১৬ অক্টোবর ২০১৯, বুধবার, ১২:৫৩

বৈধতার মোড়কে টাকা লুটপাট

নীতি-আদর্শ থেকে বিচ্যুত আইএমইডি ব্যস্ত আউটসোর্সিং বৈঠকে

চুয়াডাঙ্গায় কৃষি ভবন নির্মাণকাজে রডের বদলে বাঁশ; রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে বালিশকাণ্ড কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল উন্নয়নযজ্ঞের টাকায় উপাচার্য-ছাত্রলীগ কীর্তি—এসব কলঙ্কিত অধ্যায় ঘটে চলে গোপনে, আবডালে। সংবাদকর্মীরা বের করে এনে প্রকাশ করলেই শুধু জানতে পারে মানুষ। নইলে থেকে যায় অজানার অন্ধকারে। অথচ সরকারের উন্নয়নযজ্ঞে যাতে এ রকম কোনো অপকর্ম না ঘটে, তা দেখভালের জন্য সরকারেরই বিশাল একটি সংস্থা রয়েছে, যার নাম ‘বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ’— আইএমইডি। এই সংস্থা তাহলে করছেটা কী? উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না কেন?

জবাব খুঁজতে অনুসন্ধানে নামে কালের কণ্ঠ। বেরিয়ে আসে নজিরবিহীন লুটপাটের এক মহাযজ্ঞের চিত্র। সবাইকে নৈতিকতা শেখানোর এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানটি আজ নিজেই অনৈতিকতার পঙ্কিলে হাবুডুবু খাচ্ছে। সেখানে তারা উদ্ভাবন করেছে এক ‘অফুরন্ত মৌচাক’, যার নাম আউটসোর্সিং। আইএমইডির সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী— সবাই আজ ব্যস্ত সেই মধু লেহনে।

১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মালয়েশিয়া সফর করে এসে সেখানকার আদলে ’৭৫-এর জানুয়ারিতে নিজের দেশে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আইএমইডি। তাঁর স্বপ্ন ছিল, সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি—এডিপির আওতায় যত প্রকল্প চলবে, সেগুলোতে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি-লুটপাট চলছে কি না, তদারকি করা। তারা নিয়মিত পরিদর্শন-পর্যবেক্ষণ করবে, প্রতিবেদন দেবে; তার আলোকে ব্যবস্থা নেবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো। সরকারের ৫৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নৈতিকতার শিক্ষক হিসেবে কাজ করবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এই সংস্থা আইএমইডি।

কত মধু আউটসোর্সিংয়ে! : আইএমইডিতে কর্মরত আছেন একজন সচিবের নেতৃত্বে প্রথম শ্রেণির ১০২ জন ও দ্বিতীয় শ্রেণির ১৮ জন কর্মকর্তা। এ বছর সরকারের এডিপির আকার দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে; প্রকল্প চলছে এক হাজার ৬০০টি। আইএমইডির একজন কর্মকর্তার মাসে তিনটি প্রকল্প পরিদর্শন ও তিন মাস পর পর প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। ‘দেশ উন্নত হচ্ছে, বাজেটে এডিপির আকার বাড়ছে, প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ছে; তাই বিদ্যমান জনবলে এত প্রকল্প নিয়মিত পরিদর্শন এখন আর সম্ভব হচ্ছে না’— এসব অজুহাত তুলে ২০১০ সালে আইএমইডি চালু করে আউটসোর্সিং। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে কিছু প্রকল্পের তদারকি ও মূল্যায়ন করিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিপুল উৎসাহে। আইএমইডি ঘিরে দীর্ঘ প্রায় এক দশক ধরে চলছে এই ‘আউটসোর্সিং মচ্ছব’।

