লম্বা লাইন থাকার কথা। কিন্তু গত ১৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেল, কোনো রোগী নেই; ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে একা। স্থানীয়রা জানালেন, দুই বছর ধরে অব্যবহৃত পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে ভবনটি।

এ রকম কত ভবন, কত স্থাপনা, কত উন্নয়ন প্রকল্পের কত কাজ কতভাবে যে নষ্ট হচ্ছে অসাধুদের কারণে, গত সাত মাসের অনুসন্ধানে জানা গেছে পরিষ্কারভাবে। সবগুলোর কাহিনি তো আর পত্রিকায় লিখে শেষ করা যায় না। তাই এই ধারাবাহিক প্রতিবেদনের শেষ পর্বে আজ তুলে ধরা হলো এডিপির তিনটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন চিত্র। তিনটিতেই রয়েছে তিন ধরনের অরাজকতা।

তবু শেরেবাংলানগরের নয়নাভিরাম ভবনটির সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা আশা জেগে থাকে মনে—এখানে অসহায় রোগীরা আসবে; প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাবে; কম খরচে, কম সময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পেয়ে চিকিৎসকের কাছে দৌড়াবে; এগুলো বড়ই সুখের কথা। কিন্তু ভবনের ভেতরে ঢুকতেই সব আশার বেলুন চুপসে গেল। দামি দামি আসবাবপত্রগুলোয় ধুলোবালির আস্তরণ। একতলা, দোতলা, তিনতলা, চারতলা পর্যন্ত ঝকঝকে তকতকে টাইলস-ফিটিংস আর দামি ফার্নিচার সাজানো; কিন্তু ধুলো-মলিন চেহারায়। ভবনের পঞ্চম তলায় গিয়ে চোখ আটকে গেল। চার বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, চীন থেকে কেনা ল্যাবের অব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলোর ওপর ধুলোবালি পড়ে আছে। কোটি কোটি টাকায় কেনা এসব যন্ত্রপাতি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। রোগীদের সেবায় ব্যবহৃত হচ্ছে না দামি এসব যন্ত্রপাতি। ভবনের প্রতিটি তলার জন্য কেনা ফার্নিচারগুলোর ওপর ধুলোবালি পড়ে এখন অনেকটা বিবর্ণ। সিটি স্ক্যানের জন্য তৈরি করা রুমে জং ধরেছে। ভবনের ভেতরে কাজের মানও অত্যন্ত নিম্নমানের। রুমের দরজাগুলো দেওয়া হয়েছে সাধারণ কাঠের। অথচ এসব দরজা দেওয়ার কথা ছিল সেগুন কাঠের। মরিচা পড়েছে ভবনের অনেক স্থানে। ভবনে মার্বেল পাথর ব্যবহারের কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। ভবনের ভেতরের এসব ১২ তলা ভবনে ওঠানামার জন্য বসানো দুটি লিফট ব্যবহারে কেউ নেই। কেমিক্যাল আনা-নেওয়ার জন্য কেনা একটি গাড়ি অফিসের সামনে অলস পড়ে রয়েছে। ভবনটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ৬৫ কোটি টাকা। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাক বললেন, ‘রাতের বেলায় ওই ভবনের চারপাশে মাদকের আড্ডা বসে। ওই ভবনের পাশেই হলো বস্তি। সেখানকার উঠতি ছেলেরা রাতের বেলায় ভবনের চারপাশে ফেনসিডিল নিয়ে বসে।’

