১৭ অক্টোবর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৪:৩৮

চট্টগ্রামে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে পোশাক কারখানা

চট্টগ্রামে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পোশাক কারখানা। এ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন তৈরি পোশাক শিল্পমালিক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগরীর ঝাউতলায় বিজিএমইএ ভবনের সম্মেলন কক্ষে এক মতবিনিময় সভায় এই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় বলে জানান, বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি এম এ সালাম। সভায় পোশাক কারখানা বন্ধ হওয়ার দশ কারণও খুঁজে বের করেন তারা। এম এ সালাম বলেন, চট্টগ্রামের গার্মেন্টস শিল্পকারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পিছনে অন্যতম কারণ হলো- এলায়েন্স ও অ্যাকর্ড এর ফর্মুলা অনুযায়ী সংস্কার করতে না পারা, নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নে অক্ষমতা, পণ্যের যথাযথ মূল্য না পাওয়া, বিদেশি বায়ারদের চট্টগ্রাম বিমুখতা, কিছু বায়ার ও বায়িং হাউসের প্রতারণা, চট্টগ্রামে অবকাঠামোগত সমস্যা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার, ব্যাংক ঋণ পেতে দীর্ঘসূত্রতা, বড় বড় প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা অব্যবহৃত থাকা ও অসম প্রতিযোগিতা। এসব সমস্যা সমাধান করতে না পারলে অচিরেই পোশাক কারখানার ৩০ লাখ শ্রমিক হুমকির মুখে পড়বে।

বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক তানভীর বলেন, একটা সময় বৈদেশিক ক্রেতারা বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে বিপুল ক্রয়াদেশ (অর্ডার) পাঠাতো। কিন্তু এখন তা অনেক কমে গেছে।

তারা (ক্রেতারা) এখন ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও শ্রীলংকাকে ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। এটা আমাদের জন্য হুমকি। আমরা নির্দিষ্ট কিছু প্রোডাক্টই পর্যায়ক্রমে উৎপাদন করে আসছি। আরো প্রোডাক্ট বাড়াতে হবে। আমরা ৬৪টি প্রোডাক্ট উৎপাদান করছি। অন্যদিকে, চায়না প্রায় এক হাজারেরও বেশি প্রোডাক্ট উৎপাদন করছে। তাদের পণ্যের যোগান যেমন বেশি বায়ারদের ক্রয়াদেশও ওখানে বেশি। তাই আমাদের এই শিল্পকে বাঁচাতে ভেতর ও বাহিরের সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে হবে।

বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপাতি আবু তৈয়ব বলেন, পোশাক শিল্প কারখানার মালিকরা এখন যে সমস্যাগুলোর মধ্যে পড়ছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে লিড টাইম। বন্দরে কন্টেইনার আটকে থাকছে, সময় মত পণ্য পৌঁছানো যায় না। এতে অর্ডার হারাচ্ছি আমরা। তাছাড়া পণ্য উৎপাদনের মাত্রা বৃদ্ধি করতে অটো মেশিন ব্যবহার করতে হবে।
তিনি জানান, বিদেশি ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের আরোপিত শর্ত পূরণ করতে না পেরে গত চার বছরে চট্টগ্রামে বন্ধ হয়ে গেছে দেড় শতাধিক তৈরী পোশাক কারখানা, যেগুলোর অধিকাংশই যথাসময়ে অন্যত্র কারখানা স্থানান্তর করতে পারেনি। বন্ধ কারখানার মালিকদের কেউ কেউ মিরসরাই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে নতুন করে কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিলেও অধিকাংশই অর্থাভাবে নতুন করে কারখানা স্থাপন করতে পারছে না।

বিজিএমইএর তথ্যমতে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিজিএমইএর ৬৮৬ সদস্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এখন চালু আছে মাত্র ৩৫১টি। এর মধ্যে সরাসরি পোশাক রপ্তানির সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০০টি। ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে কয়েকটি কারখানার ১২৪ জন পোশাককর্মী নিহত হওয়ার ঘটনার পর কারখানার কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে কাজ শুরু করে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স। এরপর থেকে চার বছরে বন্ধ হয়ে গেছে ১৫৩টি প্রতিষ্ঠান।