অনুসন্ধানে জানা গেল, সরকারের রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬-এর অ্যালোকেশন অব বিজনেসের ৩২ অনুচ্ছেদে যেখানে আইএমইডির কাজ ঠিক করে দেওয়া আছে, সেখানে ‘আউটসোর্সিং’-এর কথা উল্লেখ নেই। ২০১০ সালে স্রেফ একটি পরিপত্র জারি করে আউটসোর্সিংকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। সেই পরিপত্রে জনগণের করের টাকা হরিলুটের এক ‘সুব্যবস্থা’ করে নেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, আইএমইডির কর্মকর্তারা আউটসোর্সিং করা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করবেন এবং বৈঠকে বসার জন্য পদমর্যাদাভেদে নির্দিষ্ট সম্মানী পাবেন।

আসুন, অনুসন্ধানে পাওয়া কর্মকর্তাদের এই সম্মানী বা বৈঠক ভাতার বহরটা দেখে নেওয়া যাক :

রাজধানীর শেরেবাংলানগরে আইএমইডি কার্যালয়ের তিনতলা ভবনের তৃতীয় তলায় রয়েছে বড় একটি কনফারেন্স রুম। একজন কর্মকর্তা তাঁর অফিস সময়েই সকাল ১১টায় নিয়মিত কাজ ফেলে চেয়ার থেকে উঠে কয়েক গজ হেঁটে কনফারেন্স হলে গিয়ে আউটসোর্সিংয়ের বৈঠকে বসবেন; আলোচনা করবেন; চা-নাশতা খাবেন; পরামর্শ দেবেন; দুপুরের খাবার খাবেন তারপর বেলা ১টা-দেড়টায় বৈঠক ভাতা পকেটে পুরে চলে আসবেন। বলা বাহুল্য, চা-নাশতা-লাঞ্চ আর বৈঠক ভাতার পুরোটাই ‘নির্ভেজাল জনগণের টাকা’।

এবার দেখা যাক, নিয়মিত বেতন-ভাতার বাইরে বৈঠক ভাতা থেকেও আইএমইডির কোন কর্মকর্তার কত আয় :

১ জুলাই ২০১৫ থেকে কার্যকর হওয়া জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী সরকারের একজন সচিবের মাসিক বেতন ৭৮ হাজার টাকা নির্ধারিত। এর সঙ্গে বাড়ি ভাড়া ৫০ শতাংশ বা ৩৯ হাজার টাকা, গাড়ি ও গাড়ি ভাতা ৫০ হাজার টাকা, চিকিৎসা ভাতা, টেলিফোন বিল, বাবুর্চি বিলসহ একজন সচিবের মাসে মোট বেতন-ভাতা আসে দুই লাখ টাকা। এবার দেখা যাক, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে গত বছর আইএমইডি সচিব কত টাকা আয় করেছেন। পদাধিকারবলে আইএমইডি সচিব আউটসোর্সিং পরিচালনার জন্য দুটি কমিটির আহ্বায়ক। একটি হলো প্রকল্প নির্বাচন ও বাজেট বিভাজন কমিটি, অন্যটি স্টিয়ারিং কমিটি। প্রকল্প নির্বাচন ও বাজেট বিভাজন কমিটিতে সচিবের বৈঠক ভাতা বা সম্মানী এক হাজার ২০০ টাকা। আইএমইডিতে মোট আটটি সেক্টর আছে। আটটি সেক্টরে আলাদা করে আটবার প্রকল্প নির্বাচন ও বাজেট বিভাজন কমিটির সভা হয়েছে। সে হিসেবে আটটি সভায় অংশ নিয়ে সচিবের আয় হয়েছে ৯ হাজার ৬০০ টাকা। স্টিয়ারিং কমিটিতে সচিবের বৈঠক ভাতা এক হাজার ৮০০ টাকা। একটি প্রকল্পে তিনটি করে স্টিয়ারিং কমিটির সভা হয়। ৪৮টি প্রকল্পে তিনটি করে স্টিয়ারিং কমিটির সভা করে সচিব বৈঠক ভাতা পেয়েছেন দুই লাখ ৫৯ হাজার ২০০ টাকা। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে প্রকল্প মূল্যায়ন শেষে ডাকা হয় জাতীয় কর্মশালা। ৪৮টি প্রকল্পে আলাদা আলাদা কর্মশালা। প্রতি কর্মশালায় সচিবের সম্মানী ছয় হাজার টাকা। ৪৮টি জাতীয় কর্মশালায় অংশ নিয়ে সচিবের এসেছে দুই লাখ ৮৮ হাজার টাকা। বছরজুড়ে আইএমইডিতে আউটসোর্সিং করা প্রতিষ্ঠানকে যে সহায়তা দেওয়া হলো, তার জন্য প্রতিটি প্রকল্প থেকে সচিবকে সম্মানী দেওয়া হয় ২০ হাজার টাকা করে। এভাবে ৪৮টি প্রকল্পে ব্যবস্থাপনা সেবা সম্মানী বাবদ সচিব পেয়েছেন ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ৪৮টি প্রকল্প থেকে গত বছর সচিবের আয় ছিল ১৫ লাখ ৪৩ হাজার ৮০০ টাকা; যা গড়ে মাসে এক লাখ ২৮ হাজার ৬৫০ টাকা। প্রতি মাসে আইএমইডি সচিব বেতন-ভাতা পান দুই লাখ টাকা; তার সঙ্গে শুধু আউটসোর্সিং খাত থেকে মাসে যোগ হয়েছে আরো এক লাখ ২৮ হাজার ৬৫০ টাকা। ২০১০ সাল থেকে যতজন সচিব এই বিভাগের দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁরা সবাই এই সুবিধা পেয়েছেন; যে সুযোগ অন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতে নেই।