প্যাথলজি ও ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন প্রতিষ্ঠার জন্য ১২ তলাবিশিষ্ট বহুতল ভবনটির এমন হাল কেন, এর কারণ খুঁজতে যোগাযোগ করা হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিকল্পনা কমিশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে। অনুসন্ধানে জানা যায়, রোগীদের প্যাথলজি সেবা দেওয়ার পাশাপাশি সারা দেশের সরকারি প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিগুলোর গুণগত মান ঠিক করতে সরকার ২০১০ সালে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়। ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার’ শিরোনামের প্রকল্পটি যখন অনুমোদন দেওয়া হয়, তখন এর খরচ ধরা হয়েছিল ১৩৮ কোটি টাকা। প্রকল্পটি নেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন প্রতিষ্ঠা করা, কমিউনিটি ও হাসপাতাল পর্যায়ে ল্যাবরেটরি মেডিসিনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব জনশক্তিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, সারা দেশের ল্যাবরেটরিগুলোর গুণগত মান ঠিক করা। ল্যাবরেটরিগুলোর স্বীকৃতি দেওয়া এবং গবেষণা করা। রোগীরা সরাসরি সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যেতে পারবে। আবার দেশের যেকোনো জায়গা থেকে ডাক্তারদের দেওয়া পরীক্ষা-নিরীক্ষাও সেখানে করাতে পারবে। ২০১০ সালে শুরু করে তিন বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১৩ সালে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ৯ বছর পেরিয়ে গেছে। চার দফা মেয়াদ বাড়িয়েও এখনো প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ফলে ১৩৮ কোটি টাকার প্রকল্পের খরচ বেড়ে উন্নীত হয়েছে ১৯৪ কোটি টাকায়। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পে খরচ হয়েছে ১৪৩ কোটি টাকা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখন চাইছে, প্রকল্পটির মেয়াদ পঞ্চমবারের মতো বাড়াতে। কিন্তু প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়াতে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। ২০১৬ সালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদিত পরিপত্রে বলা আছে, কোনো প্রকল্পে দুইবারের বেশি মেয়াদ বাড়ানো যাবে না। একটি প্রকল্পের এতবার মেয়াদ বাড়ানো সরকারের আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী বলে মনে করে কমিশন। পরিকল্পনা কমিশনের স্বাস্থ্য শাখার উপসচিব ইমতিয়াজ মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জনবল নিয়োগের জন্য প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে তারা আমাদের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। আমরা সেটি পরিকল্পনামন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়েছি। পঞ্চমবারের মতো প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হবে কি না তা নির্ভর করছে এখন পরিকল্পনামন্ত্রীর ওপর।’

সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় নেওয়া প্রকল্পটিতে এত টাকা খরচ হওয়ার পরও কেন সাধারণ মানুষ এখান থেকে সেবা পাচ্ছে না এর অনুসন্ধানে জানা গেল, বিদেশ থেকে আনা এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারে যে জনবল দরকার, তা এখনো পায়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জনবল সংকটের কারণেই বড় অঙ্কের টাকা খরচ করেও এখান থেকে সুফল মিলছে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভবন নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি কেনায় যতটা আগ্রহ ছিল কর্মকর্তাদের, জনবল নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে ততটা গতি ছিল না। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। ভবন ও যন্ত্রপাতি কেনা শেষ। কিন্তু জনবল নিয়োগ হয়নি। ২০১০ সালে প্রকল্পটি অনুমোদনের পর থেকে এখন পর্যন্ত চারবার প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন হয়েছে। ফলে কেউই জনবল নিয়োগের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়নি। চলতি বছরের মে মাসে প্রকল্পটি সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়েছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) উপপরিচালক সাইফুর রহমান। ২০ সেপ্টেম্বর এই প্রতিবেদক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমার যে (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) ক্ষুধা আছে, সেটা তো বোঝাতে হবে। কিন্তু তারা সেই ক্ষুধার অর্থ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে বোঝাতে সক্ষম হয়নি। যার ফলে তারা জনবলও পায়নি।

অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে দেখা গেছে, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ও প্যাথলজি সার্ভিসের জন্য প্রথম শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণি, তৃতীয় শ্রেণি ও চতুর্থ শ্রেণির জন্য মোট ৭০৫ জনের প্রস্তাব চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু জনপ্রশাসন থেকে অনুমোদন দেওয়া হয় ২০০ জনের। সেখান থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন দেওয়া হয় ১০৫ জনের। যার মধ্যে সরকারি আদেশ (জিও) হয়েছে ১৮ জনের। যাদের এখন পর্যন্ত নিয়োগ হয়নি। ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পে একজন প্রকল্প পরিচালক, একজন হিসাবরক্ষক ও তিনজন নিরাপত্তাকর্মী কাজ করছে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই প্রকল্পে মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে ৩২ কোটি ৫৯ লাখ টাকার। পরের বছর কেনা হয়েছিল আরো ১৪ কোটি ৬০ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি। চলতি অর্থবছরে আরো ৪৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার বরাদ্দ মিলেছে। কিন্তু তারা এই টাকা খরচ করতে পারছে না; কারণ গত জুন মাসে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক শাহ মুনীর। এই প্রতিবেদক তাঁর সঙ্গে কথা বলে গত ২০ সেপ্টেম্বর। আট বছর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিদায় নেওয়া শাহ মুনীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কম দামে রোগীদের উন্নত সেবা দিতেই তখন প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। আমার মতে, প্রকল্পে বারবার প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন করার কারণে প্রকল্পটির এই দশা। একজন দায়িত্ব নিয়ে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয়। এতে জনবল নিয়োগের জন্য কোনো চেষ্টাই হয়নি। যার ফলে ভবন ও যন্ত্রপাতি আনা শেষ। কিন্তু জনবল নিয়োগ হয়নি।’ শাহ মুনীর বলেন, বাংলাদেশে সাধারণত কোনো প্রকল্প তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে জনবল কাঠামো নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। এটাই নিয়ম। প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার কাছাকাছি সময়ে জনবল নিয়োগপ্রক্রিয়াও শেষ হয়। তখন আর সমস্যা হয় না। কিন্তু এই প্রকল্পে ভবন ও ল্যাব নির্মাণে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে, জনবল নিয়োগে ততটা হয়নি।

‘জনবলে কেন মনোযোগ দেওয়া হয়নি’ সদ্যবিদায়ী প্রকল্প পরিচালক ডা. ফরিদ হোসেন মিঞাকে গতকাল বুধবার সন্ধায় প্রশ্ন করলে তিনি দোষ চাপান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগের ওপর। সেই সঙ্গে ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলিকেও এই প্রকল্পে কাঙ্ক্ষিত গতি না আসার কারণ বলে জানান তিনি। আরো জানান, প্রকল্পটির কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছিল জমি অধিগ্রহণের কারণে। ভবন নির্মাণে ত্রুটির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা কাজ বুঝে নিইনি। কারণ কাজে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান জি কে বিল্ডার্স আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা সব ত্রুটি ঠিক করে দেবে।’

এই জি কে বিল্ডার্স হলো সাম্প্রতিক ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার যুবলীগ নেতা পরিচয়ধারী জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) উপপরিচালক মোহাম্মদ সাইফুর রহমানের করা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অসহায় রোগীদের কল্যাণের স্বার্থে নেওয়া ওই প্রকল্পটির মেয়াদ ২০১৪ সালে প্রথমবার, ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বার, ২০১৭ সালে তৃতীয়বার এবং ২০১৮ সালে চতুর্থবারের মতো বাড়িয়ে নেওয়া হয়। আর প্রকল্প পরিচালক (পিডি) পরিবর্তনের ফিরিস্তিটা এ রকম : মো. সামিউল হক পিডি ছিলেন ২০১১ সালের মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত; অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হাসান ছিলেন ২০১১ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর; মো. জিল্লুর রহমান ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে গত এপ্রিল এবং মো. ফরিদ হোসেন মিঞা এ বছর এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এর পর ওই প্রকল্পের পিডি হয়ে যোগ দেন ডা. আবুল খায়ের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান।

এত ঘন ঘন পিডি বদলের দায় কার জানতে চাইলে ফরিদ হোসেন মিঞা গতকাল আবারও দায় চাপান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর। তাঁর কথার সূত্র ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সাইদুর রহমানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি শুধু বলেন, অনেক সময় পিডি দায়িত্ব উপভোগ করেন না। সে জন্য তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয়।

৭২% কাজ শেষ হওয়ার পর মনে হলো নান্দনিকতা নেই

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ‘পর্যটন ভবনের’ প্রধান কার্যালয় নির্মাণের কাজটি শুরু হয়েছিল দুই বছর আগে। দুটি বেইজমেন্টসহ ১৩ তলা ভবনটির ছাদ ঢালাইয়ের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ, টাইলস বসানোর কাজও শেষ। প্রকল্প শুরুর দুই বছর পর ৭২ শতাংশ কাজ শেষ করে এখন পর্যটন করপোরেশন বলছে, ভবনটি নান্দনিক হয়নি; অত্যাধুনিকও হয়নি। দেশি-বিদেশি পর্যটক টানতে ভবনটি নান্দনিক ও অত্যাধুনিক করে তুলতে হবে। ভবনটি নান্দনিক করে তুলতে বাড়তি টাকা চাই। একই সঙ্গে বাড়তি সময়ও চাই। সে কারণে ৬২ কোটি টাকার প্রকল্পটির খরচ বাড়িয়ে ৭৯ কোটি টাকা এবং প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করতে চায় পর্যটন করপোরেশন।

কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৩ তলা ভবনের ছাদ ঢালাই শেষে এখন পর্যটন করপোরেশন ভবনের ওপরে একটি অত্যাধুনিক রেস্তোরাঁ করতে চায়। প্রকল্পটির কাজ যখন প্রায় শেষের দিকে তখন কেন রেস্তোরাঁ করার কথা মনে পড়ল এর কারণ খুঁজতে জানা গেল, দুই বছর পর এসে পর্যটন করপোরেশনের কর্মকর্তাদের মনে হয়েছে, শেরেবাংলানগর অনেকটা প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে রূপ পেয়েছে। এই এলাকায় উন্নতমানের কোনো খাবারের রেস্তোরাঁ নেই। ফলে এখান থেকে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে খাবার-নাশতা বিতরণ করলে বাড়তি আয়ের উৎস তৈরি হবে। রেস্তোরাঁটি অত্যাধুনিকভাবে গড়ে তোলা হবে। সংশোধিত প্রকল্পে তাই রেস্তোরাঁ নির্মাণের কথাটি সংযুক্ত করা হচ্ছে। মূল প্রকল্পে কেন রেস্তোরাঁ ঢোকানো হয়নি, জানতে চাইলে পর্যটন করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (পূর্ত) মাহমুদ কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা বিষয়টি ওভাবে চিন্তা করেননি। পর্যটন করপোরেশন যেহেতু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, তাই রেস্তোরাঁ থেকে বাড়তি আয় করা যেতেই পারে।’

ভবনটিতে নান্দনিক ও স্থাপত্যশৈলীর সন্নিবেশ ঘটাতে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সে কারণে বাড়তি ১৭ কোটি টাকা চেয়ে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠিয়েছে পর্যটন করপোরেশন। প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো ও বাড়তি ১৭ কোটি টাকার প্রস্তাবটি এখন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের দপ্তরে রয়েছে।

প্রকল্পের কাজ ৭২ শতাংশ শেষ হওয়ার পর নতুন করে কী করতে চায় পর্যটন করপোরেশন এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, ভবনে ঢুকতেই ফেয়ার ফেস সার্ফেস সংযোজন করতে চায়; যেটা ২০১৭ সালে প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় ছিল না। ৬২ কোটি টাকার প্রকল্পটি কেন ৭৯ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হলো—কোথায় কোথায় নতুন নতুন অঙ্গ যুক্ত হচ্ছে তার খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পুরো ১৩ তলা ভবনটির স্থাপত্যশৈলীর সন্নিবেশ চায় পর্যটন করপোরেশন। ভবনের ভেতরে আগে ইটের পার্টিশন দেওয়ার কথা ছিল; সেটি বাদ দিয়ে এখন গ্লাস পার্টিশন দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যার জন্য বাড়তি ৫৫ লাখ টাকা চেয়েছে সরকারি সংস্থাটি। ভবনটিকে জ্বালানিসাশ্রয়ী করতে ভবনের পশ্চিম দিকে অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমসহ লো হিট এমিশন গ্লাস দিয়ে আচ্ছাদন করা হবে, যা আগে অনুমোদনের সময় ছিল না। সেমিনার হলের শব্দযন্ত্র পরিবর্তনের প্রস্তাবও করা হয়েছে। এ ছাড়া ভবনের ভেতরে আধুনিক টয়লেট সুবিধা, ডাটা সেন্টার স্থাপনের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেডের প্রকৌশলী আলতাফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেহেতু এটি পর্যটন করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়, তাই আমরা এটিকে আরো সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলতে চাই। সেখানে একটি রেস্তোরাঁ তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আরো নতুন কিছু উপকরণ ও সেবা স্থাপন করা হবে।’

