১৩ অক্টোবর ২০১৯, রবিবার, ৪:২৭

খেলাপি ঋণ ৩ লাখ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে পাতানো খেলা বন্ধের আহ্বান সুজনের

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেশের খেলাপি ঋণ এক লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি। আসলে দেশের খেলাপি ঋণ তিন লাখ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের ৩০ শতাংশই খেলাপি। ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানে শক্তিশালী কমিশন গঠন করতে হবে। শীর্ষ খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে হবে। দেশে এত ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। তাই ব্যাংকগুলো একীভূত করতে হবে। ব্যাংক ঋণ নিয়ে পাতানো খেলা চলছে। সমস্যার প্রকৃত রূপটি সরকার, ব্যাংকার ও ঋণখেলাপি সবারই জানা।

সমস্যার সমাধানের উপায় সম্পর্কেও এ তিন পক্ষের সবার স্পষ্ট ধারণা আছে। তারপরও জেনেশুনেই সরকার সমাধানের পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ফলে এখনো দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের কাছে আটকে থাকা বিপুল খেলাপি ঋণ। এ ঋণখেলাপিদের প্রায় সবাই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, মানে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে, ঋণ ফেরত দেবেন না। কারণ তাদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ও আর্থিক প্রতাপ দিয়ে তারা শুধু ব্যাংকিং খাত নয়, দেশের সংসদকেও দখল করে ফেলেছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধে এসব কথা বলা হয়। ‘ব্যাংকিং খাত নিয়ে উল্টোপাল্টা পদক্ষেপ বন্ধ করুন : ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন গঠন করুন’ শীর্ষক গোলটেবিলে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম।

মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ী নাকি এখন সাতটি ব্যাংকের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। ব্যাংকের মালিকানায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ অন্য কোনো দেশে চালু আছে কি না, আমার জানা নেই। ব্যাংক পরিচালকদের নিজেদের মধ্যে ঋণ নেয়া বন্ধ করতে হবে। ব্যাংক পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসকে বেআইনি ঘোষণা করতে হবে, যাতে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতাকে অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করতে না পারে।

বাংলাদেশে যে পাতানো খেলা চলছে, তাতে কখনো দেশে খেলাপি ঋণ আদায় হবে না। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি। তার বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? হয়নি, আর হবেও না। বিগত ২০১৪-১৯ মেয়াদের সরকারের সময়েও খেলাপি ঋণের অবস্থা সঙ্কটজনক থাকা সত্ত্বেও রহস্যজনক কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন গঠনের ইস্যুটিকে বারবার এড়িয়ে গেছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতাগ্রহণের ৯ মাস অতিক্রান্ত হলেও এখনো তিনি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেননি। এত দিনে তার বোঝা উচিত, অর্থমন্ত্রীর টোটকা দাওয়াই দিয়ে খেলাপি ঋণের ক্যান্সার সারানো যাবে না।

দেশে বেশির ভাগ ব্যাংকের অবস্থা ভালো নয়। যার মূল কারণ খেলাপি ঋণ। এমন অবস্থায় প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সুপারিশ করার জন্য অবিলম্বে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন গঠন করার দাবি জানানো হয় বৈঠকে।

প্রবন্ধে বলা হয়, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন, তিনি আর খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়তে দেবেন না। অতএব, একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট চাল প্রয়োগ করে তিনি মন্দ ঋণ রাইট-অফ করার পদ্ধতি সহজ করে দিয়েছেন, যাতে ক্লাসিফাইড লোনের এ শিথিল পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিভিন্ন ব্যাংক ‘মন্দ ঋণ রাইট-অফ করা’ বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। রাইট-অফ করা মন্দ ঋণ বাড়ার মানেই হলো এর ফলে ক্লাসিফাইড লোন ওই পরিমাণ কম দেখানো যাবে। তিনি মন্দ ঋণ আদায়ের জন্য খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে দুই শতাংশ ঋণ প্রাথমিক কিস্তিতে পরিশোধ করে যে ১০ বছরের সময় দেয়ার ব্যবস্থা করলেন, সে সুবিধা নিয়মনিষ্ঠ ঋণ ফেরতদাতারা পান না। এ ধরনের পরিবর্তন খেলাপি ঋণ সমস্যাটিকে আড়াল করার পন্থা হলেও মন্দ ঋণ আদায় করার কোনো নিষ্ঠাবান প্রয়াসের মাধ্যমে জোরদার করার লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো একজন ‘ব্যবসায়ী অর্থমন্ত্রী’ তার ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী বন্ধুদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত দরদ দেখিয়ে উল্টোপাল্টা পদক্ষেপ নিয়ে চলেছেন।

আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি কেউ কাউকে পছন্দ করে না। কিন্তু ঋণখেলাপি সৃষ্টিতে সবাই একমত। এখন জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে গর্ববোধ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর আমলেও আট শতাংশের কাছাকাছি জিডিপি ছিল। তিনি কখনো এসব নিয়ে গর্ববোধ করতেন না। আয়বৈষম্য কমিয়ে আনতে বলতেন। চোর-ডাকাতের দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। চরম বৈষম্যে পৌঁছেছে বাংলাদেশ।

সালমান এফ রহমানকে ইঙ্গিত করে খালেদ বলেন, ক্যাসিনোর সম্রাট একজন, ব্যাংকের সম্রাট আরেকজন। আর এই স¤্রাট যদি থাকেন, তাহলে কোনো কাজ করা যাবে না। এই সম্রাটকে ধরতে পারলে সবকিছু ঠিক হবে। শেয়ারবাজার তদন্ত প্রতিবেদনে তার নাম সবার ওপরে রেখেছিলাম। তিনি সব জায়গায় লুট করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় আরো আলোচনা করেন অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার, লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইনাম আহমেদ চৌধুরী, বিএনপির সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান প্রমুখ।

সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন বলেন, যুবলীগ নেতা সম্রাট আঞ্জুমানের কাছে দুই কোটি টাকা চাঁদা চেয়েছিল, এক বছর কাজ আটকে ছিল। পরে প্রধানমন্ত্রীর কানে এ খবর পৌঁছানোর পর এ সমস্যার সমাধান হয়েছে। তাই রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে হবে। রাজনীতি যদি শুদ্ধ না হয় তাহলে কিছুই ভালো হবে না। জিডিপিতে উন্নয়ন দেখছি, কিন্তু আমি তো আমাদের অবস্থানের কোনো উন্নয়ন দেখি না।

কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, যার যা ইচ্ছা, তা-ই করছে। ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছে। কিন্তু কিছুই বলার ক্ষমতা আমাদের নেই। বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বের মধ্যে এক নম্বর ঋণখেলাপির দেশে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভালো হয়, যদি আমরা ব্যাংকে টাকা না রাখি। মানুষ বোকার মতো ব্যাংকে টাকা রাখছে। আর ঋণখেলাপিদের সুবিধা করে দিচ্ছে।

জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, রাজনীতি করা এখন একটি বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। গত কয়েক বছরে যত বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে তার সব এ সরকারের সময়ে হয়েছে। ব্যাংকের ওপর থেকে যখন মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হয়, তখন দেশের অর্থনীতি ধসে পড়ে। এই সরকার ঋণখেলাপিবান্ধব সরকার।

সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ব্যাংকিং খাত লুটেরাদের হাতে চলে গেছে। এ সরকার খেলাপি ঋণবান্ধব সরকার। দুর্বৃত্ত শ্রেণীরা ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণ করছে। যারা ব্যাংক খাতে জালিয়াতি করছে তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না বরং তাদেরকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। ঋণখেলাপিকে তারা (যারা ঋণ নিচ্ছেন) সিস্টেমে পরিণত করেছে।

বৈঠকে খেলাপি ঋণ কমাতে কয়কটি পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ খেলাপি ঋণ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ ১০ খেলাপিকে দ্রুত শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। ব্যাংকিং খাতের জন্য আলাদা ন্যায়পাল নিয়োগ, মন্দ ঋণ আদায়ের জন্য ‘ডেট রিকভারি বা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’ গঠন, অর্থঋণ আদালতে কোনো ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রায় হলে জামানত বা বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম করার জন্য মামলা করার যে নিয়ম রয়েছে তা বাতিল করা, প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ দশ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের নাম এক বছরের বেশি তালিকাভুক্ত হলে ওই প্রতিষ্ঠানের মূল ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার পাশাপাশি তার পাসপোর্ট জব্দ করা ইত্যাদি।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/447682