এভাবে হিসাব কষে দেখা যায়, আইএমইডির মহাপরিচালক পদের (যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার) একজন কর্মকর্তা যাঁর নিয়মিত বেতন-ভাতা, গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধাসহ মাসে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। তিনি গত বছর আউটসোর্সিংয়ের বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশ নিয়ে বাড়তি আয় করেছেন আট লাখ টাকা অর্থাৎ মাসে ৬৬ হাজার ৬৬৬ টাকা; যুগ্ম সচিবের নিয়মিত বেতন-ভাতা মাসে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা আর আউটসোর্সিং বৈঠক থেকে আয় ৫৮ হাজার ৩৩৩ টাকা। পরিচালকের (উপসচিব) নিয়মিত বেতন-ভাতার আয় এক লাখ ৪০ হাজার টাকা আর শুধু বৈঠক করে মাসে আয় আরো ৫০ হাজার টাকা। সহকারী পরিচালক পদের নবম গ্রেডের একজন কর্মকর্তার মাসে নিয়মিত বেতন-ভাতা ৪০ হাজার টাকা আর আউটসোর্সিংয়ের বৈঠক বাবদ বাড়তি পেয়েছেন মাসে আরো ৩৩ হাজার ৩৩৩ টাকা। চতুর্থ শ্রেণির একজন কর্মচারী আউটসোর্সিং খাতে গত বছর ক্ষেত্রভেদে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকার মতো বাড়তি আয় করেছেন।

এভাবে আইএমইডিতে কর্মরত প্রথম শ্রেণির ১০২ জন কর্মকর্তা, দ্বিতীয় শ্রেণির ১৮ জন কর্মকর্তা, তৃতীয় শ্রেণির ৬৮ ও চতুর্থ শ্রেণির ৩৯ জন কর্মচারী—মোট ২২৭ জনের সবাই আউটসোর্সিংয়ের মধু লুটছেন। প্রকল্প মূল্যায়ন করা হয় কাজ চলা অবস্থায়, আবার কাজ শেষেও। প্রতিটি প্রকল্প মূল্যায়নের কাজে আউটসোর্সিং করা প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ ৩২ লাখ টাকা করে। গত বছর এক হাজার ৬০০ প্রকল্পের মধ্যে ৪৮টি প্রকল্পের মূল্যায়ন আউটসোর্সিংয়ে দেওয়া হয়েছিল; বরাদ্দ ছিল ১৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে আউটসোর্সিং খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ২৪ কোটি টাকা আর প্রকল্প মূল্যায়নের সংখ্যাও বাড়িয়ে ৭২টি করা হচ্ছে—এ তথ্য জানালেন আইএমইডির যুগ্ম সচিব মাহমুদুল হক। সম্মানী বাবদ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে টাকা আয় করেছেন সেখান থেকে অবশ্য ১৫ শতাংশ ভ্যাট কাটা হয়েছে।