প্রকল্পটি তৈরির সময় মনে না হলেও এখন এসে পর্যটন করপোরেশনের মনে হয়েছে, পর্যটন ভবনটি সদর দপ্তর হওয়ায় এখানে উন্নতমানের আসবাবপত্র থাকা দরকার। সে কারণে প্রকল্পটি সংশোধনের দরকার বলে জানিয়েছে পর্যটন করপোরেশন। পর্যটন করপোরেশনে চেয়ারম্যানের জন্য একটি চেয়ার কেনা বাবদ দাম ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা। চারজন পরিচালকের জন্য সমান চেয়ার কিনতে সমান দাম ধরা হয়েছে। টেবিল, আলমারি, বুকশেলফসহ ৪৭৬টি আসবাবপত্র কেনা হবে এই প্রকল্পের আওতায়।

প্রধানমন্ত্রীর নামে প্রকল্পও পড়ে থাকে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে প্রকল্প জামালপুরে শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। এখন থেকে চার বছর আগে ৭১৬ কোটি টাকা খরচে প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। বাংলাদেশের অন্যতম অবহেলিত ও দারিদ্র্যপ্রবণ জেলা জামালপুর। স্বাস্থ্যসেবায় অন্য জেলার তুলনায় অনেক পিছিয়ে মধ্যাঞ্চলের জেলাটি। এই জেলার মানুষ যাতে সহজে চিকিৎসাসেবা পেতে পারে, সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে ২০১৬ সালে সদর উপজেলায় ৭১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এই প্রকল্পের মূল কাজ ছিল ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট শেখ হাসিনা হাসপাতাল নির্মাণের কাজ। গত তিন বছরে এই প্রকল্পের আওতায় অন্যান্য কাজ যেমন একাডেমিক ভবন, ছাত্রদের হোস্টেল, ছাত্রী হোস্টেল, ডরমিটরি ভবন, অন্যান্য আবাসিক ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হলেও প্রধানমন্ত্রীর নামে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের কাজ এখনো শুরুই হয়নি। এর কারণ খুঁজতে কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পের আওতায় ৫০০ শয্যার হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ করা আড়াই শ কোটি টাকা রাখা হয়েছে ভারতীয় ঋণ থেকে। এর বাইরে যত কাজ হয়েছে, সবই রাষ্ট্রীয় টাকায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানেন, ভারতীয় ঋণের টাকা পাওয়া কঠিন। ঠিকাদার নিয়োগে জটিলতা দেখা দেয়। ঠিকাদার নিতে হয় ভারত থেকে। পণ্য ও সেবা আনতে হয় সে দেশ থেকে। ২০১০ সাল থেকে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এই সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা হাসপাতালের মতো একটি স্পর্শকাতর প্রকল্প কেন ভারতীয় ঋণে রাখা হলো তা নিয়ে প্রশ্ন আছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে।

প্রকল্প পরিচালক ওয়াকিল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা তখনো প্রকল্পটি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকায় বাস্তবায়নের কথা বলেছিলাম। আমরা জানতাম ভারতীয় ঋণে টাকা নিলে প্রকল্প বাস্তবায়নে জটিলতা দেখা দেবে। কিন্তু তখন মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ভারতীয় ঋণে শেখ হাসিনা হাসপাতাল নির্মাণ না করতে অনুরোধ করেছিলাম।’ ওয়াকিল আহমেদ বলেন, ‘আমরা এখনো বলছি, প্রকল্পটি ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়ন না করে নিজস্ব টাকায় করতে। প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা চলছে। দেখা যাক কী হয়।’

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ওই সময় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা শেখ হাসিনা হাসপাতালটি সরকারি টাকায় বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি আমলে নেয়নি। হাসপাতাল ভবনের জন্য যখন দরপত্র আহ্বান করা হয়, তখন সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত হয় ভারতের সিনটেক্স সিস্টেম নামে একটি কম্পানি। কিন্তু কম্পানিটি যে দাম ধরেছে, তা সরকারের বাজেটের চেয়ে ৩৪ শতাংশ বেশি। এত বেশি টাকায় ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ভবনটি করা ঠিক হবে না বিধায় সেখান থেকে সরে আসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ কারণে গত চার বছরে ভবনটির কাজের অগ্রগতি শূন্য। আর সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারায় প্রকল্প ব্যয় এখন গিয়ে ঠেকেছে এক হাজার কোটি টাকায়। মেয়াদ বেড়েছে দুই বছর। এর ফলে প্রকল্পের সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/10/17/827686