চট্টগ্রামে সর্বশেষ গত সপ্তাহে বন্ধ হয়ে যায় এঞ্জেলা ফ্যাশন লিমিটেড। নগরীর ডবলমুরিং থানাধীন আসকারাবাদ এলাকার এ পোশাক কারখানাটিতে শ্রমিক ছিল ২২৫ জন। এই কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ এম জিয়াউল করিম বলেন, যে ভবনে কারখানাটির উৎপাদন কার্যক্রম চলছিল, সেটিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই কারখানাটি বন্ধ করা হয়েছে। সংস্কার শেষে পুনরায় কারখানা চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
কয়েক বছর আগে বন্ধ হওয়া একই ভবনে অবস্থিত পোশাক কারখানা সাদাফ ফ্যাশন লিমিটেডের এমডি এস এম জাহিদ চৌধুরী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, ইতালি ও সুইডেনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছিল আমাদের কারখানায় উৎপাদিত পোশাকের ক্রেতা। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের পরিদর্শক দল কারখানা ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যায়িত করে সেখান থেকে সরানোর শর্ত দিলে উপযুক্ত জায়গা না পাওয়া এবং আর্থিক সক্ষমতা না থাকার কারণে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই।

তিনি বলেন, বন্ধ হওয়ার পর এ পর্যন্ত ১৭ বার ভূমিকমপ হয়েছে। এর মধ্যে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার একটি ভূমিকমপও ছিল। কিন্তু ভবনটির কিছু হয়নি। অথচ তারা বলেছে, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ।

তিনি বলেন, একসময় আমি কোটি কোটি টাকার তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছি, আজ আমি কপর্দকশূন্য। বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব কারখানা অন্যত্র স্থানান্তরে যে আর্থিক সক্ষমতা দরকার-তা আমাদের নেই। মিরসরাই বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে বন্ধ কারখানা স্থাপনের সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হলেও সেখানে প্রত্যেক প্লটের জন্য এক বছরের মধ্যে এক কোটি টাকা পরিশোধের বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়েছে, যেটা সবার সামর্থ্যে নেই। ব্যবসায়ীরা জানান, নগরীর কালুরঘাটে গড়ে ওঠা দেশ গার্মেন্ট দিয়ে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। পরের দুই দশক ভালো অবস্থানেই ছিল চট্টগ্রামের গার্মেন্টস শিল্প। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার কারণে চট্টগ্রামে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে এ খাতটি।

বিজিএমইএর পরিচালক ও ও এম এস ওয়্যারিং অ্যাাপারেলস লিমিটেডের এমডি আ ন ম সাইফুদ্দিন বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনার পর ২০১৩ সাল থেকে এদেশের তৈরী পোশাক খাতে বিদেশি ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স ও এনএপি (ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান) নীতিমালার আলোকে কমপ্লায়েন্সের শর্ত পূরণের বাধ্যবাধকতা চলে আসে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর।

তিনি বলেন, ভবন নিরাপত্তা ও অগ্নি নিরাপত্তার শর্তপূরণ করতে অক্ষম হওয়ায় সারা দেশেই একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গার্মেন্ট কারখানা। এ পর্যন্ত চট্টগ্রামের দেড় শতাধিকসহ সারা দেশে প্রায় ৯০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে গেলেও এ খাতের শ্রমিকরা বেকার বসে নেই মন্তব্য করে সাইফুদ্দিন বলেন, এমনিতে আমাদের শ্রমিকের সংকট ছিল। বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার শ্রমিকদের বেশিরভাগ অন্য কারখানায় কাজ নিয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন জায়গায় নতুন করে বেশ কিছু গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে। এসব কারখানায় অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=194858