সভা করেই দিন পার : বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে যে নবীন কর্মকর্তাটি আইএমইডিতে যোগ দেন, তাঁর একেকটি কর্মদিবস পার হয় শুধু আউটসোর্সিংয়ের জন্য সভার প্রস্তুতি আর সভা আয়োজন করেই। তাঁর পক্ষে আর অন্য নিয়মিত কাজ বা মাঠে গিয়ে প্রকল্প পরিদর্শন হয়ে ওঠে না। বিসিএস ২৯তম, ৩০তম ও ৩৫তম ব্যাচের একাধিক কর্মকর্তা আইএমইডিতে কিভাবে তাঁদের কর্মঘণ্টা পার করেন তা জানতে প্রায় এক মাস ধরে অনুসরণ করেন এই প্রতিবেদক। দেখা যায়, আইএমইডিতে আটটি সেক্টরের মধ্যে একটি সেক্টরে একটি প্রকল্পের জন্য একজন নবম গ্রেডের (ডেস্ক অফিসার) কর্মকর্তাকে মোট ১৩টি সভা ডাকতে হয়। এক বছরে একটি সেক্টরে একজন ডেস্ক কর্মকর্তা আউটসোর্সিংয়ের দুটি প্রকল্পের দায়িত্বে থাকেন। ফলে তাঁকে ২৬টি সভা করতে হয়। কথা বলে জানা যায়, সভা আয়োজন করতে প্রথমে সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি পাঠাতে হয়। কার্যপত্র তৈরি করতে হয়। সবার আসা নিশ্চিত করতে হয়। সভা শেষে কার্যবিবরণী লিখতে হয়। সেটা আবার অনুমোদন করে সবখানে পাঠাতে হয়। একেকটি সভা আয়োজন করতে সময় লাগে এক সপ্তাহ। আউটসোর্সিংয়ের এসব করতে করতেই বছরের প্রায় পুরো সময় শেষ। তবে আউটসোর্সিং কারিগরি কমিটি, স্টিয়ারিং কমিটি, সম্পাদনা কমিটিসহ বিভিন্ন সভায় অংশ নিয়ে নবম গ্রেডের একজন কর্মকর্তা বছরে বাড়তি আয় করেন চার লাখ টাকা; গড়ে মাসে দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৩০০ টাকা। আর সরকারি বেতন স্কেলে তাঁর মাসিক আয় হয় ৪০ হাজার টাকা।

কী উদ্ধার আউটসোর্সিংয়ে : এবার দেখা যাক, জনগণের টাকা, অফিসের কর্মঘণ্টা লোপাট করা আউটসোর্সিং থেকে কতটা লাভবান হয় দেশ বা সরকার? তৃতীয় একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যখন আইএমইডি চুক্তি করে, তখন স্পষ্ট বলা থাকে, প্রকল্পের অনিয়ম ও ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে আনতে হবে। ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত যে ২৩০টি প্রকল্প তৃতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়েছে, সেখান থেকে ৩০টি প্রকল্পের মূল্যায়ন প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে, শুধু প্রকল্পের স্তুতি আর স্তুতি। ত্রুটি-বিচ্যুতি বলে কিছু নেই। অনিয়ম-দুর্নীতির বালাই নেই।

যেমন, বাংলাদেশ ব্যাংককে অটোমেশনের মাধ্যমে শক্তিশালী করতে ২০০৩ সালে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। ৪১০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি চার দফা মেয়াদ বাড়িয়ে কাজ শেষ হয় ২০১৪ সালে। অটোমেশন খাতেই খরচ হয় ২১০ কোটি টাকা বা ৬১ শতাংশ। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান শাখা মতিঝিলে আইটি ল্যাব স্থাপন, নিয়ন্ত্রক ও তত্ত্বাবধায়ক শক্তিশালীকরণ, গবেষণা ও কর্মকর্তাদের তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে অভিজ্ঞ করে তুলতে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল এই প্রকল্পের আওতায়।

প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পরের বছর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম নামের ব্যক্তি পরামর্শককে দিয়ে প্রকল্পটি মূল্যায়ন করে আইএমইডি। মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সদর দপ্তর পরিদর্শন শেষে সাইফুল ইসলাম ওই বছরই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ‘প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সদর দপ্তরে আইটি অবকাঠামো ও সার্ভার স্থাপন করা হয়েছে। ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ ও আইটি ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। এর ওপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুরো আইটি ব্যাকবোন দাঁড়িয়ে আছে। সেখানকার নিরাপত্তাব্যবস্থা অত্যন্ত সন্তোষজনক। সার্ভার রুমে প্রবেশের সময় রেজিস্টার মেইনটেন করতে হয়।’ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘সকল তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রমাণ হয়, যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে, সেটি পুরোপুরি অর্জিত হয়েছে। প্রতীয়মান হয় যে, প্রকল্পটি নেওয়া সার্থক হয়েছে।’

বিস্ময়করভাবে এই মূল্যায়ন প্রতিবেদনের পরের বছর ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারিতেই ঘটে যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির কলঙ্কময় চাঞ্চল্যকর ঘটনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাসওয়ার্ড নিয়ে চুরি করা হয় আট কোটি ১০ লাখ ডলার, বাংলাদেশি টাকায় ৮১০ কোটি টাকা। পরে তদন্তে উঠে আসে, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি অরক্ষিত। ছিল কর্মকর্তাদের অদক্ষতাও।

এই ঘটনা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল—বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আইএমইডি এখন মূলনীতি থেকে বহুদূর; তাদের চোখ এখন শুধু টাকায়।

জাতীয় কর্মশালার নামে ঘরোয়া বৈঠক : যেকোনো প্রকল্প মূল্যায়নের বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং অর্থ বিভাগের সম্পর্ক থাকে। তাই আইএমইডির জাতীয় কর্মশালায় এই চারটির একজন করে প্রতিনিধি থাকার কথা। এর বাইরে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয় জাতীয় কর্মশালায়। কোনো আউটসোর্সিং করা প্রতিষ্ঠান মাঠ পর্যায় থেকে সব তথ্য এনে মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করার পর সেটি কেমন হলো তা জানতে জাতীয় কর্মশালা আয়োজন করে আইএমইডি। গত জুনে অনুষ্ঠিত একটি জাতীয় কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের তালিকা সংগ্রহ করেছে কালের কণ্ঠ। সেখানে দেখা গেল, কর্মশালায় উপস্থিত মোট ১৩৯ কর্মকর্তার মধ্যে আইএমইডিরই ১০৮ জন, ১৫ জন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের, বাকি ১৬ জনও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ইকোনমিক ক্যাডারের। অর্থাৎ একটি জাতীয় কর্মশালা করেছেন নিজেরা নিজেরাই। সেখানে সংশ্লিষ্ট কোনো বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ কিংবা অন্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কাউকে দেখা যায়নি।

প্রকল্প দেখার সময় নেই : সরকারের রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬-এর অ্যালোকেশন অব বিজনেস (অনুচ্ছেদ ৩২) অনুযায়ী আইএমইডির কার্যাবলির ৪ নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘স্পট ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে প্রকল্পের বাস্তবায়ন অবস্থা জানার জন্য মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন।’

গাছ কাটাসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পটি এখন দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। গত বছর ২৩ অক্টোবর একনেক সভায় এক হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। এক বছর হতে চললেও এখন পর্যন্ত প্রকল্পটি দেখতে যাননি আইএমইডির কোনো কর্মকর্তা।

গত ১৬ সেপ্টেম্বর আইএমইডির শিক্ষা ও সামাজিক শাখার পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুনের অফিসে গিয়ে অনুমোদনের পর থেকে এখন পর্যন্ত আইএমইডির কোনো কর্মকর্তা প্রকল্পটি পরির্দশনে গেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পটির কাজ এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি। তাই এখনো কেউ যায়নি। আউটসোর্সিংয়ের ব্যস্ততার কারণেই কি যাওয়া হয়নি—এমন প্রশ্নে আবদুল্লাহ আল মামুন বললেন, ‘আউটসোর্সিংয়ের কারণে ব্যস্ততা বেড়েছে; তার পরও আমরা শতভাগ প্রকল্প সরেজমিন পরিদর্শনে যাই।’

এক হাজার ৯২০ কোটি টাকা ব্যয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন, ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন প্রকল্পটি গত বছর ১ অক্টোবর একনেক সভায় অনুমোদন পায়। কিন্তু এই প্রকল্পও এখন পর্যন্ত কেউ পরিদর্শনে যেতে পারেনি বলে জানান আইএমইডির এই পরিচালক।

রূপপুর পারমাণু প্রকল্পে একটা বালিশের দাম পাঁচ হাজার ৯৫৭ টাকা আর সেটা তুলতে ৭৬০ টাকা খরচ দেখানোর খবর পত্রিকায় প্রকাশের পরই কেবল আইএমইডির সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ ছুটে যান সেখানে। তার আগে ওই প্রকল্প পরিদর্শনে যাওয়ার সময় হয়নি কারো।

আইএমইডি সচিব আবুল মনসুর মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ অবশ্য আউটসোর্সিং পদ্ধতিকে ইতিবাচকই দেখছেন। তাঁর মতে, তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকল্প পরিদর্শন করালে নতুন কিছু উঠে আসে, যেটা আইএমইডির একজন কর্মকর্তার প্রতিবেদনে উঠে না-ও আসতে পারে। তবে ভালো প্রতিষ্ঠান যে আউটসোর্সিংয়ে আসছে না তা স্বীকার করে আইএমইডি সচিব বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি ভালো কিছু প্রতিষ্ঠানকে আনতে।’

ঘরে বসে নকল, দায়সারা প্রতিবেদন : ২০১৬ সালে রাজবাড়ীর কালুখালী থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে পরামর্শক রফিকুল আলম যেসব তথ্য ব্যবহার করেছিলেন, পরের বছর পাবনার ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পে হুবহু একই তথ্য দিয়েছেন তিনি। নকল প্রতিবেদন ধরে ফেলে আইএমইডি। আইএমইডি থেকে সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক ড. মসিউর রহমান কালের কণ্ঠকে গত আগস্টে বলেন, ‘তথ্য কেন নকল করেছে, সেটি আমরা জানতে চেয়েছি; কিন্তু পরামর্শক রফিকুল আলম কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।’ তারপর কী হলো?

৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহীর তালাইমারী চত্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি স্কয়ার নির্মাণ প্রকল্প গত বছর জানুয়ারিতে একনেক সভায় অনুমোদন পায়। ছয় মাস পর প্রকল্পটির অগ্রগতি দেখতে আইএমইডির উপপরিচালক মশিউর রহমানের পরিদর্শনে যাওয়ার কথা। সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়েছে দাবি করে তিনি প্রতিবেদনে শুধু উল্লেখ করেন, ‘ইতোমধ্যে ছয় মাস পেরিয়েছে; প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ০.৮৪ শতাংশ। প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কোনো কাজই শুরু হয়নি।’ কিন্তু কেন শুরু হয়নি এবং কোথায় সমস্যা প্রতিবেদনে তার কিছুই উল্লেখ করেননি তিনি।

আইএমইডির প্রতিবেদনের সূত্র ধরে প্রকল্পটির খোঁজখবর নিতে গিয়ে জানা গেল, পরিবেশ অধিদপ্তর এই প্রকল্পের অবস্থান ছাড়পত্র দিতে টালবাহানা করেছে। পরামর্শকের কাছ থেকে নকশা পেতেও দেরি হয়েছে। সে কারণে প্রকল্পের অগ্রগতি শ্লথ। আইএমইডির প্রতিবেদনে এসব কিছুই উল্লেখ নেই।

জানতে চাইলে মশিউর রহমান গতকাল মঙ্গলবার বলেন, ‘আমি এভাবে আপনাকে কোনো তথ্য দেব না। আমাদের ফোকাল পয়েন্ট আছে, সেখানে যোগাযোগ করুন অথবা তথ্য অধিকার আইন অনুসরণ করুন।’

আউটসোর্সিং নিয়ে আইএমইডির কর্মকর্তারা কতটা ব্যস্ত তার কয়েকটি উদাহরণ মিলেছে অনুসন্ধানে। গত জুন মাসে সারা দেশে কৃষিশুমারির কাজ দেখতে আইএমইডির পরিচালক মোশারফ হোসেন মাত্র একটি জেলায় একবার পরিদর্শনে গেছেন। বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে সিটি করপোরেশনের বাইরে ২৮৭ জন সংসদ সদস্যের জন্য তাঁদের নিজ নিজ এলাকার রাস্তাঘাট নির্মাণে চার হাজার ৬৯১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ প্রকল্প সরেজমিন দেখতে আইএমইডির কর্মকর্তা পরিমল চন্দ্র বসু মাত্র দুটি জেলা রাজশাহী ও নাটোরে পরিদর্শন করেন।

ঘুরেফিরে কয়েকটি : অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১০ সাল থেকে ঘুরেফিরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরামর্শকের কাজ পাচ্ছে। রিসার্চ ইভ্যালুয়েশন অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (রিড) নামের একটি প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ পাচ্ছে। আইএমইডির মূল্যায়ন শাখা থেকে রিড প্রতিষ্ঠানটি কাজ পেয়েছে। মূল্যায়ন শাখার মহাপরিচালক ছিলেন সুফিয়া আতিয়া জাকারিয়া। গত বছর ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি পিআরএলে যান। এসএ কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল, এনমাস প্রাইভেট লিমিটেড ও পিএমআইডি নামের তিনটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর ধরে প্রকল্পের কাজ পাচ্ছে আইএমইডির স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন শাখা থেকে।

আইএমইডির সাবেক সচিব হাবিব উল্লাহ মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাগজপত্র ব্যবহার করেই একজন আইএমইডিতে পরামর্শকের কাজ পেয়ে থাকে। সেখানে ভালো মানের কোনো পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আসে না। সে কারণে ভালো মানের কাজও হয় না।

সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প মূল্যায়নের জন্য বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (বিআইডিএস) কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন কয়েকজন কর্মকর্তা।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, আইএমইডির দায়িত্বই হলো প্রকল্প মূল্যায়ন করা। তারা যদি আউটসোর্সিং করেও থাকে, তাহলে তাদের এত মিটিং-সিটিংয়ের দরকার তো পড়ে না। আউটসোর্সিংয়ের নাম করে তারা যেসব বৈঠক করে এবং সেখান থেকে সম্মানী নেয়; এটা তারা করতে পারে না। কারণ কর্মকর্তারা তো সরকারের কাছ থেকে বেতন পানই। তাহলে আউটসোর্সিংয়ে বৈঠক দেখিয়ে কেন বাড়তি টাকা নেওয়া? আলী ইমাম মজুমদার মনে করেন, সুশাসনের অভাবেই এমনটা হচ্ছে। শাসনব্যবস্থার শৃঙ্খলার অভাবে কর্মকর্তারা নিজের বেতন-ভাতার বাইরেও বাড়তি টাকা নেন। এটা অনৈতিক চর্চা।

আলী ইমাম মজুমদার আরো বলেন, আইএমইডি যদি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমেই প্রকল্প মূল্যায়ন করে থাকে, তাহলে তাদের কাজ কী রইল? তাদের তো জনবল আছে। যদি তাদের আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমেই প্রকল্প মূল্যায়ন করতে হয়, তাহলে তাদের যে জনবল আছে, সেটা রেখে লাভ কী? ছেঁটে দেওয়াই ভালো। আইএমইডির এই আউটসোর্সিংকে একটি খারাপ প্রবণতা বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক এই সচিব।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/10/16/827264